স্বনির্ভরতা হোক বিয়ের পূর্বশর্ত

জেসমিন চৌধুরী: কিছুদিন আগে উইমেন চ্যাপ্টারে আমার ‘ডিভোর্সি নারী মানেই সর্বস্ববিহীন নয়’ লেখাটা ছাপা হবার পর থেকে ইনবক্সে অজস্র মেসেজ পেয়েছি। ডিভোর্সি, ডিভোর্স দিতে ইচ্ছুক বা অক্ষম এমন অনেকে মেসেজ পাঠিয়ে জানিয়েছেন লেখাটা তাদের সাহস দিয়েছে, জীবনকে আলোর পথে নিয়ে যাবার দিক নির্দেশনা দিয়েছে। তারা সকলেই আমাকে জানিয়েছেন তাদের জীবন সংগ্রামের কথা, কেউ প্রচন্ড সাহসের সাথে লড়ছেন, আবার কেউ চারদিকে আঁধার দেখছেন। এই সাহস অথবা সাহসের অভাবের মধ্যে একটা প্যাটার্ন লক্ষ্য করেছি আমি। যেসব নারী শিক্ষিত, নিজে চাকরি-বাকরি করেন, তারা এই জীবন সংগ্রামে অপেক্ষাকৃতভাবে বেশি সফল। তাদের জীবনে নিঃসঙ্গতা আছে, কষ্ট আছে, কিন্তু অসহায়ত্ব নেই। তারা একহাতে হলেও যথেষ্ট স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে সন্তানদের লালন-পালন করতে পারছেন, আত্ম-মর্যাদার সাথে সামাজিক প্রতিকূলতার মোকাবেলা করতে পারছেন, নিজের অধিকার আদায়ের জন্য কোমর শক্ত করে লড়তে পারছেন।
অন্যদিকে যারা বিবাহ বিচ্ছেদের পর অর্থনৈতিকভাবে আত্মীয়স্বজনের উপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়েছেন, তাদেরকে অনেক বেশি ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। সন্তানের চাহিদা পূরণের জন্য অন্যের হাতের দিকে তাকিয়ে থাকতে গিয়ে তাদের নিজের মর্যাদাবোধ আহত হচ্ছে, তাদের সন্তানরা বড় হচ্ছে পরনির্ভরশীলতার বোঝা মাথায় নিয়ে। ফলে নিজের মায়ের প্রতি তো বটেই, নিজের প্রতি, এমনকি জীবনের প্রতিও তারা হয়ে উঠছে বীতশ্রদ্ধ।
সেদিন রাতে ইনবক্সে নক করলেন একজন নারী, বিবাহ বিচ্ছেদের পর পনেরো বছর ধরে ভাইয়ের সংসারে আছেন। সবার কাছেই তিনি অবহেলিত একজন মানুষ, ভাইয়ের দৃষ্টিতে গলগ্রহ, সন্তানদের দৃষ্টিতে অক্ষম। নিজের এই অক্ষমতাকে ঘৃণা করবার মত যথেষ্ট শিক্ষিত তিনি, কিন্তু এই অক্ষমতা দূর করবার জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা তার নেই। এর জন্য কি তিনি নিজে দায়ী? বিয়ে হয়েছিল পড়াশোনা শেষ হবার আগেই, তারপর বিয়ে যখন টিকেনি তখন আর ট্র্যাকে ফিরে যেতে পারেননি। সন্তানরা বড় হয়েছে, তাদের নানান চাহিদা যখন পূরণ করতে পারেন না তখন তারাও তাকে ভুল বোঝে। এখন দিনের শেষে নিজের মুখোমুখি হয়ে আত্মহত্যা ছাড়া আর কোন সমাধানের পথ দেখেন না তিনি।
আমি বিনা প্রয়োজনে ইনবক্সে গল্প করি না কারো সাথে, কিন্তু সেই রাতে ঘন্টাখানেক সময় দিয়েছি এই নারীকে। আত্মহত্যার কথা বলার পর একটা মানুষকে একা ছেড়ে দেয়া যায় না। একটা সুন্দর জীবনের জন্য, ভাল থাকার জন্য একজন নারীকে স্বনির্ভর হতে হবে- এই কথাগুলো পুরোনো হলেও কথাই থেকে গেছে, কাজে পরিণত হতে পারেনি আজো। আমাদের সমাজে মেয়েরা শিক্ষিত হচ্ছে, আয় রোজগারও করছে, কিন্তু একটি মেয়ের জীবনের মূল গন্তব্য এখনো বিয়েই থেকে গেছে। টাকা রোজগারের জন্য না হলেও জীবন যাপনের জন্য মেয়েরা এখনো পুরুষের উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল।
একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে পড়াশোনা শেষে কিছুদিন চাকরি বাকরি করে জীবন অনেকটা গুছিয়ে না নেয়া পর্যন্ত তার বিয়ের কথা ভাবা হয় না, কিন্তু একটি মেয়ের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্যরকম। মেয়ে কুড়ির কোঠা পার হতেই তার বিয়ে নিয়ে জল্পনা কল্পনা শুরু হয়। পড়াশোনা শেষ হবার আগে বিয়ে দিতে পারলে খুশি হন মাবাবা, না পারলে দুশ্চিন্তা করেন।
