বঙ্গবন্ধুর কারাগারের রোজনামচা…শেখ হাসিনা

বাআ॥ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারাগারের স্মৃতি কথা নিয়ে ‘কারাগারের রোজনামচা’ নামের যে বইটি আমরা বের করেছি এটা দ্বিতীয় বই। এর পূর্বে আমরা বের করেছি ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। কারাগারের এই বইটির উৎস বঙ্গবন্ধুর লেখা অনেকগুলো খাতা। তার মধ্যে একটি খাতা বহু বছর পরে খুঁজে পাওয়া, এটা আমি আমার লেখায় তুলে ধরেছি। জেলখানায় এই খাতাটা বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং সেই তথ্যটা পেয়েছিলাম এসবির রিপোর্ট থেকে। ’৯৬ সালে যখন সরকার গঠন করি তখন এসবির রিপোর্টগুলো নিয়ে এসে সেগুলো ফটোকপি করে রেখে দিই এবং সেখান থেকে জাতির পিতার জীবনের অনেক তথ্য জানতে পারি। সেখানেই জানতে পারলাম যে, দু’খানা খাতা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
তো দ্বিতীয়বার যখন সরকারে আসলাম তখন আমি এসবিকে দায়িত্ব দিয়ে বলেছিলাম, এই খাতাটা আমাকে খুঁজে বের করে দিতে হবে। এসবির কর্মকর্তারা সবাই এ জন্য কষ্ট করেছেন এবং ২০১৪ সালে সেই খাতাটা আমি পেলাম যে খাতাটায় বঙ্গবন্ধু নিজেই নাম দিয়ে গেছেন। এই খাতায় লিখেছিলেন, ‘থালাবাটি কম্বল জেলখানার সম্বল’। খাতাটা যে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল তা লেখা আছে মলাটের উপরে ‘Criticism of Jail Administration’ এবং সেই কারণে এটাকে বাজেয়াপ্ত করা হয়। এত বছর পরে এই খাতাটা পাওয়া যায়। আর বাকি যে খাতাগুলো আমার লেখার মধ্যে আমি লিখেছি, কীভাবে এগুলো আমরা পেয়েছি।
আমার মায়ের কথা বারবার মনে পড়ে। আমার মা সব সময় যখনই বাবা গ্রেফতার হতেন তিনি লেখার জন্য খাতা দিতেন এবং পড়ার যে বইগুলো দিতেন সেগুলো আবার তিনি সবসময় সংগ্রহ করতেন এবং সংরক্ষিত করতেন এবং বারবার উৎসাহ দিতেন লেখার জন্য। আর এই খাতাগুলো অত্যন্ত সযতনে রেখে দিতেন।
কাজেই সেই খাতাগুলো ফিরে পাওয়া একটা অদ্ভুত ব্যাপার ছিল। ’৭১ সালে খাতাগুলো উদ্ধার করি। ’৭১ সালে ওই বাড়ি সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দখলে ছিল এবং কীভাবে উদ্ধার করেছি আমার ভূমিকায় আমি তা লিখেছি, আর পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। ’৭৫ সালে বাবা, মা, ভাই, বোন সবই হারিয়েছি। ওই বাড়িতে এমন একজন কেউ ছিল না যে, কেউ কিছু বলতে পারে। আর আমরা দুই বোন ছিলাম বিদেশে। দীর্ঘ ছয় বছর পর ফিরে আসি। প্রথমে তো আমাকে ওই বাড়িতে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি। তারপরে যখন আমি যেতে পারি প্রথমেই আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। এরপরে যখন আমার একটু হুঁশ হলো, আমার শুধু মনে হচ্ছিল মায়ের হাতে রাখা ওই খাতাগুলো কীভাবে উদ্ধার করা যায় এবং আমি কিন্তু ওই বাড়ি থেকে ওই সময় শুধু ওই খাতা কয়টাই নিয়ে এসেছিলাম, আর কিছুই নেওয়ার মতো ছিলও না, মনও ছিল না। কারণ চারদিকে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ, সেই অবস্থার মধ্যে আমাকে দেখতে হয়েছে ধুলাবালি মাখা সব জালের মধ্য দিয়ে, তখন এই খাতাগুলো নিয়ে আসি।
