সত্য সুন্দর ও ন্যায়ের পূজারী শিক্ষদ্বয়

তাজুল ইসলাম (হানিফ) ॥  তাঁরা দু,জনই আমার শিক্ষক। সত্য সুন্দর ও ন্যায়ের পূজারী। মানুষদ্বয় ধার্মিক তো বটেই। সমাজ উন্নয়নে চিন্তাশীল মানুষ। হ্যাঁ, কথা বলছি আবুল কালাম আজাদ (শাহজাহান স্যার) স্যার ও সেলিনা জাহান (শেলী ম্যাডাম) ম্যাডাম সম্পর্কে। শুধু আমার নয়, তাঁদের হাত দিয়ে বের হয়েছে হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে। হয়েছে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, সরকারী-বেসরকারি চাকুরীজীবী, স্কুল-কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ। বিনাবেতনে পড়িয়েছেন অসংখ্য ছেলে-মেয়েকে। স্যারের বাড়ী আর আমার বাড়ী পাশাপাশি হওয়াতে ছোটবেলা থেকেই দেখতাম খুব সকাল সকাল লাইন ধরে ছেলে-মেয়েরা ইংরেজী পড়তে আসতেন। আবার বিকালেও পড়াতেন। সমাজকে শিক্ষিত করতে হবে সেই দায়ীত্ববোধ নিয়েই যেন পড়াতেন। আমার ইংরেজীর বেইজ তৈরী করে দিয়েছিলেন এই স্যার। যা আমি উচ্চশিক্ষা নিতে ঢাকায় এসে হারে-হারে বুঝতে পারি। আরো বুঝি যখন আমি সাইফুর’স এর ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ ক্লাবের বিতর্কে প্রায়-ই ফাস্ট হতাম। আসলে উনি তো টাকার জন্য পড়াতেন না। হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে পড়িয়ে কতজন-ই বা টাকা দিয়েছিলেন ? কিংবা উনি নিয়েছিলেন ? কর্মজীবন শুরু সরকারী চাকুরী দিয়ে। কিন্তু সেই চাকুরী আর বেশীদিন চালিয়ে নিতে পারলেন না বিবেকের তাড়নায়। তাঁকে ১০০ টাকা ঘুষ দেওয়ায়, সেই টাকার উপর থুঁতু ফেলে, ফিরে আসেন মহৎ পেশা ও প্রিয় বাবা মতিউর রহমানের পেশা শিক্ষকতায়। পহেলা জুলাই, ১৯৬৭ সালে ব্রাহ্মণবাড়ীয়া চিনাইর উচ্চবিদ্যালয়ে শুরু করেন ইংরেজীর শিক্ষক হিসাবে।
তাঁরপর চলতে থাকে শিক্ষকতা ছতুরাশরীফ উচ্চবিদ্যালয়, হাজীপুর উচ্চবিদ্যালয়ের পর সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসাবে চলে যান মাধবপুর উচ্চবিদ্যালয়ে। ফিরে আসেন গ্রামের ও সমাজের মুরুব্বীদের কথায় ও সম্মানে সৈয়দাবাদ আলহাজ্ব সৈয়দ মনিরুল হক উচ্চবিদ্যালয়ে। কঠোর হস্তে  স্কুলের প্রশাসনিক দিকটা যেমন নিয়ন্ত্রন করতেন ঠিক তেমনি শিক্ষার মান উন্নয়নে ও শতশত ছেলেমেয়েকে নিয়ম শৃঙ্খলায় রাখার কৌশল ছিল মনে রাখার মতো।
শাহজাহান স্যারের সহধর্মিণী সেলিনা জাহান ও আমার শিক্ষক। ম্যাডামের সান্নিধ্যে সৈয়দাবাদ উত্তর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঁচটি বছরের পড়াশোনা ভুলি কি করে! সেই যাদুমাখা পড়ানোর ধরণ ও মাতৃস্নেহে গড়িয়ে দিতেন ছেলে-মেয়েদের জীবন। ১৪ই নভেম্বর ১৯৮৩ থেকে ৭ই সেপ্টেম্বর ২০১১ পর্যন্ত হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীর ভিত তৈরী করে দিয়েছিলেন। প্রিয় সেলিনা জাহান ম্যাডাম, কথা দিচ্ছি ভুলবো না, কখনোই ভুলবো না আপনাকে, যতই দূরে থাকি অন্ন অন্বেষণের খোঁজে। আপনার ছোট ছেলে জীবনের মতো, আমাকেও খাইয়েছেন সম-যতনে। আমি তো চাই, সমাজে আপনাদের মতো মানুষের সংখ্যা বাড়ুক। সমাজে চর্চা হোক আপনাদের মতো সজ্জ্বন ও দায়ীত্বশীল মানুষদের। তাই তো মনের অজান্তেই চলে আসে শ্রদ্ধা, সম্মান, অগাধ-ভক্তি আপনার প্রতি। অন্যকোন সময় লিখতে চাই আপনাকে নিয়েও।
