আত্মপ্রত্যয়ী আমেনা বেগমের গল্প

নরসিংদী প্রতিনিধি (সূত্র পুলিশ হেডকোয়ার)॥ নরসিংদীর নারী পুলিশ সুপার শৈশব থেকেই শুনে আসছিলাম কালো মেয়ে, বিয়েতে বাবার অনেক টাকা খরচ হবে। আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতদের মুখে কথাগুলো শুনে বিরক্ত হতাম। কথাগুলো মনের গহীনে বাসা বেঁধেছিল। মনে মনে পণ করেছিলাম টাকার বিনিময়ে কোনো বিয়ে মেনে নেব না। যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে নিজেকে গড়ে তুলব একজন প্রতিভাময়ী নারী হিসেবে। যেই কথা সেই কাজ, মেধা দিয়ে নিজেকে গড়ে তুলেছি সাফল্যের চূড়ায়। বললেন নরসিংদীর প্রথম নারী পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্বরত আমেনা বেগম। শুধু দেশের পুরুষশাসিত সমাজেই নিজের জায়গা করে নেননি তিনি, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মেধা ও মননের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে আলো ছড়াচ্ছেন। পুলিশের মতো একটি চ্যালেঞ্জিং পেশায় দায়িত্ব পালন করছেন নিষ্ঠার সঙ্গে। আমেনা বেগমের শৈশব কেটেছে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে। তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় আগ্রাবাদ সরকারি কলোনি বিদ্যালয়ে। ছোটবেলা থেকেই কাজের প্রতি তিনি ছিলেন অত্যন্ত যতœশীল। লেখাপড়ার পাশাপাশিসংসারের কাজেও নিয়মিত মাকে সাহায্য করতেন। কিশোরী বয়সেই বাবা তাকে শিখিয়েছেন, পুঁথিগত বিদ্যার পাশাপাশি ব্যবহারিক কাজেও দক্ষতা অর্জন করতে হয়। এ ক্ষেত্রে ভাইদের কাছ থেকে পেয়েছেন অনুপ্রেরণা।
ভাইবোন একই টেবিলে বসে পড়াশোনা করেছেন, অন্যান্য ক্ষেত্রেও কী একই সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন? জানতে চাইলে আমেনা বেগম বলেন, বৈষম্যের শিকার তো একটু হয়েছি। ভাইরা সারাদিন ঘোরাঘুরি করত আর আমি পড়াশোনার পাশাপাশি সংসারের কাজ করতাম। বাসায় সব কাজ আমাকেই করতে হতো। আমার ভাই আমাকে খুব কড়া শাসন করত। এখন আমাকে কেউ কড়া কথা বললে খুব সহজেই মানিয়ে নিতে পারি। সে সময় আমাদের কলোনিতে রাশেদা বেগম নামে কাস্টমসের একজন নারী
সহযোগী কমিশনার ছিলেন। আমি তাকে অনুসরণ করে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে জীবনকে গড়ে তুলতে প্রতিশ্র“তিবদ্ধ হই। তার প্রেরণাকে লালন করে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাই।
আমেনা বেগম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পাস করেন। ১৯৯৯ সালে ১৮তম বিসিএসে (বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন) সম্মিলিত মেধা তালিকায় ষষ্ঠ স্থান অধিকার করেন। এরপর বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিসে যোগদান করেন। চাকরি জীবনে কুমিল্লায় সহকারী পুলিশ সুপার (শিক্ষানবিস) হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে ২০০৫ সালে পদোন্নতি পেয়ে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন ও পরে র্যাব সদর দফতরে যোগ দেন। ২০০৬ সালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে পূর্বতিমুরে বাংলাদেশ আর্মড পুলিশ ইউনিটের ডেপুটি কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সালে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে আমেনা বেগম আন্তর্জাতিক নারী পুলিশ সংস্থার এশিয়া অঞ্চলের সমন্বয়ক পদে নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় মেয়াদেও এ দায়িত্ব পালন করেন। ২০১২ সালে বাংলাদেশের ‘প্রথম এশিয়ান উইমেন পুলিশ কনফারেন্স’ এ সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন। আমেনা বেগম ‘বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন নেটওয়ার্ক’ এরও প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য। তিনি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার (এসপি), এআইজি (হাইওয়ে পুলিশ) এবং পার্বত্য রাঙ্গামাটি জেলার পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পালন করেন। এসব দায়িত্ব পালনকালে ২০১২ সালে ‘আইজেন হওয়ায় ফেলোশিপ’-এর জন্য মনোনীত হন। যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া অঙ্গরাজ্যসহ ১৬টি অঙ্গরাজ্যে, যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ বিভাগ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পুলিশিংয়ের ওপর অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। এছাড়া মেক্সিকো, ইউএসএ, জার্মানি, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ ইউরোপে পুলিশের বিভিন্ন সেমিনারে অংশ নিয়ে বিশ্বে নারী পুলিশ হিসেবে অনবদ্য অবদান রেখে চলেছেন। ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে তিনি নরসিংদী পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি পুলিশ সপ্তাহ-২০১৫-তে দক্ষতার সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব পালনের জন্য বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম) পেয়েছেন তিনি।
নারী পুলিশ সুপার হিসেবে কোনো বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন কিনা জানতে চাইলে তার মতে, আমার অধীনে যারা কর্মরত আছেন, তাদের সঙ্গে কোনো সমস্যা হয় না, কিন্তু উচ্চপর্যায় থেকে একটু চাপ বেশি পড়ে। আমি যদি কাজ করেও বাসায় যাই তাহলেও বলবে নারী বলেই নাকি বাসায় থাকি। এছাড়া নারীদের যোগ্যতা প্রমাণ করার জন্য বেশি কাজ করতে হয়। এ প্রবণতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.