কারাগারে লেখা খাতাগুলোর একটি লেখা ১৯৬৮ সালে, যা কারাগারে উনার শেষ লেখা। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ১৮ জানুয়ারি তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং এরপরেই আগরতলা মামলা হয়। ৫ মাস পরে তিনি এই খাতাটা পান। কারণ মামলা শুরু হওয়ার পরে খাতাটা তার হাতে দেওয়া হয়েছিল। তো সেখানে খুব অল্পই লেখা আছে। কিন্তু ওই খাতাটা নিয়েই মনে আমার একটা স্মৃতি রয়ে গেছে সেটুকুই শুধু আপনাদের কাছে আমি আজকে বলতে চাই।
জানুয়ারি মাসের পর থেকে আমরা জানতাম না উনি কোথায় আছেন, কীভাবে আছেন, বেঁচে আছেন কিনা— কিছুই জানতে পারিনি। কোনো খবর আমরা জানতাম না। কিন্তু ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তাঁকে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। যখন মামলা শুরু হলো সেই কোর্ট ছিল ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে। তখনই প্রথম তাঁর সঙ্গে দেখা হলো। এরপরে আমরা মাঝে মাঝে সাক্ষাৎকারের অনুমতি পেতাম। উনাকে অফিসার মেসে রাখা হতো। সেই জায়গাটা এখন একটা মিউজিয়ামের মতো করে রাখা হয়েছে। আমাদের সেনাবাহিনী ওটাকে মিউজিয়াম হিসেবে রেখেছে। অনেকে ইচ্ছা করলে যেতে পারেন। যে ঘরে তিনি থাকতেন সেখানে একটা খাট ও দুটো চেয়ার ছিল। আমি যখন যেতাম খাটে বসতাম। একদিন আমি খাটে বসে হঠাৎ দেখি বালিশের নিচে একটা খাতা। তো আমার কী মনে হলো, আমি আস্তে খাতাটা বের করে পড়তে শুরু করলাম।
আমি যখন পড়তে শুরু করলাম তখন আব্বা আর মা পাশাপাশি চেয়ারে বসে, আব্বা এই জিনিসটা লক্ষ্য করলেন। উনি উঠে এলেন। আস্তে আমাকে জড়িয়ে ধরে কোনো বকাও দিলেন না, কিচ্ছু বললেন না, শুধু হাত থেকে খাতাটা নিয়ে নিলেন। নিয়ে শুধু এটুকুই বললেন, এখন পড়বি না, আমার মৃত্যুর পরে পড়বি। আমার হাত থেকে তিনি খাতাটা নিয়ে রেখে দিলেন।
’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পরে যখন এ খাতাগুলো হাতে পেলাম, সত্যি কথা বলতে কি এগুলো পড়া আমার জন্য খুব কষ্টের ছিল। আমার বান্ধবী ছিল বেবী, ও সবসময় আমার পাশে থাকত, সাহায্য করত। কিন্তু খাতাগুলো যখন পড়ব, কেন যেন সাহসই পেতাম না। আর বারবার বাবার সেই কথাটা মনে পড়ত। যাই হোক, আমরা এগুলো বই আকারে বের করতে পেরেছি এবং সবার হাতে তুলে দিতে পেরেছি। হয়তো ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বাংলাদেশে যদি থাকতাম আমরা দুই বোনও বেঁচে থাকতাম না।
বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ। একজন মানুষ তার জীবনে সংগ্রাম করে দুটি দেশ স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন। একটা হলো পাকিস্তান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়লে আপনারা দেখবেন যে, পাকিস্তান অর্জনের পেছনে তাঁর কী অবদান রয়েছে। আর যখন তিনি উপলব্ধি করলেন যে, পাকিস্তানের অধীনে বাংলাদেশের মানুষ শোষিত, বঞ্চিত, বাংলাদেশের মানুষের কোনো অধিকার নেই; বাংলাদেশের মানুষের টিকে থাকা সম্ভব নয়; তখন তিনি বাঙালির মুক্তির জন্য সংগ্রাম করলেন।
