শাহিনুর কাঁদলেন; কাঁদালেন সবাইকে

টিআইএন॥ হঠাৎ করেই হোটেল সোনারগাঁওয়ের বলরুমে পিনপতন নীরবতা। মঞ্চের ডায়াসে থেমে থেমে কথা বলছেন এক নারী। ব্যথায় তার হাত দুটো তুলতে পারছেন না। তিনি জানান, পরিবারের অভাব দূর করতে স্বপ্ন নিয়ে বিদেশযাত্রা করেছিলেন। দালালের খপ্পরে পড়ে নানা হাতে বিক্রি হয়ে নির্যাতনের শিকার হতে হতে অবশেষে ‘মৃত্যুপথে’র যাত্রী হয়ে ফিরেছেন দেশে। বিদেশে নিজের ওপর নির্মম নির্যাতনের বিবরণ দিতে গিয়ে কাঁদছিলেন শাহিনুর বেগম নামের ওই নারী। তার মুখে মধ্যযুগীয় বর্বরতার লোমহর্ষক ঘটনা শুনে মঞ্চের সামনের লোকজনও চোখের পানি মোছেন।
২০১৪ সালে গৃহকর্মী হয়ে লেবাননে যাওয়ার কথা ছিল পটুয়াখালীর ওই নারীর। সব কিছু বিক্রি করে গ্রাম্য দালালকে টাকা দেন তিনি। তবে প্রতারিত হন তিনি। পরে তাকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে দুবাইতে পাঠায় মানব পাচারকারী চক্র। সেখান থেকে সিরিয়ায় তাকে বিক্রি করে দেওয়া হয় আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারীর কাছে। সেখানে তাকে বিক্রি করে দেওয়া হয় এক পতিতালয়ে। সাত মাস পর মৃত্যুকূপ থেকে র্যাবের সহায়তায় তিনি ফিরে আসেন দেশে।
গত শনিবার দুপুরে সোনারগাঁও হোটেলে ‘নিরাপদ অভিবাসন এবং মানব পাচার প্রতিরোধ’ শীর্ষক সেমিনারে নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতার বিবরণ দেন শাহিনুর। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিত্রুটিং এজেন্সিজ (বায়রা) ও র্যাব এ সেমিনারের আয়োজন করে।
সেমিনারের শুরুতেই মঞ্চে ডাকা হলে শাহিনুর বলেন, তার দুটি শিশু সন্তান রয়েছে। স্বামী ছেড়ে চলে যাওয়ায় তিনি শিশু সন্তানদের মানুষ করতে চাকরি খুঁজছিলেন। ওই সময়ে গ্রামের একজন লোক তাকে বিদেশে চাকরি দিতে চান। পরিবারের অভাব দূর করতে তিনি বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বিদেশ গিয়ে জানতে পারেন তাকে সিরিয়ায় বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। যার কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে সিরিয়ার ওই মালিক তাকে চাবুক দিয়ে পেটাতো। তাকে এক পায়ে দাঁড় করিয়ে শাস্তি দেওয়া হতো। নানা অজুহাতে তাকে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হতো। অসুস্থ হয়ে পড়লে ওই মালিক তাকে অন্যত্র বিক্রি করে দেয়। সেখানেও চলে অকথ্য নির্যাতন। কোনো খাবার দেওয়া হতো না। কয়েকদিন ধরে পানি খেয়ে থেকেছেন।
দেশে ফিরে আসার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, একদিন তাকে অচেতন অবস্থায় চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসক দুটি কিডনিই নষ্ট হয়েছে বলে প্রতিবেদন দেন। ওই সময় তিনি দেশে তার মায়ের কাছে সব ঘটনা জানিয়ে তাকে দেশে ফিরিয়ে নিতে বলেন। এরপর তার মা সেই দালালের কাছে গেলে দালাল ফিরিয়ে আনতে তিন লাখ টাকা দাবি করে। পরে স্বজনরা র্যাব-৩-এ যোগাযোগ করলে তারা তাকে সিরিয়া থেকে ফিরিয়ে আনে। তার মতো যেন কেউ বিদেশ গিয়ে এমন ঘটনার শিকার না হন সেই দাবি জানান শাহিনুর।
তার বক্তব্য শোনার পর অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আমরা এমন নির্যাতনের আর কোনো ঘটনা শুনতে চাই না। বাংলাদেশের একজন নারী বিদেশে গিয়ে নির্যাতিত হবেন, এটা কোনোভাবেই মানা যায় না। এ ধরনের খবর আমাদের কষ্ট দেয়।
অনুষ্ঠানে র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছে তখন একজন বাংলাদেশি নারী বিদেশ গিয়ে এমন নির্যাতনের শিকার হবেন তা মেনে নেওয়া যায় না। মানব পাচারকারীরা দেশের শত্রু।
সব বক্তব্য শুনে বায়রার মহাসচিব রুহুল আমিন স্বপন ওই নারীর সব ধরনের চিকিৎসার খরচ বহনের ঘোষণা দেন। ওই সেমিনারে শাহিনুর ছাড়াও পাচারের পর দেশে ফিরে আসা ফরিদপুরের মোহিত মোল্লাও বিদেশে তার ওপর চালানো নির্মম নির্যাতনের বিবরণ দেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published.