পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের পাওনা ১৮ হাজার কোটি টাকা

এস কে কামাল॥ বাংলাদেশ পাকিস্তানের নিকট শুধু যে টাকাই পাবে তা কিন্তু নয় তারপরও অন্তত টাকার অংকটা আদায় করা হউক। বাকিগুলো না হয় পর্যায়ক্রমে পাই পাই করে আদায় করা হবে। পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের পাওনা অর্থের পরিমাণ ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে একাত্তরে যুদ্ধকালে সম্পদের সমবণ্টনের হিসাবে পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের পাওনা ৪৩২ কোটি মার্কিন ডলারের অর্ধেক ২১৬ কোটি মার্কিন ডলার। এর সঙ্গে আছে একাত্তরে বাংলাদেশের জন্য বৈদেশিক সাহায্যের ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ অঙ্কই বর্তমান হিসাবে বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৮ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। স্বাধীনতার পর থেকে এ পাওনার বিষয়ে বার বার পাকিস্তানের কাছে দাবি উত্থাপন করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। অবশ্য শুধু টাকার এ অঙ্ক নয়, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের অমীমাংসিত তিন ইস্যুর বিষয়েই কোনো প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে বাংলাদেশের প্রথম দাবি গণহত্যার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা, দ্বিতীয় ক্ষতিপূরণ এবং তৃতীয় দাবি এ দেশে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফেরত নেওয়া। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সূত্র জানায়, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সময় অখন্ড পাকিস্তানের সম্পদের পরিমাণ ছিল ৪ দশমিক ৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। উত্তরসূরি রাষ্ট্র হিসেবে সম্পদের আইনি অংশীদার বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ মনে করে, ১৯৭১ সালের আগে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশ ওই সম্পদের ৫৬ শতাংশ, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবদান বিবেচনায় ৫৪ শতাংশ এবং সমতার নীতি অনুসরণ করলে ৫০ শতাংশের দাবিদার বাংলাদেশ। এ ছাড়া ১৯৭০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, বরগুনা, ভোলাসহ দেশের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকায় গোর্কি নামের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ৫ লাখ মানুষ মারা যায়। নষ্ট হয় শত কোটি টাকার সম্পদ। কিন্তু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার তখন কোনো সহায়তা দেয়নি পূর্ব পাকিস্তানকে। ঘূর্ণিঝড়ের পর পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সাহায্য আসে ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ বিদেশি মুদ্রাগুলো তৎকালীন স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের ঢাকার শাখায় রক্ষিত ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আত্মসাতের উদ্দেশ্যে বৈদেশিক মুদ্রাগুলো স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের লাহোর শাখায় স্থানান্তর করা হয়। এ অর্থ সরাসরি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের কাছে দীর্ঘদিন ধরে জোর দাবি জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ।
জানা যায়, স্বাধীনতার পর সর্বপ্রথম ১৯৭৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের কাছে তিনটি দাবি উত্থাপন করা হয়। দাবি জানানো হয় বাংলাদেশে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনার। ১৯৮১ সালে জাতিসংঘের ঘোষিত ইউনিভার্সাল ডিক্লেয়ারেশন অব হিউম্যান রাইটসে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সবচেয়ে কম সময়ে বেশি গণহত্যা করা হয়েছে। ১৯৯৮ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ঢাকা সফরে এসে একাত্তরকে তৎকালীন সময়ের একটি রাজনৈতিক অস্থিতিশীল ঘটনা বলে আখ্যায়িত করেন। তবে ২০০২ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ ঢাকায় এসে ‘৭১-এর ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। কিন্তু গণহত্যার দায় স্বীকার করেননি। অবশ্য পাকিস্তানের সরকার ক্ষমা না চাইলেও ২০০২ সালে পাকিস্তানের নাগরিক সমাজের ৫১টি সংগঠন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের জনগণের কাছে ক্ষমা চায়। সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ঘটনার জন্য পাকিস্তান সরকারের বাংলাদেশের কাছে আরও আগেই ক্ষমা চাওয়া উচিত ছিল।
পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের আরেকটি দাবি, আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফিরিয়ে নেওয়ার। ২০০৬ সালে জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) সমীক্ষা অনুযায়ী সে সময় বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানির সংখ্যা ছিল প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার। গত চার দশকের মধ্যে নওয়াজ শরিফের সরকার সৌদি আরবভিত্তিক জামাতুদ-দাওয়ার অর্থায়নের মাধ্যমে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফিরিয়ে নেওয়ার একটি প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। বাংলাদেশে বসবাসরত পাকিস্তানিদের নিজ দেশে পুনর্বাসন করার জন্য নওয়াজ শরিফ সরকার একটি পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করেছিল, যেখানে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের আটটি জেলায় ১০ মিলিয়ন রুপি ব্যয়ে ৫ হাজার ইউনিটের একটি আবাসন প্রকল্প তৈরির ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু জামাতুদ-দাওয়া অর্থায়ন বন্ধ করে দেওয়ার পর আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফিরিয়ে নেওয়াও থেমে যায়। যদিও এর আগেই পাকিস্তানের পাঞ্জাব ও সিন্ধুর জনগণ বিহারিদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে বিরোধিতা করে।
২০০৪ সালের জানুয়ারি মাসে লাহোর হাইকোর্ট এক ঘোষণায় বলে, বাংলাদেশে যেসব পাকিস্তানি বসবাস করছে তারা বাংলাদেশের নাগরিক। কর্মকর্তারা জানান, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, বিশেষ করে সিমলা চুক্তির পর পাকিস্তানের কাছ থেকে পাওনা আদায়ের চেষ্টা করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ নিয়ে উদ্যোগী হয়েছিলেন। অনেকটা গুছিয়েও এনেছিলেন। তার সময়ই পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় বাংলাদেশের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কূটনৈতিক দূরদর্শিতাতেই ১৯৭৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় পাকিস্তান। কিন্তু ‘৭৫ সালে তাকে সপরিবারে হত্যার পর এগুলো আর তেমনভাবে এগিয়ে যায়নি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সম্প্রতি জাতীয় সংসদে লিখিত প্রশ্নোত্তরে বলেছেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৭১ এবং এর পূর্ববর্তী  সব দেনা-পাওনার ন্যায্য হিস্যা আদায়ের লক্ষ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দ্বিপক্ষীয় বৈঠকগুলোতে দাবি জানিয়ে আসছে। ওসব বৈঠকের মধ্যে ১৯৭৭, ১৯৮০, ১৯৮৯, ১৯৯২, ১৯৯৭, ২০০৩, ২০০৪, ২০০৫, ২০১০ এবং ২০১২ সালের বৈঠক অন্যতম। এসব আনুষ্ঠানিক বৈঠক ছাড়াও পাকিস্তানের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠকেও সম্পদের হিস্যাসহ তিনটি অমীমাংসিত বিষয় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উত্থাপন করা হয়।
কূটনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ অনুসারে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদে ক্ষমতায় আরোহণের পর ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের নতুন নেতৃত্বকে শুভেচ্ছা জানাতে ঢাকা এসেছিলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত। জিয়া এম ইস্পাহানিকে বাংলাদেশের তিন দাবির কথা স্পষ্টই জানিয়ে দেন তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। সে বছর একই কথা জানানো হয় ঢাকার পাকিস্তানের হাইকমিশনার আলমগীর বাশার খান বাবরের কাছে। পরের বছর ২০১০ সালে ইসলামাবাদে পররাষ্ট্র সচিবদের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকেও বাংলাদেশের দাবির কথা পুনরায় উল্লেখ করা হয়। আর সর্বশেষ ২০১১ সালেও ঢাকায় পাকিস্তানের নতুন হাইকমিশনার আফরাসিয়াব মেহদি হাশমি কুরেশির কাছেও পাকিস্তানকে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানানো হয়। পরে ২০১২ সালে পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানি খার ঢাকায় এলে বাংলাদেশের দাবির কথা জানানো হয়। তখন হিনা রাব্বানি একাত্তরকে ভুলে যাওয়ার পরামর্শ দেন। এরপর আর তেমন আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ শুরু করে পাকিস্তান। শুরু হয় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে উত্তেজনা। সর্বশেষ চলতি মাসেই ঘটে পাল্টাপাল্টি হাইকমিশনারকে তলবের ঘটনা। বর্তমান সময়ে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে। এরই মধ্যে পাকিস্তান দাবী করে বসেছে যে তারা বাংলাদেশের কাছে টাকা পায়। এই যে হাস্যকর দাবী মনে হলেও তাদের আস্পর্ধা দেখে হতবাক হয়েছি। আমাদের সারাদেশ বাসী হতবাক হয়ে বলতে চাচ্ছি আমাদের ন্যায্য হিস্যাগুলি আগে পরিশোধ কর তারপর তোমাদের হটকারী কথা বল বা বলা থেকে বিরত থাক। আর এর ব্যর্তয় ঘটছে এর সমুচিত জবাব দেয়া হবে সর্বদিক থেকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.