আমরা আমাদের জীবনে একটানা দুই বছরও বাবাকে কাছে পাইনি। তবে, আমার মা অত্যন্ত সাহসী ছিলেন আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তাঁর ছিল বিরাট অবদান। তিনি নিজের ব্যক্তিগত জীবনে কিছুই চাননি। কিন্তু সবসময় বাবার কাজে সহযোগিতা করেছেন এবং আমাদেরও সেভাবে গড়ে তুলেছেন। এই বইয়ের একটি জায়গায় তিনি লিখেছেন— “৮ই ফেব্রুয়ারি দু’বছরের ছেলেটা এসে বলল, আব্বা বাড়ি চল। কী উত্তর ওকে আমি দেব। ওকে ভুলাতে চেষ্টা করলাম, ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দী। ওকে বললাম, তোমার মার বাড়ি তুমি যাও, আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো। ও কি বুঝতে চায়? কী করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ, আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলে-মেয়েরা বুঝতে শিখেছে, কিন্তু রাসেল এখনও বুঝতে শেখে নাই। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে। ”
ছোটবেলায় আব্বার সঙ্গে দেখা তো জেলখানায়ই হতো। যখন জামাল ছোট, এরপরে রেহানা, তারপরে রাসেল, আমি আর কামাল একটু বড় ছিলাম। আমরা জানতাম যে, আমার বাবা দেশের মানুষের জন্য কাজ করে। তাই, আমাদের কোনো আবদার কোনো কিছু বাবার কাছে ছিল না বরং যতটুকু সময় উনি বাইরে থাকতেন স্নেহ, ভালোবাসা দিয়ে এমনভাবে আমাদের ভরিয়ে দিতেন যে, আমরা না পাওয়ার বেদনাটা ভুলে যেতাম। এত আদর, এত ভালোবাসা কোন সন্তান পায় তা আমরা জানি না। যা হোক, আমার জীবনের এটুকুই সার্থকতা যে, এত ঝড়-ঝঞ্চা, এত কিছুর পরেও উনার লেখাগুলো আমরা খুঁজে পেয়েছি। বাংলাদেশের মানুষকে তিনি ভালোবেসেছেন। তাঁর জীবনের সবকিছু বাংলাদেশের মানুষকে ঘিরে। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন যে, এদেশের মানুষকে তিনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন।
ডেবিট ফ্রস্ট যখন জিজ্ঞাসা করেছেন, আপনার কোয়ালিফিকেশন কী? উনি বলেছেন, আমার দেশের মানুষকে ভালোবাসা। যখন জিজ্ঞাসা করেছেন, ডিসকোয়ালিফিকেশন কী? বললেন, দেশের মানুষকে আমি অতিরিক্ত বেশি ভালোবাসি। বাংলার মানুষকে একটা সুন্দর জীবন তিনি দিতে চেয়েছিলেন। বাংলার মানুষের স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন, একটা রাষ্ট্র দিয়ে গেছেন, আত্মপরিচয়ের সুযোগ দিয়ে গেছেন কিন্তু মানুষকে মানুষের মতো বাঁচার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য যখনই পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তখনই তাকে আর সময় দেওয়া হয়নি।
স্বাধীনতার পর একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ— যে দেশটা ছিল একটা প্রদেশ। ঔপনিবেশিক শক্তির দ্বারা যে দেশটি শাসিত হতো। এরপর পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শক্তি দ্বারা শাসিত সেই দেশের শাসনভার পেয়ে ’৭২ সালে অল্প সময়ের মধ্যে একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তোলা— এটা এত সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু এখন আমার মাঝে মাঝে এটাই দুঃখ হয় যে, তখনো তো কেউ সময় দেয়নি। অনেকেই তো কত সমালোচনা— এটা হলো না, ওটা হলো না। ধৈর্য নেই, নানা ধরনের কথা। অনেকে বঙ্গবন্ধুর সমালোচনা করতে করতে সেই স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি তাদের হাতকেই যেন শক্তিশালী করে দিল। এখনো আমার মাঝে মাঝে এটাই মনে হয় যে, এই যে তাঁর বিরুদ্ধে নানা সমালোচনা, নানা কথা লেখার মধ্য দিয়ে তাঁর জীবনটাকে কেড়ে নেওয়ার পথটা অর্থাৎ ১৫ আগস্টের ঘটনা ঘটানোর একটা যেন পটভূমি তৈরি করে দিয়েছিল অনেকেই।