সত্য, সুন্দরের প্রতি ভালবাসা মানুষের চিরন্তন। আমার এই ছোট্ট জীবনে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা শহর, বন্দর, গ্রাম, গঞ্জে চলতে গিয়ে যে কয়েকজন হাতেগুনা চরম নীতিবান বা নীতিতে অটল থাকা মানুষ দেখেছি, তাঁর মধ্যে শাহজাহান স্যার অন্যতম। মানুষকে সম্মান দিয়ে কথা বলতেন। ছিল না তাঁর মধ্যে কোন অহংবোধ। আসলে, আমরা জানি  এখন কেমন হয়ে যাচ্ছি ! আতœকেন্দ্রীক, হিংসা-পরায়ন, পরের সমালোচনাকারী, অন্যের ভালোটা ভাল না বলা কিন্তু খারাপটাকে বেশী-বেশী প্রচার করা। মানুষ সম্ভবত, একমাত্র প্রানী যাকে শিক্ষকের সংস্পর্শে এসে মানুষ হতে হই, অভিভাবকরা শিক্ষকের কাছে  ধর্নাদেন, বলেন আমার শিশুকে একটু মানুষ করে দেন। কাজেই শিক্ষক শুধু শিক্ষা দিয়েই ক্ষান্ত থাকেন না। তিনি একজন শিক্ষার্থীর মনোজগতের গঠন নিয়েও কাজ করেন। আমি মনে করি সেটাই প্রকৃত শিক্ষা। আর এই প্রকৃত শিক্ষার ব্যাপারেই কঠোর ছিলেন স্যার। বলতেন “পুঁজি থাকতে হবে তোমাদের মননে। যেই পুঁজির জোরেই তোমাকে খুজে নিবে চাকুরীদাতারা” কিংবা নিজের পথ খুঁজে পাবে। অথচ, আজ আমরা ভুলতে বসেছি এই মানুষ গড়ার কারিগর “শাহজাহান স্যারকে”। গুণীদের কথা যেন বলতে নেই সমাজে। এই প্রসঙ্গে রবি ঠাকুরের সেই অমর বাণী প্রাসঙ্গিক,— যারে তুমি নিচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নিচে,…… পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।
আমি মনে করি, আমার পরিবারের পরেই আমার শিক্ষক। তাঁদের প্রতি আমার অগাধ ভক্তি, সম্মান ও ভালবাসা আছে। সকল সভ্য, সামাজিক, নৈতিক এবং আনুষ্ঠানিক শিক্ষার পাঠ তাঁদের থেকেই নেয়া। আর তাই, শিক্ষকদের আনন্দে আমি আনন্দিত হই, তাঁদের সমস্যায় আমি ব্যথিত হই এবং তাঁদের কষ্টে সমানভাবে আহত হয়। ২০০৬ সালের দিকে  আমার অনার্সের টিউটরিয়াল পরীক্ষা চলছিল। মায়ের কাছে স্যারের মৃত্যুর সংবাদ শুনেই চলে আসি ঢাকা থেকে বাড়ীতে। নামাজ ও কবর জিয়ারত শেষ করে যখন একা একা বসেছিলাম, মনের অজান্তেই চোখের কোণে অজস্র পানির ফোটা জমে আর মনে হল যেন এই পাড়ার সবচেয়ে বড় বটবৃক্ষটা আজ আর নেই। চারদিকে যেন শুনশান নিরবতা। মনে পড়ে স্যারের শ্বশুর বাড়ী বি.বাড়িয়া শহরে, কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ড, কিংবা বিভিন্ন বিয়ে বাড়ীতে একসাথে যাওয়া কিংবা সেই সন্ধে বেলায় স্যারের পাশে বসে সবুজ ছায়া, আলিফ লাইলা, রুপনগর নাটক দেখার মুহূর্তগুলো। শৈশবে পত্রিকা পড়ার অভ্যাস করিয়ে দেওয়া মানুষটিকে কী-করে ভুলি !
