বাংলাদেশে শহীদ উপাধিটির অপব্যবহার বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নেবার আহবান

ডা: হাছান মাহমুদ মামুন॥ গতকাল আমার ছেলে মাশ্রাফি আমার কাছে জানতে চাইল বাবা শহীদ মানে কি? আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম বাবা আর কিছু জানতে চাও! উনি মাশাল্লাহ আরো কিছু প্রশ্ন করলেন!  বাবা,, শেখ মুজিব কে শহীদ বলে না কেন! জিয়াউর রহমান কে শহীদ প্রেসিডেন্ট বলে কেন?  মারাত্বক প্রশ্ন, নিজের ছেলের কাছ থেকে এমন প্রশ্ন আশা করিনি কখনো। কিছুটা অবাক হলাম। সেই সাথে গর্ব ও অনুভব করলাম। আমার নিজের রক্ত তো এগুলোই জানতে চাইবে।
শোন বাবা, শহীদ একটি আরবী শব্দ। শহীদ ( شَهيد) তাঁদের বলা হয়, যাঁরা ধর্ম যুদ্ধ অথবা দেশ রক্ষার কাজে নিজের জীবনকে বিলিয়ে দেন এবং জীবন ত্যাগ করেন। আমাদের দেশের বিষয়টি একটু অন্যরকম।  জিয়াউর রহমান কে শহীদ হিসেবে প্রচার করা হয়েছে আর বঙ্গবন্ধু কে শহীদ বলার প্রয়োজন হয় না তার আর তার পরিবারের আমৃত্যু শহীদের কাতারে আপনা আপনিই আসে।
যেমন – জিয়াউর রহমান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সপ্তম রাষ্ট্রপতি, সাবেক সেনাপ্রধান এবং একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চ তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করে। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার পর একজন বেনিফেশিয়ারী হয়ে জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের ২১শে এপ্রিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন এবং ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল প্রতিষ্ঠা করেন। চার বছর বাংলাদেশ শাসন করার পর ১৯৮১ সালের ৩০শে মে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন।
এখানে কোনটা ধর্ম যুদ্ধ্ আর কোনটা দেশের জন্য যুদ্ধ্? যার কারণে প্রাণ দিতে হয়েছে জিয়াউর রহমানকে। কিন্তু একটা প্রজন্মকে শহীদ হিসাবে জিয়াউর রহমানকে পরিচিত করিয়ে দেয়া হয়েছে। আর তা হয়েছে শুধু মাত্র শহীদ শব্দটা অপব্যবহারের কারণে।
পৃথিবীর বুকে একমাত্র দেশ বাংলাদেশ যেখানে দেশের স্বাধীনতার বিরোধীতাকারীরা সম্মানের সহিত পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে এদের জামাই আদরে বরণ করেছিলেন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৩ সালের ১৮ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সরকার দালালী এবং স্বাধীনতাবিরোধী ক্রিয়াকর্মের অভিযোগে যে ৩৯ জন ঘাতকের নাগরীকত্ব বাতিল করেন। জিয়াউর রহমান তাদের অনেককেই পুনর্বাসিত করেন, তাদের মধ্যে জুলমত আলী খান (উকিল) প্রাক্তন জিয়া সরকারের মন্ত্রী হয়েছিল। গোলম আযম, প্রাক্তন জেনারেল সেক্রেটারি, ডিইউসিএসইউ, জামাতে ইসলামীর আমীর এবং দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্ত শাহ আজিজুর রহমানকে নিয়ে বিএনপি গঠনের পূর্বে ১৯৭৮ সালে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট নামক একটি দল গঠিত হয়। এই দলে তৎকালীন মুসলিম লীগের একটি অংশ নিয়ে শাহ আজিজুর রহমান যোগদান করেন।
এই জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে জিয়াউর রহমান ৩ জুন , ১৯৭৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়লাভ করেন। পরে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট এবং আরো কয়েকটি রাজনৈতিক সংগঠন মিলে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গঠিত হলে তিনি এই দলে বেশ প্রভাবশালী নেতায় পরিণত হন।
১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন তাকে দেশের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা হয়। শাহ আজিজুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশে বিএনপি সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। জিয়ার মৃত্যুর পর বিচারপতি আবদুস সাত্তার প্রেসিডেন্ট হলে শাহ আজিজুর রহমান প্রধানমন্ত্রীর পদে অসীন থাকেন।