পরবর্তীকালে হয়তো তারা উপলব্ধি করতে পেরেছেন, কী তারা হারিয়েছিলেন। আর এই বই পড়ার মধ্য দিয়ে— ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’— এই দুটি বই পড়ার মধ্য দিয়ে অন্তত বুঝতে পারবেন যে, একটি মানুষ একটি দেশকে ভালোবেসে দেশের মানুষের জন্য কত ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন। জীবনের কোনো কিছু কোনো চাওয়া-পাওয়া রাখেননি। শুধু এদেশের মানুষকে তিনি কিছু দিয়ে যেতে চেয়েছেন। রাষ্ট্র দিয়ে গেছেন, আত্মপরিচয়ের সুযোগ দিয়ে গেছেন, ঠিকানা দিয়ে গেছেন। সব সময় তিনি রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা আবৃত্তি করতেন,
‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই।
নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই। ’
উদাত্ত কণ্ঠে এই কথা, উচ্চারণটা সবসময় করতেন। আজকে সেটাই তাঁর জীবনে বাস্তব হলো। নিঃশেষে প্রাণটা দিয়ে গেলেন কিন্তু তাঁকে যারা ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল তারা তা পারল না। তিনি সেই ইতিহাসে আবারও ফিরে এসেছেন এবং এই বাংলার মাটিতে আবার ফিরে এসেছেন যে, তাঁর বাংলাদেশ, তাঁর সোনার বাংলাদেশ।
আজ আমার তথা আমাদের, একটাই কাজ বাংলাদেশকে তাঁর সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলা। সেটুকুই শুধু করে যেতে চাই যতটুকু পারি। তাঁর দুঃখী মানুষের মুখে যেন হাসি ফুটিয়ে যেতে পারি। যখনই একটু কাজ করি, যখন কোনো ভালো কাজ হয় তখন কেবল এটুকু মনে হয় যে, আমার আব্বা আজ বেঁচে নেই, উনি থাকলে বহু আগেই তো বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ সত্যি উন্নত জীবন পেত। কিন্তু আজকে তিনি বেঁচে নেই। যদি একটু ভালো কাজ করি নিশ্চয়ই তাঁর আত্মা তো শান্তি পাবে। তিনি নিশ্চয়ই দেখেন, নিশ্চয়ই জানেন, তিনি নিশ্চয়ই এটা উপলব্ধি করতে পারেন।
আমি এটুকুই বলব যে, বঙ্গবন্ধুর এই লেখার মধ্য দিয়ে অনেক কিছু জানতে পারবেন। তবে এখানেই শেষ না, তাঁর লেখা আরও আছে। সেগুলোও আমরা ধীরে ধীরে প্রকাশ করব এবং সেগুলোও মোটামুটি প্রস্তুত এবং যেহেতু ২০২০ সালে জন্মশতবার্ষিকী, এই জন্মশতবার্ষিকীর মধ্যেই এ লেখাগুলো সব আমরা প্রকাশ করব।
বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে লেখা এসবির রিপোর্ট আমাদের হাতে রয়েছে। বহু নেতার বিরুদ্ধে এসবির রিপোর্ট আছে। কিন্তু আপনারা অবাক হবেন যে, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে প্রায় ৪৮ খানার মতো ফাইল যেখানে ৩০-৪০ হাজার পাতা তাঁর বিরুদ্ধেই লিখেছে। কিন্তু সেই বিরুদ্ধ লেখার মধ্য দিয়েই একদিকে যেমন তাঁর জীবনীটা পাওয়া যায়, অপরদিকে বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের অনেক কথা এখানে জানা যায়। সেটাও আমরা তৈরি করেছি, সেটারও কাজ চলছে এবং আমরা এগুলো ডিক্লাসিফাইড করে দিয়েছি।
আগে এটাকে আমরা ছাপাব, বের করব একটা ডকুমেন্ট হিসেবে। তবে অফিসিয়াল অনেক লেখা সেগুলো আমরা বাদ দিচ্ছি। কিন্তু মূল কথাগুলো, মূল জিনিসগুলো যাতে থাকে এবং কীভাবে তিনি কাজ করেছেন, কীভাবে রাজনৈতিক দলটা গড়ে তুলেছেন, কীভাবে সমগ্র বাংলাদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন সব কিছু সেখানে সুন্দরভাবে লেখা আছে। সেটাও আমরা প্রকাশ করতে চাচ্ছি। খুব শিগগিরই প্রকাশ করব।
