পঁচাত্তরে প্রতিবাদ-প্রতিরোধে র.আ.ম. উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি নজরুল ইসলাম॥ পঁচাত্তরে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের কিছু কথা পঁচাত্তরের পনেরোই আগষ্ট আমাদের জীবনের এক দুঃসহ যাতনার দিন। এই দিন আমরা সবাই বঙ্গবন্ধুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমন নিয়ে কাজ করছিলাম কলাভবনের কলা অনুষদের অফিস কক্ষে বসে। রাত ১১টার (১৪ তারিখ) দিকে শেখ কামাল আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় চলে যান। বন্ধুরা তারপরও টেলিফোন করে তাকে বিরক্ত করতে থাকে। এভাবে চলতে থাকে অনেক রাত অবধি। এক সময় আর টেলিফোন লাইন পাওয়া যায়নি। রাতের শেষ দিকে কেউ একজন এসে খবর দিল যে শহরে ট্যাংক দেখা গেছে। আমরা যারা খবর নিলাম তারা জানতে পারলাম যে, বাংলাদেশ বেতারের সামনে ট্যাংক আর সেনা মোতায়েন হয়েছে। এরই মধ্যে সেই কঠিন দুঃসংবাদও পৌঁছল। বঙ্গবন্ধু আর নেই। কেউ বেঁচে নেই ইতিহাস গড়া সেই বত্রিশ নম্বরের বাড়িতে। আমরা হতবাক হয়ে গেলাম। বিস্মপয়ে বিমূঢ় হয়ে গেলাম। এমনিতে আমার ঠোঁট থেকে সিগারেটই নামত না। এ দুঃসংবাদে ধুম পানের মাত্রা আরো বেড়ে গেল। ইসমত কাদির গামা ঘন ঘন নস্যি টানতে লাগলেন। মাহবুব জামান ভাই, কাজী আকরাম হোসেনও সাহায্য নিলেন সিগারেটের। মমতাজ হোসেন এসপি মাহবুব সাহেবের গাড়িতে করে শহরের ভেতর দিকে চলে গেলেন। আমাদের কেউ কেউ তাৎক্ষণিক প্রতিবাদে নামতে মিছিল করার কথা বললেন। কিন্তু তখনো সবকিছু স্পষ্ট নয়। আমরা সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিলাম আরো খোঁজখবর নেয়ার। তবে একটা ব্যাপারে আমরা স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, আমরা এ ঘৃণ্য ও নৃশংস হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে মুজিবাদর্শের পক্ষে আমাদের প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলবই। খবরের প্রথম প্রতিক্রিয়ায় আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি। কলা ভবনে বসেই আমরা যোগাযোগ করলাম শেখ শহীদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি তখন সদ্য বিবাহিত। কোনো আগ্রহ না দেখে যোগাযোগ করলাম বাকশালের অন্যতম সম্পাদক আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে। তিনি সন্ত্রস্ত, বিভ্রান্ত এবং আত্মগোপনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। জাতীয় যুবলীগের মহাসচিব তোফায়েল আহমেদকে রক্ষীবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। বাকশালের আরেক সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মণি শহীদ হয়েছেন।
বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা ও বাকশালের অন্যতম সম্পাদক জিল্লুর রহমানের সঙ্গে ছাত্র-যুবকদের তেমন সম্পর্ক না থাকায় দিনের মধ্যভাবে আমরা কমিউনিষ্ট পার্টির কর্মী ও সংস্কৃতিসেবী মফিদুল হকের পৈতৃক নিবাসে আশ্রয় নেই। সেখানে বসে সুস্থির মাথায় আমরা পরামর্শ করে ঠিক করি যে, জাতীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করব। এই নির্মম নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হব এবং আন্দোলন গড়ে তুলব। সে অনুযায়ী আমরা যার যার পছন্দমতো আশ্রয়ে চলে যাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধু ঘোষণা করা হয়। আমাদের কর্মক্ষেত্র সীমিত হয়ে পড়ে। কিন্তু আমরা বসে থাকিনি। জাতীয় পর্যায়ের নেতারা, যারা জেলের বাইরে ছিলেন, তারা