ওরা আমাকে প্রতিদিন গণধর্ষণ করছে

ছানাউল্লা সুমন॥ সৌদি আরবে যাওয়ার ২৬ দিন পর এক নারী দেশে মোবাইল ফোনে তাঁর স্বামীকে বলেছেন, প্রতিদিন তাঁকে গণধর্ষণ করা হচ্ছে। স্বামী তাঁকে পরামর্শ দেন পুলিশকে জানাতে। সৌদি পুলিশের দ্বারস্থ হয়েও তিনি মুক্তি পাননি। উল্টো ১৫ দিন ধরে ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার বাসিন্দা স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
দিনমজুর স্বামী (৪০) জানান, প্রায় ১৭ বছর আগে বিয়ে করা সংসারে তাঁদের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে। ঢাকায় একটি রড সিমেন্টের দোকানে কাজ করতেন তিনি। পাঁচ বছর আগে রড বহন করার সময় এক দুর্ঘটনায় তিনি গুরুতর আহত হয়ে বাড়িতে চলে আসেন। বাঁ কাঁধ ভেঙে গেলে সহায়-সম্বল বিক্রি করেও আর সুস্থ হয়ে ওঠেননি। কর্মহীন হয়ে পড়েন তিনি। এ অবস্থায় প্রায় সাত সদস্যের পরিবারে চলে আসে অভাব-অনটন। কিছুদিন পর তাঁর স্ত্রী দুই ছেলেকে নিয়ে নরসিংদী চলে যান। সেখানে ছেলেরা রিকশা চালায় আর স্ত্রী একটি সুতার কারখানায় কাজ নেন। তাঁদের আয়ের একটা অংশ দিয়ে নান্দাইল গ্রামের বাড়িতে দুই মেয়ে ও বৃদ্ধ মাকে নিয়ে কোনোমতে জীবন চলে যাচ্ছে।
গত বছরের নভেম্বরে স্ত্রী তাঁকে জানান, নরসিংদীর বেশ কয়েকজন নারীর সঙ্গে তিনি সৌদি আরবে যাবেন কাজ করতে। এ জন্য তাঁর কোনো টাকা লাগবে না। সব কিছু বহন করবে সেখানকার এক লোক। বেতন হবে মাসে ২০ হাজার টাকা। স্ত্রীর এ কথায় দিনমজুর ব্যক্তিটি সায় না দিয়ে উল্টো শাসিয়ে দেন। কিন্তু স্বামীর কথা না মেনে স্ত্রী পাড়ি দেন সৌদি আরব। সেখান থেকে গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর কল করে জানান, তাঁকে চার তলার একটি ভবনের নিচতলায় রাখা হয়েছে। স্থানীয় সময় বিকেল ৪টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তাঁর ওপর চলে যৌন নির্যাতন। মালিক যাওয়ার সময় বাইরে থেকে তালা ঝুলিয়ে দেন।
স্ত্রী তাঁকে বলেন, ‘কোনো প্রতিবাদ করলে চলে নির্যাতন। আমি জানি তুমি আমাকে ক্ষমা করবা না। তার পরও তুমি আমার সব। আমাকে এই গজবের হাত থেকে নিয়ে যাও। আমি বাঁচতে চাই। ’ স্ত্রীর এ আকুতি শোনার পর দিনমজুর ব্যক্তিটি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। তিনি জানান, এর এক সপ্তাহ পর একজনের পরামর্শে তিনি স্ত্রীকে বলেছিলেন বন্দিদশা থেকে ছুটে গিয়ে পুলিশের দ্বারস্থ হতে। তাঁর কথামতো স্ত্রী কৌশলে বের হয়ে গেলে পুলিশ তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। পরে দেশে ফেরত পাঠানোর প্রস্তুতি নেওয়ার সময় দুই দিন পর কথিত মালিক তাঁকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান। এর পর থেকে স্ত্রীর সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারছেন না। বেঁচে আছেন, না মরে গেছে তা-ও জানতে পারছেন না। তিনি আরো জানান, স্ত্রীকে সৌদি আরব থেকে ফিরিয়ে আনতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। পুলিশ, র্যাবের কাছে গিয়েও কোনো কাজে আসেনি। এই অবস্থায় তিনি কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, ‘দুই ছেলের কাছ থেকে জেনেছি, ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার শাহজাহান নামের এক ব্যক্তি আমার স্ত্রীকে সৌদি আরবে পাঠিয়েছে।’
ইটভাটা শ্রমিক পরিচয়ে শাহজাহানের মোবাইল ফোনে কল করে বোনকে সৌদি আরব পাঠানোর আগ্রহ দেখালে তিনি বলেন, ‘নান্দাইলের উনার (দিনমজুর) ওয়াইফকে তো আমিই পাঠাইছি। কোনো ঝামেলা নাই। যদি ঝামেলা অইতো তা অইলে তো উনিই বলতেন। আমরা চার-পাঁচ শ পাঠাইছি। আপনে একজন কইরা দেইন। আর ওইখানে বয়স চায় ৩০-৩২-এর মধ্যে। আল্লাহওয়ালা লোকদের বাসায় থাকবো। মেডামরার দেখাশোন করবো। আর তারার বাচ্চাটাচ্ছা থাকলে যতœ করবো।
ঢাকার কাকলী আইয়া আমারে ফোন দিবাইন। আমি আপনের খোঁজ করবাম। ’ তিনি জানান, তাঁর বাড়ি ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার লক্ষ্মীগঞ্জ এলাকায়। লক্ষ্মীগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে নেমে সরকারবাড়ির মফিজ উদ্দিনের ছেলে শাহজাহান বললে যে কেউ দেখিয়ে দেবে। তবে তিনি বাড়িতে কম থাকেন। ঢাকা ও নরসিংদীতে বেশি থাকেন। বর্তমানে তিনি নরসিংদী আছেন। লক্ষ্মীগঞ্জে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাঁর দেওয়া ঠিকানার সত্যতা আছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লোকজন জানায়, শাহজাহান এলাকায় হঠাত্ আসে। কোথায় কী করে কেউ জানে না। । তবে তাঁর ভাই কবিরাজ মো. ফজলুল হক বলেন, ‘শাহজাহান দীর্ঘদিন ধরে তাঁর শ্বশুরবাড়ি নরসিংদীর মাধবদীতে বসবাস করে। সেখানকার লোকজনের সঙ্গে সে ব্যবসা করে। ’ তবে কী ব্যবসা তা তিনি জানাতে পারেননি।
শাহজাহান একজন দালাল। তিনি ফয়সাল এন্টারপ্রাইজের হয়ে কাজ করেন। তাঁর কাছ থেকে নম্বর নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির মালিক মোজাম্মেল হক মুকুলকে কল করা হলে তিনি দাবি করেন, ‘ওই মহিলা যেসব অভিযোগ করেছেন সব মিথ্যা। তাঁর সঙ্গে আমার গত সপ্তাহেও কথা হয়েছে। তিনি বাঙালি খাবার ছাড়া খেতে পারেন না। এ কারণে ক্ষুব্ধ ছিলেন। তাঁর কাছে মোবাইল ফোন না থাকায় তিনি সাময়িকভাবে যোগাযোগ করতে পারছেন না।’ নান্দাইল থানার ওসি মো. আতাউর রহমান বলেন, ‘দালালদের নাম-পরিচয়, মোবাইল নম্বরসহ লিখিত অভিযোগ দিলে আমি আইনগত ব্যবস্থা নেব।’

Leave a Reply

Your email address will not be published.