সেই সঙ্গে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা— এই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে একশটা অভিযোগ আনা হয়েছিল। সেখান থেকে দুটি অভিযোগ দিয়ে মামলা করা হয়। তাঁর সব ডকুমেন্ট সেটাও আমরা তৈরি করে ফেলেছি। সেগুলোও আমরা প্রকাশ করব।
এটা বাংলাদেশের ইতিহাস যারা জানতে চাইবে তারা হয়তো এই ডকুমেন্টগুলো পড়লেই জানতে পারবে। আর কীভাবে তিনি একটা দেশকে স্বাধীন করেছেন, এখানে সেই ছয় দফা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া, আট দফা কী ছিল সেটা তাঁর এই লেখার ভিতরেই আছে।
তাছাড়া অনেক তথ্য আপনারা এই লেখাগুলোর মধ্য থেকে পেতে পারবেন। আপনারা এই বইটা পড়লে দেখবেন তিনি অন্তত দুটি জায়গায় একই বিষয় উল্লেখ করেছেন সেখানে তিনি ’৬৬ সালের ২৪ জুলাই একবার লিখেছেন,
“বিপদে মোরে রক্ষা কর এ নহে মোর প্রার্থনা,
বিপদে আমি না যেন করি ভয়। ”
আবার ’৬৭ সালে সেই ২৩-২৭ এপ্রিল তাঁর যে লেখা খাতাটা সেই খাতাটায়ও আবার এই একই কথার পুনরাবৃত্তি আছে যে,
“বিপদে মোরে রক্ষা কর এ নহে মোর প্রার্থনা,
বিপদে আমি না যেন করি ভয়। ”
কাজেই, যে আত্মবিশ্বাস এবং যে ভালোবাসা, যে দায়িত্ব নিয়ে তিনি এদেশকে স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন কিন্তু দুর্ভাগ্য এখানে যে, তিনি দেশটাকে গড়ে দিয়ে যেতে পারলেন না। হয়তো একটু সময় পেলে এ দেশটা বহু আগেই একটা উন্নত, সমৃদ্ধ দেশ হতে পারত। বিশ্বের বুকে একটা দৃষ্টান্ত হিসেবে দাঁড়াতে পারত। কিন্তু তিনি তো নিজের জীবনকে, কষ্টের জীবনই বেছে নিয়েছেন। কষ্টের জীবন বেছে নিয়েছিলেন এদেশের মানুষের মুক্তির জন্য, আর সেই মুক্তি তিনি দিয়ে গেছেন। এখন এটা রক্ষা করার দায়িত্ব এদেশের মানুষের সবার। মানুষের শান্তি, মানুষের নিরাপত্তা, মানুষের উন্নতি, অর্থনৈতিক মুক্তি— সব কাজ আজকে সবাইকে মিলেই করতে হবে।
আজকে যখন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে যখন কোনো কাজ করতে যাই, তখন দেখি প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি সবই তো করে দিয়ে গেছেন। এদেশের স্বাধীন দেশের উপযুক্ত সব প্রতিষ্ঠান গড়ে দিয়ে গেছেন। আইনগুলো করে দিয়ে গেছেন। শুধু বাস্তবায়ন করা, একে একে সেটা আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি আমাদের সাধ্যমতো।
বই প্রকাশনা অনুষ্ঠানে রেহানা আসতে পারেনি। কয়েক দিন আগেই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে জঙ্গি হামলা বা সন্ত্রাসী কর্মকান্ড হলো। রেহানার মেয়ে টিউলিপ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মেম্বার, সে ওখানে আটকা ছিল। তার ছোট্ট শিশুকন্যাটা সেও ওখানে ছিল। রেহানা ওই খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে পরের দিন সকালেই রওনা হয়ে চলে গেছে। এ অনুষ্ঠানটায় ওর থাকার কথা ছিল। আমি আসার আগে ওর সঙ্গে ফোনে কথা বলে এসেছি। কারণ ও আমার পাশে থাকুক সেটাই সব সময় চেয়েছি।