৭৫ এর ২৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বাধ্য করেন সেনাপ্রধানের দায়িত্ব হন্তান্তর করার জন্য এবং সেই শর্তে তিনি খুনিদের বিদেশে পাঠিয়ে পুরস্কৃত করেন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে। মুক্তিযোদ্ধা কতজন সেনা অফিসারকে তিনি কোট মার্শাল করে ফাঁসি দিয়েছেন তার হিসাব নেই! কারন তাকে ক্ষমতায় থাকতে হবে। এক দিনেই প্রায় ৬ শত বিমান বাহিনীর সদস্য/কর্মকর্তাদের কোর্ট মার্শাল করে ফাঁসি দেন। তার প্রথম টার্গেট ছিলো মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসার। তিনি জাতীর জীবনে যা ক্ষতি করে গেছে তার মাশুল আজও দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।
৭১’র ঘাতকদের বিরদ্ধে আমরা যেই যুদ্ধ করছি, সেই ঘাতকদের বিষবৃক্ষ খুনী জিয়া বপন করেছিলেন বহুদলীয় গনতন্ত্রের নামে। বাকী কাজটা সম্পন্ন করেছেন বেগম খালেদা জিয়া। গোলাম আজমের নাগরিকত্ব থেকে শুরু করে নিজামী মুজাহিদকে মন্ত্রী বানানো পর্যন্ত। দীর্ঘ ৪৩ বছর পরে জাতি যখন কলঙ্কের কালিমা মুক্তির প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে, তখনই বাংলাদেশে শহীদের সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে পিপীলিকার মতো। মানবতা বিরোধী অপরাধে ফাঁসিতে মৃত্যদন্ড পাওয়া কসাই কাদের মোল্লার কবরের ফলকে লেখা শহীদ কাদের মোল্লা। আরেক অপরাধী কামারুজ্জামানের নামের আগেও ব্যবহার করা হয়েছে শহীদ, ছাত্র শিবিরের যারাই ঘাতে অপঘাতে মারা পড়ছে সবার আগে ব্যবহার করা হচ্ছে শহীদ। এটা ভবিষ্যৎ ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। আজ থেকে ২০/৩০ বছর পরে একটা প্রজন্ম হয়তো এদেরকে শহীদ হিসাবেই জানবে। তবে তা সম্ভব হবে না যদি বাংলাদেশে মুক্তিযূদ্ধের চেতনা বজায় থাকে।
৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে জাতির চরম পাওয়া মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ্বে ৩০ লাখ শহীদের সঙ্গে চরম ফাজলামি ছাড়া আর কিছু নয় এটি। যাদের রক্তে হাত রঞ্জিত, সেই সব রাজাকার আলবদরদের নামের আগে শহীদ ব্যবহার করে যারা ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে এদের লাগাম টেনে ধরা জরুরি। প্রয়োজনে আইন করে বাংলাদেশে শহীদ শব্দটির যতেচ্ছা ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
নতুন প্রজন্ম যেন ভুল শহীদের সঙ্গে পরিচিত না হয়। এই দায় সকল দেশপ্রেমিক নাগরিকের। জিয়াউর রহমান শহীদ হিসাবে জাতির ঘাড়ে চেপে না বসলে বাংলাদেশে ইতিহাস অন্যরকম হতো। জাতিস্বত্তার স্রোতধারাকে ভুল ভাবে প্রবাহিত করেছিল জিয়াউর রহমান। সেই ভ্রান্ত ভুল ইতিহাসের খেসারত দিচ্ছে প্রজন্ম।  ধর্ম ব্যবাসায়ীদের প্রতিস্থাপন করে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত করে দিয়ে গেছে এই শহীদ শব্দের অপব্যবহার করে।
অন্যদিকে, বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অব.) এম এ তাহের বীর উত্তমসহ অন্যদের গোপন বিচার, সাজা কার্যকর এবং বিচারের জন্য ১৯৭৬ সালের ১৬ নম্বর সামরিক আইন আদেশের মাধ্যমে সামরিক ট্রাইব্যুনাল গঠনকে অবৈধ ঘোষণা করে ২০১১ সালের ২২ মার্চ রায় দেন হাইকোর্ট। ১৯৭৬ সালে জিয়ার আমলে বিশেষ সামরিক আদালতে মুক্তিযুদ্ধের ১১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার তাহেরকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়, যা হত্যাকান্ড ছিলো বলে রায়ে বলেছে আদালত। রায়ের অভিমতে বলা হয়, “ট্রাইব্যুনাল গঠনের অনেক আগেই জেনারেল জিয়াউর রহমান কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদন্ড প্রদানে মনস্থির করেন।”
রায়ে আদালত বলেন, “যেহেতু জেনারেল জিয়াউর রহমান জীবিত নেই, আইন অনুযায়ী তার বিচার সম্ভব নয়। কিন্তু তারপরও সরকারের উচিত হবে, এই হত্যার জন্য দায়ী কেউ জীবিত থাকলে তাকে খুঁজে বের করে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করা।” আদালতের এই রায়ের পরও খলনায়ক জিয়াউর রহমান নায়ক হয়েই বাংলাদেশে বহাল তবিয়তেই বিরাজমান।
যাহোক, ছেলের কারনে বিষয়টির উপর লেখার মত উপাদান পেয়েছিলাম। প্রজন্ম কে সঠিক এবং চিরন্তন সত্য বিষয়্য গুলো জানতে হবে বুঝতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.