অং সান সূচির সরকার: মানবতা অন্তরীন, মুসলিম রোহিঙ্গা নিধনে উল্লাস

এডভোকেট হারুনুর রশীদ খান॥ তৎকালীন বার্মা বর্তমানে মিয়ানমার, ১৯৪৮ সালে বিট্রিশ উপণিবেশ মুক্ত হয়। কিন্তু বারবার সেনা শাসনে, জনগণ বাক স্বাধীনতা, মৌলিক অধিকার, নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবন যাপনে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। স্বাধীন মিয়ানমারের জেনারেল অং সানের কন্যা, অং সান সূচি মানবিক দৃষ্টিতে জনগণের নাজুক অবস্থা অবলোকন করেন।
অং সান সূচী ও তার দল, বার্মার প্রায় ১৩৫টি জাতি গোষ্ঠি মুক্ত করতে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সামকি সরকার উৎখাতের সংগ্রামে লিপ্ত হয়। জান্তা সরকার, সূচি ও দলের নেতা কর্মীদের উপর দমন পীড়ন শুরু করিলে সংগ্রাম বেগবান হইতে থাকে। সূচী ও তার দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির নীতি ও আদর্শ বিশ্ব- বিবেকের নজর কাড়ে এবং বাস্তবায়নে স্বোচ্ছার ভূমিকা পালন করে। অং সান সূচী মানবতাবাদী নেত্রী হিসেবে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী স্বীকৃতি লাভ করে।
নরওয়ের রাজধানী অসলোতে নোবেল পুরস্কার হাতে নিয়ে ২০১২ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠানে অং সান সূচীর বক্তব্য, তিনি অন্তরীন থাকাকালো জাতিসংঘের মানবাধিকার অনুচ্ছেদে বর্ণিত মানবাধিকার প্রত্যাখ্যান ও ঘৃণার বিশ্বে বর্বরতার বিকাশ ঘটে, তা হতে মানুষের বিবেকে জেগে উঠে প্রবল প্রতিরোধে। সেই হতে মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণা, যাহা এমন এক বিশ্ব ব্যবস্থার প্রতি সমর্থন, যাহা প্রত্যেকে বাক স্বাধীনতা , ধর্ম বিশ্বাস পালন, মৌলিক অধিকার ভোগ করবে, সকল ভয়ভীতির উর্ধ্বে থেকে। যেখানেই মানবতা লঙ্গন, সেখানেই মানবাধিকার রক্ষায় সর্বাত্মকভাবে সচেষ্ট থাকবে।
সেই বক্তব্য তিনি হয়তো ভুলে-ই গেছেন। অং সান সূচির ঘোষিত গভণতান্ত্রিক শাসক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বিশ্ব বিবেকের, জাতিসংঘ, সকল সংস্থা স্বোচ্ছার ভুমিকা পালন করায়, সামরিক সরকার, সূচির মুক্তি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। জাতীয় নির্বাচনে সূচির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমেক্রেসি ঐতিহাসিক বিজয় পেয়ে সরকার গঠন করেন।
বিশ্ববিবেক আত্মতৃতিপ্ত লাভ করে, অং সান সূচিকে গণতন্ত্রের মানস কন্যা খ্যাতিতে ভুষিত করেন। বৃহৎ ক্ষুদ্র ধর্ম-বর্ণের জনগোষ্ঠি আনন্দে উদ্ভাসিত হয়। সামরিক সরকার কর্তৃক নির্যাতিত হয়ে দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়ে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয় মানবিক বিবেচনায় শরনার্থী। অং সান সূচী সরকার ােহিঙ্গাদের বিষয়ে বাস্তবমুখী নীতি প্রণয়নে বৃহৎ ক্ষুদ্র সকল জাতি গোষ্ঠির বাক – স্বাধীনতা, মৌলিক অধিকার প্রদান, ধর্মীয় স্বাধীনতা পালন নিশ্চিত করিবেন। সেই আশায় আনন্দের স্বপ্নে ভাসে।
দূর্ভাগ্যের বিষয়, ৯ই অক্টোবর উশৃঙ্খল উগ্রপন্থীরা রাখাইন সীমান্তে কয়েকটি পুলিশ ফাঁড়িতে সন্ত্রাসী হামলা চালালে ৯ জন পুলিশ সহ ১৪ জন নিহত হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১০ই অক্টোবর সামরিক বাহিনীর পুলিশ, বর্ডার গার্ড সদস্য একদল ধর্মান্ধ উশৃঙ্খল ও সন্ত্রাসী নিয়ে একযোগে একটি ক্ষুদ্র রোহিঙ্গা মুসলিম জাতিগোষ্ঠী নিধনে ১২টি গ্রামের উপর চিরুনি অীভযানের নামে নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষন, লুন্ঠন, বাড়ী ঘর আগুণে পুড়ানোসহ জঘন্যতম অমানবিক কার্য চালাইতে থাকে। আগ্নেয়াস্ত্রসহ উপর দিয়ে হেলিকপ্টার গানশিপ ব্যবহার করে নারী, পুরুষ, শিশু, কিশোর হত্যা করে।