আমাদের সমাজে এখনো একটি মেয়েকে ছোট থেকে ঘর সংসার এবং সন্তান পালনের জন্যই প্রস্তুত করা হয়। তার শিক্ষা, তার বৃদ্ধি, তার কর্ম প্রচেষ্টা সবই স্বামীর সংসারে সাহায্য করবার জন্য, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য নয়। আমাদের এই সামাজিক প্রক্রিয়া আমাদের অনেক সামাজিক দুর্গতিরও কারণ বটে।
আমাদের নারীরাই শুধু পরনির্ভরশীল, তা নয়। যেসব পুরুষ নিজ হাতে পানি ঢেলে খান না, বৌ বাসায় না থাকলে চা-বিস্কুট খেয়ে থাকেন, তারাও পরনির্ভরশীল বৈকি! নারীকে যেমন বিয়ে করার আগে রোজগারি হতে হয় না, পুরুষকেও রাঁধুনী হতে হয় না। যদি সম্পর্ক টিকে থাকার নিশ্চয়তা থাকতো, তাহলে এই শ্রমবিভাগ বা পারস্পরিক নির্ভরতা হয়তো মন্দ হতো না, কিন্তু যেহেতু পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ নারী-পুরুষের সম্পর্কটি একই সাথে পৃথিবীর সবচেয়ে ভংগুরও, সেহেতু এই নির্ভরতা একসময় হয়ে দাঁড়ায় একটা বড় দায়, এগিয়ে যাওয়ার পথে দাঁড়িয়ে থাকা বিরাট অন্তরায়।
আশৈশব বিয়ের জন্য প্রস্তুত হওয়া একটা মেয়ের বিয়ে যখন টেকে না, তখন সে দিশেহারা হয়ে পড়ে। সে জানে না কিভাবে একা বাঁচতে হবে, কাজেই তাকে কোনো না কোনো পুরুষ আত্মীয়ের আশ্রয়ে যেতে হয়, সহ্য করতে হয় নানা গঞ্জনা। বিয়ে একটা সামাজিক সম্পর্ক, কিন্তু এর ব্যর্থতার দায় হয়ে উঠে একান্তই ব্যক্তিগত, যা নারীকেই বইতে হয়। এটা শুধু নারীর জন্যই নয়, সমাজের জন্য সার্বিকভাবে দুঃখজনক।
কচ্ছপ গতির সামাজিক পরিবর্তনের পথে ঝরে পড়ে আছে অনেক নারীর সুখের স্বপ্ন, বেঁচে থাকার আকাংক্ষা।  সময় এসেছে একটা বিশাল এবং দ্রুত পরিবর্তনের, নারীর জীবন পরিকল্পনায় এবং জীবন-যাপনে একটা বড়সড় আন্দোলনের।
আমি কিশোরী এবং তরুণীদের বলতে চাই, আপনারা ‘না’ বলতে শিখুন। স্বাবলম্বী না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে শব্দটিকে ‘না’ বলুন। নিজেকে জীবন নামের হাইওয়ের জন্য প্রস্তুত করার আগে ড্রাইভিং সিটে বসাটা নেহাতই বোকামি। আগে নিজের পায়ে দাঁড়ান, জীবনকে গুছিয়ে নিন, নিজের মতো করে বাঁচতে শিখুন, তারপর বিয়ের কথা ভাবুন। আমি চাই সমাজে এমন দিন আসবে যখন শিক্ষাগত যোগ্যতার সাথে সাথে স্বাবলম্বিতাই হবে নারীর বিয়ের পূর্বশর্ত।
একটি মেয়ের বিয়ের প্রসঙ্গ উঠলে যখন মানুষ ‘মেয়ে দেখতে কেমন?’ বা ‘রাঁধতে পারে নাকি?’ জিজ্ঞেস না করে ‘মেয়ে কী করে?’ জিজ্ঞেস করবে।
এবং সেরকম একটা আদর্শ সময়ে আমাদের কর্মী পুরুষরাও ঘর সংসার এবং সন্তান পালনে আরো দক্ষ হবেন বলে আশা রাখি, যাতে দু’জনে মিলেমিশে সবদিক সামলে নিয়ে ভাল থাকতে পারেন। আর ধরুন, কিছু গন্ডগোল যদি লেগেই যায়, তখন এই স্বাবলম্বী নারী এবং পুরুষ দু’জনেরই নিজের জীবনে সামলে নেবার ক্ষমতা থাকবে। নারীটিকে ভাইয়ের বাড়ি গিয়ে উঠতে হবে না, আর পুরুষটিকেও হোটেলের ভাত খেতে হবে না, বা একজন রাঁধুনী জোগাড় করার জন্য তাড়াহুড়ো করে বিয়ে করতে হবে না।
নিজের টাকা নিজে রোজগার করতে পারা আর নিজের ভাত নিজে রান্না করতে পারা, দু’টোই যেদিন হবে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য অপরিহার্য বৈবাহিক যোগ্যতা, সেদিন বিয়েগুলো আরো বেশিদিন টিকবে কিনা জানি না, কিন্তু বিবাহ বিচ্ছেদগুলো অপেক্ষাকৃত কম কষ্টকর হবে, এটুকু বলতে পারি।

Leave a Reply

Your email address will not be published.