আমার এই কাজে যারা সাহায্য করেছিলেন সব সময় একে একে সবাইকেই হারিয়ে ফেলেছি। ড. এনায়েত রহিম সাহেব জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ছিলেন। মূলত তাকে নিয়েই প্রথমে কাজটা শুরু করি। তিনি মারা গেলেন। বেবী আমার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বন্ধু, সব সময় ও আমার পাশে পাশে আমরা দুজন একসাথে মনের আনন্দে কাজ করতাম, সেও ছেড়ে চলে গেল। প্রফেসর সামসুল হুদা হারুন সাহেব তিনি এনায়েত রহিম সাহেবের মৃত্যুর পর ট্রান্সলেশনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ২০০৭ সালে আমাকে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইমারজেন্সিতে গ্রেফতার করল, কারাগারে বসে শুনলাম তিনিও আর নেই, তিনিও চলে গেছেন।
এভাবে একে একে সবাইকেই হারালাম। শুধু শামসুজ্জামান সাহেব, জামান ভাই শুরু থেকে আমাদের সঙ্গে আছেন। সেই ২০০২ সালের পর থেকে ২০০৪ সাল থেকে এবং তিনি সব সময় সাহায্য করেছেন, উপদেশ দিয়েছেন। আর সেই সঙ্গে আমাদের শাকিল মাঝখানে সেও সাহায্য করত, সবাই জানেন সেও মৃত্যুবরণ করেছে। এভাবে একে একে সবাইকে হারিয়ে মাঝে মাঝে মনে হয়, এভাবে সবাইকে কেন হারাচ্ছি জানি না।
যা হোক অবশেষে বইটা আমরা বের করতে পেরেছি। জনগণের হাতে দিতে পেরেছি। কারণ জাতির পিতা তো আমার একার পিতা শুধু না। তিনি তো বাংলাদেশেরই, বাংলাদেশের জনগণের। তাই, তাঁর সব কিছু আমরা জনগণকে বিলিয়ে দিয়েছি। ওই বাড়ি থেকে শুরু করে সব কিছু জনগণকে ফিরিয়ে দিয়েছি। এখন শুধু একটাই যে, দেশটাকে যদি সেভাবে গড়ে তুলে দিয়ে যেতে পারি সেটাই বড় কথা।
কাজেই আমি আশা করি যে, এ বইয়ের মধ্য দিয়ে আপনারা আরও ভালোভাবে জানতে পারবেন, এদেশকে জানতে পারবেন, মানুষগুলোকে জানতে পারবেন এবং আরেকটা কাজ আমি করেছি, এখানে অনেকের কথা তিনি লিখেছেন। কত ভালো ভালো কথা লিখেছেন কিন্তু এর মধ্যে অনেকেই তো পরে বেইমানি করে চলে গেছেন। কিন্তু তিনি যার সম্পর্কে যেভাবে যত ভালো কথা লিখেছেন আমি কিন্তু কোনো কথা বাদ দেইনি।
একটি কথাও কাটিনি, ঠিক সেভাবেই আছে এবং অনেকে হয়তো বেঁচে নেই, অনেকে বেঁচে আছেন। জানি না তারা এখন পড়লে নিজেরাই লজ্জা পাবেন কিনা। আমরা কিন্তু তিনি যাকে যেভাবে দেখেছেন, যেভাবে বর্ণনা দিয়েছেন, যেভাবে ভালো কথা লিখেছেন সব আমরা ঠিক হুবহু ওইভাবে রেখে দিয়েছি। কারণ সব মানুষের সত্য কথাটা জানা উচিত।
আর এত সাহস আমার নেই যে, আমরা তাঁর লেখায় হাত দেব। কাজেই, যেভাবে লিখেছেন সেভাবে আমরা রাখার চেষ্টা করেছি। আমরা আশা করি, সবাই এই বইটি পড়বেন এবং এর মধ্য দিয়ে আপনারা কারও সমালোচনা করতে হলে করবেন, কারও কিছু বলার থাকলে বলবেন।
আজকের দিনে বারবার আমার বাবা-মায়ের কথা মনে হচ্ছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে সেটুকুই চাই যে, ১৫ আগস্টে তাদের হারিয়েছি, আল্লাহ তাদের বেহেশত নসিব করুক। আর বাংলাদেশ তিনি দিয়ে গেছেন, বাংলাদেশ থাকবে, উন্নত হবে, সমৃদ্ধিশালী হবে, তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ ইনশা আল্লাহ আমরা গড়ে তুলব। [গত ২৮ মার্চ ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসবে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ থেকে। ]

Leave a Reply

Your email address will not be published.