মানবাধিকার রক্ষায় জাতিসংঘ জাতিসংঘের সাবেক সাধারণ সম্পাদক কফি আনান কে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি সঠিক তথ্য উদঘাটন ও হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে গেলে, মিয়ানমার সরকার সহযোগীতায় অনিহা লক্ষ করা যায় জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার নামে ধ্বংসযঞ্জ চালাইতে থাকে।
অং সান সূচি বিগত ০৩/১২/১৬ইং সিঙ্গাপুর টেলিভিশনে এক সাক্ষাৎকারে চলমান নিশংস ঘটনা এড়িয়ে গণমাধ্যমকে অতিরঞ্জিত বলে অভিযোগ করেন। আপনি জাপানে গেলে রোহিঙ্গা মুসলিম হত্যা, নির্যাতন, বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে প্রকৃত ঘটনা আড়াল করে জাতীয় নিরাপত্তার সুরক্ষার ইঙ্গিত দেন। যাতা অত্যন্ত নিন্দনীয় ও অমানবিক।
একটি ক্ষুদ্র মুসলিম জাতিগোষ্ঠী নিধন, নৃশংস হত্যা, নির্যাতন সম্পর্কে মালয়েশিয়া সত্য তথ্য প্রকাশ করায়, আপনার সরকার মালয়েশিয়া লোকবল না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। আমার বিশ্বাস জাতিসংঘের সনদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো আপনার দেশ থেকে লোকবল না নেওয়ার সিদ্ধান্তই হবে সচেতন বিশ্ব বিবেক। যতক্ষণ পর্যন্ত এই গণহত্যার বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত না হবে।
আপনি, জানেন বার্মা ১‘৯৪৮ সালে জাতিসংঘের গৃহিত গণহত্যা বিরোধী অনুচ্ছেদে উল্লেখিত কোন জাতি বা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অংশ তথা সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্নের জন্য গৃহীত ব্যবস্থা গনহত্যা বা জেনোসাইড বলে পরিগণিত হইবে। এই চুক্তিতে প্রথম স্বাক্ষরকারী দেশ মিয়ানমার সেই চুক্তির শর্ত ভঙ্গড় করে একটি ক্ষুদ্র ধর্মীয় জাতি গোষ্ঠিকে নিধনে উল্লাস চলছে যা গণহত্যা নামে স্বীকৃত।
বার্মা সরকার ১৯৭৭-৭৮ ও ১৯৯১-৯২ সালে রোহিঙ্গাদের নির্মূল করতে অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছিল। ২০১২ সালে একই কায়দায় রোহিঙ্গা জাতি গোষ্ঠি ধ্বংসে বর্বরোচিত নিশংস হত্যাকান্ড নির্যাতন চালায়। বর্তমান সরকার জাতীয় নিরাপত্তার নামে একটি খোড়া অজুহাতে রোহিঙ্গা জাতি গোষ্ঠির  নিধনে উল্লাস করছে।
সাবেক সামরিক রষ্ট্র প্রধান থেইন সেইন যিনি ধর্মীয় স্বাধীনতার নামে উগ্র, উশৃঙ্খল মানবতা বিরোধী নেতা ভিরাথুকে এক শান্তির প্রতীক, “ভগবান বৌদ্ধের সন্তান” বলে অভিহিত করেন। বর্মীরা ভিরাথুকে সর্ববৃহৎ উপসনালয় সাসানা রামসি ধর্মীয় স্বাধীনতায় অবদানের জন্য বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করেন। যাহা বিশ্বে ধর্ম-বর্ণ শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থানের ক্ষেত্রকে অশান্ত করার প্রক্রিয়া।
সরকারের হত্যাযজ্ঞ থেকে বাঁচতে বিভিন্ন সময়ে অীধকাংশ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে, বর্তমানে বহু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে, সরকার জাতিসংঘ, অন্যান্য সংস্থার সমন্বয়ে মানবিক বিবেচনায় ব্যায়ভার বহন করে চলেছে।
বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক অনুরোধ স্বত্ত্বেও শরনার্থীদের আশ্রয় দিতে অস্বীকৃত জানায় ১৯৬৭ সালে শরনার্থী বিষয়ক কনভেশন বা প্রটোকলে স্বাক্ষর করেনি। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের জীবন রক্ষায় শরনার্থী শিবির খুলতে বাধ্য নয়। তবু জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক পর্ষদ, বহু রাষ্ট্রের অনুরোধ এবং বাংলাদেশ সরকার মানবতা ও নৈতিক দায়বদ্ধতা থেকে অনুপ্রবেশকারীদেরকে জীবন নির্বাহের জন্য শরনার্থী শিবির খুলছে।
তবে বিশ্ববাসী জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংস্থা বা রাষ্ট্রের প্রতিনিধিগণের সমন্বয়ে মিয়ানমার সরকার একটি জাতি গোষ্ঠি নিধন, ধর্ষন সহ সকল অমানবিক নির্যাতন বন্ধ এবং তাদের মিয়ানমারে ফিরাইয়া নেওয়া ও অধিকার ভোগ নিশ্চিত, জাত-ধর্ম বর্ণের পুর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে বিশেষ ভ’মিকা পালন একান্ত কাম্য।
বৌদ্ধ ধর্মে আদর্শ, “জীব হত্যা মহা পাপ” সরকারের মদদে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ নিধনে উল্লাস চলছে। বৌদ্ধ ধর্মের মূল আদর্শের আলোকে এবং মানবতার প্রতি সম্মান অতীব জরুরী। আপনার সরকার মানবতাকে বন্দী রেখে একটি ক্ষুদ্র মুসলিম জাতি গোষ্ঠিকে উদ্দেশ্যমূলক নিধন করিতেছে। যাহা ইতিহাসে গনহত্যা নামে অভিহিত হবে। বৌদ্ধ ধর্মের স্বাধীনতার অপব্যাখ্যায় বিশ্বকে অশান্ত করার ইঙ্গিত বহন করে।
পরিশেষে আমার বক্তব্য: আপনি আর্তপীড়িত নির্যাতিত, শোষিত মানবেতর জীবন যাপনকারী জনগোষ্ঠীকে উদ্ধারের জন্য যুগ যুগ ধরে সংগ্রাম করায়, সামরিক সরকার আপনাকে মানবেতর অবস্থায় অন্তরীন রাখে। বিশ্ব বিবেক, আপনাকে মানবেতর  অন্তরীন থেকে মুক্ত করতে স্বোচ্ছার ভুমিকা পালন করতে থাকলে, সেনা সরকার আপনাকে মুক্তি ও জাতীয় নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। আপনার দল ঐতিহাসিক বিজয় লাভ করে সরকার গঠন ও রাষ্ট্র পরিচালনা করিতেছেন।
মানবেতর জীবন যাপনকারী সকল ধর্ম বর্ণ মানুষের অধিকার ভোগের সুযোগ নিশ্চিত করা আপনার পবিত্র দায়িত্ব। বিশ্ব বিবেকের প্রতি আপনার দায়, কোন খোড়া অজুহাতে এড়াতে পারে না। আপনার সরকার আমলে মানবতা অন্তরীণ, তাহা ভাবতে অবাক লাগে। বিশ্ব বিবেক আশা করে, আপনি শান্তিতে নোবেল বিজয়ী, গণতন্ত্রের মানস কন্যার খ্যাতিতে ভূষিত। আপনি জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার  প্রতিনিধি ও গুরুত্বপূর্ণ পর্ষদগুলোর সাথে আলোচনান্তে জাতিসংঘের সনদে বিধি মোতাবেক রোহিঙ্গাদেরকে পার্শ্ববর্তী দেশ সম্মুখ, ঝোপ জঙ্গল, হতে ফিরাইয়া নিয়া তাদের  মৌলিক অধিকার, সকল সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত  করন এবং সকল জাতি গোষ্ঠি নিজ নিজ ধর্মে কর্মে স্বাধীনতা নিশ্চিত করবেন, সেই প্রতীক্ষায় অপেক্ষমান। মো: হারুনুর রশিদ খান, সিনিয়র এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ( হাইকোট বিভাগ), ঢাকা; সাবেক সভাপতি, ডিষ্ট্রিক্ট বার এসোসিয়েশন (দুইবার); সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ডিষ্ট্রিক্ট বার এসোসিয়েশন; সাবেক স্পেশাল পি পি, নারী ও শিশু নির্যাতন (দমন) ট্রাইব্যুনাল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

Leave a Reply

Your email address will not be published.