শিক্ষা যদি জাতির মেরুদন্ড হয় তবে শিক্ষকরা সে মেরুদন্ডের স্রষ্টা। গোটা মনুষ্য সমাজের মধ্যে নৈতিক বিচারে শিক্ষকদের চেয়ে সম্মানিত এবং শিক্ষক তাঁর চেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পেশা আর একটি ও নাই। শিক্ষকরা এ সমাজের প্রাণ।“শাহজাহান স্যার-রা এই সমাজের বটবৃক্ষ। তাই তো পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু বলেছিলেন, “ He has served his nation in many capacities, but above all he is a great teacher from whom all of us have learnt much and will continue to learn”. আর আমি বলি, সৃষ্টি ও ধবংসের দুয়েরই বীজ লুকিয়ে রয়েছে শিক্ষকের মধ্যে। অতএব, সমাজের এই বটবৃক্ষ শিক্ষকদের প্রতি রাষ্ট্র, সমাজ যত গুরুত্ব দিবে সমাজ পৌঁছে যাবে তাঁর কাঙ্খিত আসনে।
তাঁর জ্ঞান, বিচক্ষনতা, দরদী মনোভাব, সত্য সুন্দরের প্রতি নিরন্তর ভালবাসা চিরকালের জন্য মনে দাগ কেটে আছে। শাসন এবং সহানুভূতি, পাঠদান এবং আন্তরিকতা, সামাজিকতা এবং সহমর্মিতা কেমন করে একজন শিক্ষককে সকলের ভরসাস্থল, সকলের সেরা করে তোলে স্যার ছিলেন তাঁর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। শিক্ষকতার বাইরের জগতেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন চরম মানবিক। সাদাকালো শার্ট-পেন্ট পরিহিত খুবই সাধারন জীবনযাপনে অভ্যস্ত জ্ঞানভান্ডার। ছাত্রজীবনকে সজীব করে তুলতে তিনি সবার হ্রদয়ে পৌঁছে গিয়েছেন অদ্ভুতভাবে। জর্জ বার্নাড শ এর ভাষায়–   “I am not a teacher, only a fellow traveler to whom you asked the way”. যার অপদার্থ বলে বকুনির মধ্যেও থাকতো সুপ্ত ভালবাসা এবং বলতেন বাস্তবকে স্বীকার করে সততার সঙ্গে এগিয়ে যেতে, শিখিয়ে ছিলেন জটিল পরিস্থিতিতেও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে, আজ তিনি শুধুই স্নৃতি, অনুভবে।
শুধু তা-ই নয়, বিদ্যা যে মানুষকে বিনয়ী করে তোলে, তা আমি তাঁকে দেখেই শিখেছি। ছাত্র-ছাত্রীদের তিনি সন্তানসম ভালবাসতেন ও স্নেহ করতেন। তাঁর প্রশান্তিময় সাহচর্যে সবাই নিজের নিজের ভুল সংশোধনের পথ খুঁজে পেত। তাঁর লক্ষ্য ছিল অপার। স্যার বলতেন, লক্ষ্য স্থির রেখে ধের্য ধরে পরিশ্রম করলে সাফল্য আসবেই। তাঁর এক একটা কথা যে অমূল্য তা আজ দারুণভাবে বুঝি। স্যার একটি কথা খুব জোর দিয়ে বলতেন, দাদার নামে কিংবা বাবার নামে গৌরব করার কিছুই নেই। অহংকার করার কোন কিছুই নেই কোন গোষ্ঠি সম্প্রদায়ের। নিজের চেষ্ঠায় ও বিদ্যা-বুদ্ধিতে বড় হওয়াটাই গৌরবের। এই প্রেক্ষিতে তিনি শোনান-“দাদার নামে গাদা, বাবার নামে আধা, নিজের নামে বাঘা” নামের কৌতুকটি। আরও বলতেন, কাউকে অভিগ্রহন করতে হলে নৈতিক শক্তির দরকার