মানুষখেকো পুকুর

মুহম্মদ পাঠান সোহাগ॥ পুকুরটির বয়স আনুমানিক দেড়শ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের এই পুকুর নিয়ে আছে নানা কল্পকাহিনি। পুকুরটির মধ্যখানে গেলে নাকি প্রাণ নিয়ে পাড়ে ফেরা যায় না। তবে কথাটির পক্ষে আছে জোরালো প্রমাণও। প্রতি বছরই এই পুকুরে ডুবে মারা যায় কেউ না কেউ। সর্বশেষ গত ৫ এপ্রিল সন্ধ্যায় এই পুকুরে ডুবে প্রাণ হারায় বায়েজিদ বোস্তামি নামের এক শিক্ষার্থী। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পরিসংখ্যান বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। ফুটবল খেলে ক্লান্ত সহপাঠীদের সঙ্গে গোসল করতে নেমেছিলেন বায়েজিদ। এরপর সবার অজান্তে তলিয়ে যান পানির নিচে।
শহীদুল্লাহ হলের শিক্ষার্থী ও বায়জিদের সহপাঠী মনোয়ার হোসেন জানান, ফুটবল খেলা শেষে তারা সবাই পুকুরে গোসল করতে যান। একসময় বায়জিদ পানিতে তলিয়ে যান। পরে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন এসে তার লাশ উদ্ধার করে।
গত বছরের ১৩ আগস্ট বিকেলে এই পুকুরে গোসল করতে নেমে মারা যায় মোহাম্মদ আলী নামে এক স্কুলশিক্ষার্থী। পুরান ঢাকার বংশালের বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র ছিল সে। প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, আলীরা সাত বন্ধু মিলে শহীদুল্লাহ হলের পুকুরে সাঁতার কাটতে নামে। এক সময় আলী পানিতে ডুবে যায়। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে তার লাশ উদ্ধার করে। ২০১৫ সালের ১৩ মে এই পুকুরে ডুবে মাহফুজুল ইসলাম নাম রাহী (২৪) নামে এক ছাত্রের মৃত্যু হয়। মাহফুজ পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল। ফজলুল হক মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র মাহফুজের গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ায়।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ এম আমজাদ বলেন, বহিরাগত ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মিলে এমন সংখ্যা হতে পারে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে এর কোন নথিপত্র নেই। তিনি আরো জানান, এই পুকুরটিতে নামা নিষেধ লেখা থাকলেও কয়েকজন শিক্ষার্থী মিলে এখানে গোসল করতে নামলে এমন দুর্ঘটনা ঘটে। ঢাবির শিক্ষার্থী বায়েজিদ বোস্তামির মৃত্যুর ব্যাপারে শহিদুল্লাহ হলের সহকারী আবাসিক শিক্ষক অধ্যাপক ড. শাহ মো. মাসুম বলেন, বায়েজিদ বিকেলে ফুটবল খেলেছে। খেলা শেষে বন্ধু-বান্ধবের পাল্লায় পড়ে সাঁতার কাটতে পুকুরে নামে। তখনই সে ক্লান্ত ছিল। সে একবার পুকুর পাড়ি দিয়ে আবার সাঁতরে ফেরার পথে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। পরে ভয়ে তাৎক্ষণিক হার্ট এ্যার্টাকে তার মৃত্যু হয়।
পুকুর পাড়ে হলের নিরাপত্তা প্রহরী কাজী মো. রফিকুল ইসলামে সঙ্গে কথা হয়। তিনি এখানে ২২ বছর যাবৎ কাজ করেন। এই পুকুরে ২২ বছরে ১৮ জন ডুবে মরার সাক্ষী তিনি। ১৯৭২ সালের পর এ পুকুরে ২৮ জনের মৃত্যু হয় বলে জানান তিনি। তিনি আরো জানান, সব সময় পুকুরটিতে ৪০ থেকে ৪২ ফুট পানি থাকে। ১৯৮৬ সালে একবার পুকুর সেচের ব্যবস্থা করেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তখন পুকুরটি সেচ দেওয়া সম্ভব হয়নি। এ পুকুরে চারটি পাতাল কূপ আছে। তখন তিনটি পাতাল কূপ বন্ধ করা সম্ভব হয়। এখনো একটি পাতাল কূপ রয়ে গেছে। যার ফলে সব সময় এ পুকুরে পানি একই স্তরে থাকে।