মোশতাকের ক্ষমতা গ্রহণের কারণে এবং মন্ত্রীসভায় কয়েকজন বাদে বড় নেতাদের সমাবেশ দেখে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। অনেকেই মন্ত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে নিজেদের অবস্থান ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন (এর মধ্যে তৎকালীন কয়েকজন খ্যাতিমান ছাত্রনেতাও ছিলেন।) আমরা কয়েকজন মধ্যমস্তরের নেতা ১৫ আগষ্টের হত্যাকান্ডের হোতাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেই। ছাত্র ইউনিয়নের যেসব নেতা জাতীয় ছাত্রলীগে ছিলেন তাদের সঙ্গে কাজ শুরু করলাম। আমরা গ্রুপে গ্রুপে বিভক্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ জানাতে শুরু করলাম। এ সময় আমরা যারা সক্রিয়ভাবে কাজ করছিলাম, তাদের মধ্যে ছিলেন এস এম ইউসুফ, মরহুম শফিকুল আজীজ মুকুল, ফকির আবদুর রাজ্জাক, রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু প্রমুখ। পার্লামেন্টের স্পিকার আবদুল মালেক উকিল লন্ডনে ও বাকশালের নির্বাহী কমিটির সদস্য মহিউদ্দিন আহমেদ মস্কো গেলেন। এরই মধ্যে খুনিচক্রের প্রধান খন্দকার মোশতাক বঙ্গভবনে এমপিদের বৈঠক ডাকেন। সে বৈঠক বয়কটের আহ্বান জানিয়ে আমরা ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ব্যাপক তৎপরতা চালাই। ছাত্রনেতাদের মধ্যে ইসম কাদির গামা, মোমতাজ হোসেন, নূরুল ইসলাম, কাজী আকরাম হোসেন, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও আমিসহ (রবিউল আলম চৌধুরী) অনেকেই এ বৈঠক ভন্ডুলের চেষ্টা করি। তবে আমাদের বাধা সত্ত্বেও বৈঠকটি হয়েছিল। এটি সফল করতে তৎপর ছিলেন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, কে এম ওবায়দুর রহমান, রাফিয়া আখতার ডলি প্রমুখ। কিন্তু বৈঠকটি শেষ পর্যন্ত ব্যার্থ হয়। মোশতাক কাঙ্খিত ফল পাননি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রবীণ নেতা ও বর্তমান আইনজীবী সিরাজুল হক মোশতাক সরকারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করলে সবকিছু ভু-ুল হয়ে যায়। এ সময় আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় সারির নেতাদের অনেকেই নিজেদের সংগঠিত করার জন্য কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। শামছুদ্দিন মোল্লা, সিরাজুল হক, আনোয়ার চৌধুরী, এম এ মালেক, মফিজুল ইসলাম কামাল, রওশন আলী, কামরুজ্জামান (শিক্ষক নেতা), ময়েজউদ্দিন আহমেদ, খালেদ মোহাম্মদ আলী প্রমুখ এ সময় সাহসী ভূমিকা পালন করেছিলেন। মোশতাকের শাসনের অবসানের পর অনেকে প্রতিবাদকারীর কাতারে শামিল হয়েছিলেন। আবার এ কথাও সত্য যে, সেদিন অনেকের কাছ থেকেই আমরা ভালো ব্যবহার পাইনি। তাই বলে আমরা দমেও যাইনি। আমরা নিজেদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করলাম অতি স্বল্প সময়েই।
১৯৭৫ সালের ২০ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে আমাদের জন্য অন্যতম স্মরণীয় দিন। ছোট পরিসরে এ ব্যাপারে এই কলাম বিশদ লেখার অবকাশ নেই বিধায় অনেকে কিছুই অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাদ গেল। এ জন্য দুঃখিত। আমরা সেদিন যারা মুজিবাদর্শের পক্ষে লড়াইয়ের লক্ষ্যে খুনি মোশতাক সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলাম, তারা নির্যাতন, এমনকি মৃত্যুকে স্বীকার করে নিয়েই সেদিন প্রতিরোধের পথে হেঁটেছিলাম (মন্ত্রী, সাংসদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য হওয়ার লোভে নয়) আমাদের