হয়। পৃথিবীতে যে যত মহৎ হোক না কেন, সে কোন না কোন শিক্ষকের অধীনে জ্ঞান অর্জন করেছে। তাই পৃথিবীতে যতগুলো সম্মানজনক পেশা আছে তাঁর মধ্যে শিক্ষকতা সর্বোচ্চ সম্মানিত পেশা। মানুষের মধ্যে যারা কৃতজ্ঞ শেণীর তাঁরা সার্বিকভাবে না হলেও ব্যক্তিগতভাবে কোন না কোন শিক্ষকের কাছে ঋণী এবং বিভিন্ন সভা সেমিনারে তাঁদের সে অভিব্যক্তিও ফুটে ওঠে। সারা বিশ্বের মত বাংলাদেশেও শিক্ষকতা একটি মহান পেশা হিসাবে স্বীকৃত। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মানসম্মত শিক্ষা। বিভিন্ন পরিক্ষার ফলাফলে পাশের হার বাড়লেও গুণগত মান নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। আর এই মানের ব্যাপারেই  শাহজাহান স্যার ছিলেন অতুলনীয়।
শাহজাহান স্যারের নাম আজো জাগিয়ে তোলে গভীর বিশ্বাস, অশেষ শ্রদ্ধা এবং অকুন্ঠ প্রশংসা। যখনই তাঁর নাম উচ্চারিত হয় তখনি আমার মনে জেগে উঠে নিত্য নতুন বুদ্ধিদীপ্ত চিন্তাধারা এবং জানার তৃষ্ণার্ত। তাই তো তিনিই আমার গুরু, শিক্ষক, অভিভাবক। মনের আবেগে অনেক কিছুই লিখে ফেললাম, উদ্দেশ্য একটাই, এই সমাজ, সংসার কিংবা রাষ্ট্র সম্মানী যা-ই-দিক তাঁদেরকে, কিন্তু সম্মান দিতে কৃপনতা কেন ? তাই সম্মানটুকু পরিপূর্ণভাবেই চাই। কখনো কখনো মৃত ব্যক্তি জীবিত ব্যক্তির চেয়ে বেশী শক্তিশালী এবং কারও অনুপস্থিতি তাঁর উপস্থিতির চেয়ে বেশী অনুভূত হয়। হঠাৎ স্যারের চলে যাওয়াটা বড়ই বেদনাদায়ক কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ আমার কাছে মডেল ও অনেক শক্তিশালী।
৩১শে আগস্ট, ২০০৩ সালে চাকুরীর মেয়াদ শেষ হলেও, এলাকার সম্মানিত মানুষদের অনুরোধে ও  ছাত্র-ছাত্রীদের মায়ার টানে এক্সটেনশনে থেকে ২রা মে ২০০৬ অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ছিলেন এই মানুষটি, মানুষ গড়ার কারিগর হিসাবে।  হাজার হাজার শিক্ষার্থীর মনে শিক্ষার উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা জ্বালিয়ে দিয়ে তিনি আজ ঘুমিয়ে আছেন তাঁর নিজ গ্রাম সৈয়দাবাদ কলেজ পাড়ায়, যেই গ্রামের সন্তানেরা মহান মুক্তিযুদ্ধে লড়েছিল পাক-হানাদারদের বিরুদ্ধে। আল্লাহতায়ালার কাছে প্রার্থনা আমার তাঁর নিজ হাতে স্থাপন করা বাগান “জান্নাতুল ফিরদাউসে”  যেন ঠাঁই দেন আমার এই স্যারকে। যেখানে সৃষ্টিকর্তা রেখেছেন অফুরন্ত ও অসংখ্য সর্বপ্রকার নিয়ামত, চিরস্থায়ী, অনাবিল সুখ-শান্তি ও আনন্দ। যেই তলদেশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বিভিন্ন ঝর্ণাধারা এবং ভোগ বিলাসের অকল্পনীয় পূর্ণতা লাভের একমাত্র স্থান। অনন্য এই শিক্ষকের স্নৃতির প্রতি অযুত শ্রদ্ধাঞ্জলী।

Leave a Reply

Your email address will not be published.