পাকিস্তানিরা এখন বাংলাদেশের মতো উন্নত হতে চায়…

প্রশান্তি ডেক্স॥ পাকিস্তানের ক্ষমতার মসনদে আসীন হয়েছে তেহরিকই ইনসাফ (পিটিআই), আর দায়িত্ব গ্রহণের পরই দেশটির নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ঘোষণা দিয়েছেন যে তার সরকার দেশ পরিচালনায় সুইডিশ গভার্নেন্স মডেল অনুসরণ করবে।
এক কথায় পাঁচ বছরের মধ্যে পাকিস্তানকে সুইডেনে রূপান্তরের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন তিনি তার দেশের মানুষকে। তবে মজার ব্যাপার হলো, পাকিস্তানের মানুষ কিন্তু সেই ফাঁদে পা দিচ্ছে না। পাঁচ বছরের মধ্যে পাকিস্তান সুইডেনে পরিণত হবে, এ কথা তাদের কাছেও নিছকই কৌতুক বলেই মনে হয়েছে। এ নিয়ে চলছে বিস্তর হাসি তামাশা। এরই মাঝে পাকিস্তানি এক টিভি চ্যানেলে প্রচারিত একটি টক-শোর ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়েছে ইন্টারনেট জগতে। আমাদের বাংলাদেশেরও বহু মানুষ বেশ উৎসাহের সাথে দেখছে ও ছড়িয়ে দিচ্ছে সেই ভিডিওটি। এর পেছনেও যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে।pakistan bangladesh hotea chai
কারণ সেই টক-শোতে বক্তা যে আমাদের বাংলাদেশের প্রসঙ্গই টেনে এনেছেন। বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে কতটা এগিয়ে গেছে, সে দৃষ্টান্ত দেখিয়ে তিনি ইমরান খানের উদ্দেশে বলেছেন, “আরে, খুদা কি ওয়াস্তে হামে বাংলাদেশ বানা দো। পাঁচ বছর নয়, অন্তত দশ বছরের মধ্যেও যেন ইমরান খান পাকিস্তানকে বাংলাদেশের সমপর্যায়ে নিয়ে আসতে পারেন, সেই অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।