বন্ধুদের অনেকেই মোশতাকের ৮৩ দিনের অবৈধ শাসনকালে শাহ মোয়াজ্জেমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ছাত্রলীগ পুনর্গঠনের দায়িত্ব নেয়ার প্রয়াস পেয়েছিলেন। পরবর্তীতে তাদের কেউ কেই ছাত্রলীগের ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসীন হন। তাদের কথাও আজকে স্মরণে আসে যারা সেদিন গা বাঁচাতে বিদেশ পাড়ি জমিয়েছিলেন। আমাদের সেদিনের সংগ্রাম যে কত কঠিন ছিল, সেদিনের সেই সময় যে কত দুঃসময় ছিল, তা বুঝিয়ে বলা সত্যিই দুস্কর। সেদিন আমাদের সঙ্গে যারা প্রতিরোধের সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, শামছুদ্দিন মোল্লা, আনোয়ার চৌধুরী, আইভি রহমান, যশোরের রওশন আলী, বগুড়ার মোস্তাফিজুর রহমান পটল, হবিগঞ্জের কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরী, মফিজুল ইসলাম খান কামাল, ডা. এস এ মালেক, সালাউদ্দিন ইউসুফ, কামরুজ্জামান (শিক্ষক নেতা), মোল্লা জালাল উদ্দিন প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এ সময়ে যারা খুবই বাজে ও নোংরা ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল তাদের মধ্যে শাহ মোয়াজ্জেম, কে এম ওবায়দুর রহমান, নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, রাফিয়া আখতার ডলি প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। মোশতাকের সঙ্গে যে ব্যক্তি উপ-রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন সেই মোহাম্মদ উল্লাহ আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে নমিনেশন পেয়েছিলেন। রহস্য পুরুষ মিজান চৌধুরীও আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে ইন্তেকাল করেছেন। এরই নাম হয়তো ভাগ্যলিপি। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যরা খুবই নাজুক পরিস্থিতিতে অবস্থান করছিলেন। প্রকাশ্য তো দূরের কথা গোপনেও তারা কোনো উদ্যোগ নিতে সাহস পাচ্ছিলেন না। শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানার সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ স্থাপিত হয়নি তখন। নানা সূত্রে শুধু পাচ্ছিলাম যে, তারা পনেরো আগষ্টের দুঃসংবাদের শোকে চরম শোকগ্রস্ত। এমনি পরিস্থিতিতে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম প্রতিবাদী মিছিল বের করার।
আমাদের ওই মিছিলই প্রথম সংঘবদ্ধ মিছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে। ওই মিছিল স্বৈরতান্ত্রিক অবৈধ শাসক মোশতাকের তখতে তাউসকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল আর কাঁপিয়ে দিয়েছিল গোটা ঢাকা নগরীকেও। আমাদের ওই মিছিল মুজিবাদর্শের সৈনিকদের আশার আলো দেখিয়েছিল। তাদের সংঘবদ্ধ হতে সাহস জুগিয়েছিল। তাই পঁচাত্তরের পনেরোই আগষ্ট যেমন বাঙ্গালীর ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণ্য দিন তেমনই ২০ অক্টোবর পঁচাত্তর বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংগ্রামের ইতিহাসের এক মাইলফলক। আমাদের এই নতুন যাত্রাপথের শেষ রেখার এখনো দেখা মেলেনি। গণতন্ত্রের সংগ্রাম এখনো চলছে। মোশতাক ও ঘাতকচক্রের প্রেতাত্বারা নানা মুখোশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাদের সময়কালে গণতন্ত্রের অভিযাত্রার শেষ রেখার দেখা যেদিন পাব সেদিনই ২০ আক্টোবরের (পঁচাত্তর) চেতনার পূর্ণাঙ্গ দেখা মিলবে। সেদিনের অপেক্ষায় রইলাম। লেখক: সংসদ সদস্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published.