তিনি আরো জানান, এ পুকুরের একটি অংশ প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সামনে। ওই অংশে সবচেয়ে বেশি পানি থাকে। এ পর্যন্ত যে কয়জন মারা গেছে তার বেশের ভাগই ফজলুল হক মুসলিম হলের পুকুর ঘাটে মৃত্যু হয়েছে।
কয়েক বছর আগে এক শিক্ষার্থীর ডুবতে ডুবতে বেঁচে যাওয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে এই কর্মচারী বলেন, ওই শিক্ষার্থী পুকুরের মাঝখানে গিয়ে ডুবে যাচ্ছিল। পরে আশপাশের মানুষের সহায়তা তাকে উদ্ধার করা হয়। ওই শিক্ষার্থীর ভাষ্য, তার শরীরে বিদ্যুতের তারের মতো কী যেন একটা স্পর্শ করেছিল। ঘটনার আকস্মিকতায় বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল তার। শুধু হাত নাড়িয়েছিল সে। পুকুর সংলগ্ন ফজলুল হক মুসলিম হলের প্রবীণ অফিস সহকারী বলেন, এই অফিসে আমি চাকরি শেষ করেছি। এই পুকুরে আগেও মানুষ মারা গেছে এখনো মরছে। তার নিজের চোখে দেখা এসব ঘটনার বর্ণনা করেন। তার বর্ণনায় প্রতিবছরই কারো না কারো মৃত্যুর ঘটনার কথা উঠে এসেছে।
সরেজমিন গত শনিবার পুকুর পারে গিয়ে দেখা যায়, শহিদুল্লাহ হল কর্তৃপক্ষ পুকুর পাড়ে বাঁশ মাটিতে পুঁতে মোটা রশি দিয়ে বেড়া দিচ্ছেন। অন্য পাশে কাটা তাঁর দিয়ে বেড়া দেওয়া আছে। তবু শিক্ষার্থীরা বন্ধু-বান্ধবসহ ঢুকছে পুকুর পাড়ে। পুকুরে প্রতিটি পাশে সাইনবোর্ডে টানানো আছে। এতে লেখা আছে পুকুরে গোসল ও সাঁতার কাটা নিষেধ’। তবু শিক্ষার্থী ও বহিরাগতরা মানছে না এ নির্দেশ। শহীদুল্লাহ হলের সহকারী আবাসিক শিক্ষক অধ্যাপক ড. শাহ মো.মাসুম বলেন, এ পুকুরের প্রতিবছর এক-দুজন পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে। আমরা প্রতিনিয়ত পুকুরে গোসল করার জন্য নিষেধ করছি। ব্রিটিশ আমল থেকে এই পুকুর। শুনেছি তখন থেকে প্রায় প্রতি বছর মৃত্যু ঘটছে এ পুকুরে।
তিনি আরো বলেন, ১৯৩৪ সালে একজন এ পুকুরের পানিতে পড়ে মারা গেছে। ওই মৃত ব্যক্তির নাম পুকুর ঘাটে খোদাই করে লেখা ছিল। কিন্তু এখন তা অস্পষ্ট হয়ে গেছে। এই পুকুরের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো দিদার-উল-আলম বলেন, শহীদুল্লাহ্ হলের পুকুরে ভৌতিক কিছু ঘটনা আছে। তবে আমরা এটি বিশ্বাস করি না। পুকুরের গভীরতা অনেক বেশি। যার কারণে ছেলেরা সাঁতার কাটতে গিয়ে সহজেই হাঁপিয়ে যায়। ছলেরা খেলাধুলা করে পানিতে সাঁতার কাটলে বা ডুব দিলে রক্তচাপজনিত সমস্যা সৃষ্টি হয়। পরে ‘হার্ট অ্যাটাক’ করে বলে জানান তিনি। তখন যাদের বেশি সমস্যা হয় তারা মারা যায়।
হলের আবাসিক শিক্ষার্থী আবু রায়হান বলেন, এই পুকুরের নিচে উদ্ভিদের পরিমাণ বেশি হওয়ায় পানিতে অক্সিজেন স্বল্পতা রয়েছে। প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. রেজা মো. শাহজাহান জানান, সাধারণত অল্পদিন যাবৎ সাঁতার শিখেছে; শহুরে এমন ছেলেদের ক্ষেত্রে এ দুর্ঘটনা ঘটছে। গ্রামের ছেলেরা পুকুরের পানিতে ডুবে মরছে এমন নজির নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published.