ইমরান খান, তেহরিক ই ইনসাফ, পাকিস্তান, নির্বাচন অনেকেই দেখা যাচ্ছে এই ভিডিওটি দেখে খুবই হতবাক হয়েছে। এখানে অনেকে বলতে কাদের কথা বলছি, তা বুঝে নিতে নিশ্চয়ই কারও অসুবিধা হচ্ছে না। বাংলাদেশে বসেও যারা পাকিস্তানের স্বপ্নে বিভোর, সেই শ্রেণীর মানুষদের যেন বিশ্বাসই হতে চাইছে না যে একজন সাচ্চা পাকিস্তানিও বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের তুলনা করে বলবেন, তারা বাংলাদেশের মত হতে চান! বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে কতটা এগিয়ে গেছে, সে ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে ওই বক্তা কয়েকটি বিশেষ খাতের উদাহরণ দেখিয়েছেন। যেমন তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের স্টক এক্সচেঞ্জে বছরে ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার লেনদেন হয়, যেখানে পাকিস্তানে হয় মাত্র ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আবার বাংলাদেশ বছরে রপ্তানি খাতে আয় করে ৪০ বিলিয়ন ডলার, যেখানে পাকিস্তানের আয় মাত্র ২২ বিলিয়ন ডলার। এইসব উদাহরণ দেখিয়ে তিনি বলেছেন, পিটিআই যদি সবকিছু ঠিকঠাকও করে, তবু সুইডেন কেন, আগামী দশ বছরে তাদের বাংলাদেশের সমান হওয়াও অনেক কঠিন হয়ে যাবে। এখন আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই আরও বেশ কিছু পরিসংখ্যান যার মাধ্যমে প্রতীয়মান হবে যে, বাংলাদেশ কেবল পাকিস্তানের চেয়েই যোজন যোজন ব্যবধানে এগিয়ে নেই, ক্ষেত্রবিশেষে পেছনে ফেলেছে এমনকি ভারতকেও।
প্রথমেই বলতে হয় বাংলাদেশীদের গড় আয়ুর কথা। বর্তমানে একজন বাংলাদেশী ৭২ বছর বাঁচার আশা করতেই পারেন, যেখানে পাকিস্তানিদের গড় আয়ু মাত্র ৬৬। ভারতীয়দের গড় আয়ুও বাংলাদেশীদের চেয়ে কম, মাত্র ৬৮। নারীদের গড় ইনকামের দিক থেকেও বাংলাদেশ অনেকটাই এগিয়ে পাকিস্তানের চেয়ে। আর ভারতীয়দের চেয়েও সামান্য ব্যবধানে আমাদের দেশের নারীরা এগিয়ে। এর প্রধান কারণ হলো বাংলাদেশে তৈরী পোশাক শিল্পের প্রভূত উন্নতি। আর এই শিল্পটি তো মূলত নারীদের কল্যাণেই টিকে রয়েছে।
শিশু পুষ্টির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শুধু পাকিস্তান বা ভারতই নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যেই সেরা। অনূর্ধ্ব পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের পুষ্টিকর খাদ্য লাভের হার বাংলাদেশে ৩৬.১%, যা কিনা পাকিস্তান, ভারতসহ অধিকাংশ তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহের চেয়েই অনেক ভালো। বাংলাদেশ যে শুধু শিশু পুষ্টির দিক থেকেই এগিয়ে তা নয়, পরিসংখ্যান মোতাবেক বাংলাদেশ শিশু মৃত্যুর দিক থেকেও ভারতের চেয়ে সিকিভাগ এগিয়ে, আর পাকিস্তানের চেয়ে পুরো ৫০% এগিয়ে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতি হাজারে মাত্র ৩৭.৬ জন শিশুর মৃত্যু হয়।
imran pakistan
চাকরির স্থায়িত্বের দিক থেকেও বাংলাদেশের অবস্থান এই অঞ্চলের অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে ভালো। এদেশের কর্মজীবী মানুষের মধ্যে ৫৭.৮% স্থায়ী চাকরি করে থাকে, যা পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশি। আর সেখানে ভারতের অবস্থা তো খুবই খারাপ।
সেখানে ৮০% কর্মজীবী মানুষেরই স্থায়ী কোনো চাকরি নেই, অর্থাৎ আজ তারা যে কাজ করছে, কালও সেখানে কাজ করতে পারবে কি পারবে না তার কোনোই গ্যারান্টি নেই।
প্রযুক্তিনিভর ব্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের উন্নতি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বাংলাদেশের প্রাপ্তবয়স্ক জনগণ, যাদের ব্যাংক একাউন্ট রয়েছে, তাদের ৩৪.১%-ই ২০১৭ সালে অনলাইনের মাধ্যমে ডিজিটাল ট্রানজাকশন করেছে। সেখানে গোটা দক্ষিণ এশিয়াতেই গড় ডিজিটাল ট্রানজাকশনের হার হলো ২৭.৮%। এছাড়া বাংলাদেশী ব্যাংক একাউন্টগুলোর মধ্যে মাত্র ১০.৪% গত বছর ‘সুপ্ত অবস্থায় ছিল অর্থাৎ সেগুলোতে গত বছর কোনো টাকা যেমন জমা করা হয়নি, তেমনি সেখান থেকে কোনো টাকা তোলাও হয়নি। এই পরিসংখ্যানটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ ভারতে গতবছর বিশেষ কিছু অর্থনৈতিক রদবদলের পরও, ৪৮% ব্যাংক একাউন্টই পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় ছিল। শিক্ষা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খাত যেখানে বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে গেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ৭১% হলেও, পাকিস্তানে তা মাত্র ৫৫%। এছাড়া প্রাথমিক শিক্ষার অবকাঠামোও এই মুহূর্তে বাংলাদেশে খুবই উন্নত, এবং উত্তরোত্তর তার আরও উন্নতি সাধিত হচ্ছে। অথচ পাকিস্তান, ভারতের মত দেশগুলোতে প্রাথমিক শিক্ষার অবস্থা ক্রমশই ভগুর হয়ে পড়ছে। ২০০৬ সালের পর থেকে বাংলাদেশের জিডিপির অগ্রগতি পাকিস্তানের চেয়ে প্রতি বছরে ২.৫ শতাংশ বেশি। চলতি বছরেই বাংলাদেশের জিডিপি ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে। এছাড়া বর্তমানে বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার মাত্র ১.১%, যা পাকিস্তানের ২% এর থেকে অনেক কম।
ফলে প্রতি বছরই বাংলাদেশের পার ক্যাপিটা ইনকাম পাকিস্তানের চেয়ে ৩.৩% বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ধারা অব্যহত থাকলে, ২০২০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের মানুষের পার ক্যাপিটা ইনকাম পাকিস্তানিদের চেয়ে বেশি থাকবে।
pakistan flag
গবমিলিয়ে স্বাধীনতার পর থেকে মাত্র ৪৭ বছরে, বিশেষ করে গত এক দশকে বাংলাদেশ যে পরিমাণ উন্নতি করেছে, তাদের পাকিস্তানিদের ঈর্ষান্বিত হওয়ারই কথা, আর বাংলাদেশে সমান হতে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আক্ষেপ করাটাও খুবই স্বাভাবিক। সুতরাং উপরের পরিসংখ্যানগুলোতে চোখ বোলানোর পর, পাকিস্তান কেন আগামী দশ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের সমপর্যায়ে পৌঁছানোর স্বপ্ন দেখে, সে-ব্যাপারে আর কারও মনেই কোনো সংশয় থাকার কথা নয়।
তবে সে যাইহোক, বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে উন্নতির প্রায় সকল রাস্তাতেই অনেক বেশি এগিয়ে গেলেও, এ নিয়ে খুব বেশি আত্মতৃপ্তিতে ভোগা বোধহয় আমাদের উচিৎ হবে না। কারণ হুমায়ান আজাদের সেই বিখ্যাত উক্তি নিশ্চয়ই ভুলে যাননি, “যে বুদ্ধিজীবী নিজের সময় ও সমাজ নিয়ে সন্তুষ্ট, সে একটা গৃহপালিত পশু। এই লেখক নিজেকে মোটেই বুদ্ধিজীবী মনে করে না, কিন্তু পাঠকদের মধ্যে অনেকেই নিশ্চয়ই বুদ্ধিজীবী গোত্রের রয়েছেন। তাদেরকে বিনীত অনুরোধ জানাব, দয়া করে বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে গেছে ও যাচ্ছে বলেই দেশের বাকি সব দুরাবস্থার কথা ভুলে যাবেন না।
তাছাড়া যেহেতু আমরা নিজেদের ইচ্ছাতেই ৪৭ বছর আগে পাকিস্তানের থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছি, রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছি, তাই উন্নতির সূচক নির্ধারণে পাকিস্তান কখনোই তুলনার স্ট্যান্ডার্ড হতে পারে না। আমরা যে পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে যাব, সেটি তো অনুমিত বিষয়ই। কিন্তু এখনও আমাদের এগিয়ে যাওয়ার অনেকটা রাস্তাই বাকি। এবং কাদের চেয়ে এগিয়ে গেলাম, সে চিন্তা না করে কাদের চেয়ে পিছিয়ে আছি, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে স্বীকার করতেই হবে যে স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর যতটুকু উন্নতি আমরা করেছি, তা মোটেই যথেষ্ট নয়। বর্তমানে দেশের যে অবস্থা, তা নিয়ে আমাদের স্বস্তি বা সন্তুষ্টি, কোনোটাই অর্জনের খুব বেশি সুযোগ নেই। বেশি উদাহরণ দেব না, শুধু বাংলাদেশের সড়ক ব্যবস্থার কথাই চিন্তা করে দেখুন। এই যে গত মাসেই নিরাপদ সড়কের দাবিতে এত আন্দোলন হয়ে গেল দেশব্যাপী, তারপরও কি অবস্থার খুব বেশি উন্নতি হয়েছে? তাহলে কি আর মাত্র কয়েকদিন আগেই মায়ের কোলে থাকা একটি শিশুর জীবন কেড়ে নিত ঘাতক বাস? তাই সব কথার শেষ কথা হলো এই যে, পাকিস্তান আমাদের সমান হতে চায় এটি অবশ্যই মানসিক তৃপ্তির বিষয়, তবে শুধু সেটিকেই যেন আমরা আঁকড়ে ধরে বসে না থাকি। বরং আমাদের এখন উচিৎ হবে নিজেদের দেশের সমস্যাগুলোর সমাধান করা, আর উন্নতির চাকাকে সচল রাখা, যাতে করে দশ বছরে কেন, কোনোদিনই আর পাকিস্তান আমাদের সমপর্যায়ে আসতে না পারে। আমরা যেন তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাই। pakistan bd develope3

https://youtu.be/aBt2rS_iydI Share this:

Leave a Reply

Your email address will not be published.