তাজুল ইসলাম নয়ন॥ কেন সমগ্র পৃথিবীর একশত কোটিরও বেশী লোক খাদ্য, পানিয়, ধুমপান এবং যৌনকর্ম থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বিরত থাকে? তারা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী, যারা পবিত্র রমজান মাসে রোজা থাকে কারণ এই মাস রোজার মাস, রহমতের মাস, বিশেষ করে গুনাহ মাফের মাস, বরকতের মাস। রোজা ইসলাম ধর্মের পাঁচ স্তম্ভের মধ্যে একটি এবং ইসলামী এবাদতের একটি উচ্চতর পথ। জাগতিক আরাম-আয়েশ থেকে বিরত থাকা এবং মন্দ ইচ্ছা বাসনা দমন করাকে আল্লাহর বাধ্য ও বশীভুত থাকার কাজ হিসাবে গন্য করা হয়। এটিকে আবার পাপ, ভুল ও অন্যায়ের জন্য প্রায়শ্চিত করাকেও বুঝায়। রমজান মাসে ইসলাম ধর্ম অনুসারীগণ বা মুসলীম উম্মাহ্ সূর্যোদয় থেকে সূর্যান্ত পর্যন্ত রোজা থাকে। প্রতিদিন আল্লাহর উপর বিশ্বাস ও তাকে এবাদত করার উদ্দেশ্যে ইসলাম ধর্মানুসারীগণ রোজা করে। তারা নিজের ইচ্ছাকে দমন করতে চেষ্টা করে এবং তাদের আত্মীক ভক্তি বৃদ্ধি করে। বিশ্বব্যাপী এক সমাজ বা উম্মা হিসাবে রোজা থাকা এটা ভ্রাতৃত্ববোধ এবং আল্লাহর সম্মুখে সব মানুষ সমান তা নিশ্চিত করে। ইসলামিক পঞ্জিকা চাঁদের চক্রের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। রমজান মাস নবম মাস এবং এটা শুরু হয় নুতন চাঁদ এবং জ্যোতিবিদ্যার গণনার সমন্বয়ে। রমজানের সময় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় কিছুটা ভিন্নতা দেখা যায়। কারণ কেউ কেউ দৃঢ়ভাবে চাঁদ দেখার উপর নির্ভর করে আবার অন্যেরা বিজ্ঞানের উপর নির্ভর করে। একজন ইমাম (ইসলাম ধর্মে শিক্ষিত ব্যক্তি) রমজানের সঠিক সময় ঘোষনা দিবে ঠিক চাঁদ শুরু হওয়ার পূর্বে। এই রোজার সময়কাল শেষ হয় পরবর্তী নতুন চাঁদ দেখার পর, যেটা সাধারণতঃ ২৯ বা ৩০দিন পরে হয়ে থাকে।
রমজান নামটা আরবী মূল শব্দ রামিদা বা অর- রামাদ থেকে নেওয়া হয়েছে, যার অর্থ প্রচন্ড উত্তাপ ও শুষ্কতা, বিশেষভাবে জমি বা ভুমির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সেই একই মূল শব্দ থেকে এসেছে রামাদা, যার অর্থ হল, সূর্যকিরণে উত্তপ্ত বালু এবং সেই বিখ্যাত প্রবাদ বাক্য “কাল মুস্তাজীর মীনার রামাদা বিন্নার”- অর্থাৎ মন্দ অবস্থা থেকে আরও মন্দ অবস্থায় পড়া (কড়াই থেকে লাফিয়ে জ্বলন্ত আগুনে পরা)। কিছু লোক বলে থাকেন যে এরকম নামকরণ করার কারণ হল এই যে, সূর্য যেমন ভুমিকে দগ্ধ করে তেমনি রমজান সৎকর্ম দিয়ে পাপকে দগ্ধ করে দেয়। রমজান সব বয়সী ইসলাম ধর্মানুসারীদের মধ্যে আবেগ, উত্তেজনা এবং ধর্মীয় উদ্যোগ বয়ে নিয়ে আসে। যদিও শুধুমাত্র বয়স্কদের জন্য রোজা থাকার আদেশ দেওয়া হয়েছে কিন্তু দেখা যায় ৬-৮ বছর বয়সের শিশুরাও স্বেচ্ছায় বড়দের সঙ্গে রোজা পালন করে। শিশুরা চাঁদ দেখার জন্য এবং পরিবারের সাথে বিশেষ খাবার খাওয়ার জন্য উৎসাহী হয়ে থাকে। বয়স্করা আল্লাহর কাছ থেকে দ্বিগুন আর্শীবাদ পাবার আশায় এই সুযোগ গ্রহন করে ও পশ্চাত জীবনের পাপের জন্য ক্ষমা অনুসন্ধান করে। রমজান যেহেতু ইসলাম ধর্মে ভ্রাতৃত্ব এবং সম্প্রদায়কে প্রকাশ করে তাই প্রত্যেকে এই সময় স্রষ্টার নিকটবর্তী এবং পরিবার ও বন্ধু বান্ধবদের মধ্যে অত্যন্ত ঘনিষ্টতা অনুভব করে। ইসলাম ধর্মানুসারী বা মুসলীম উম্মাকে দীর্ঘ ৩০ দিনের এই রোজার সময় সম্পূর্ণভাবে শারিরিক এবং আবেগ অনুভুতির দিকে পরিবর্তন করতে হয়। একটি প্রকৃত রোজার দিন শুরু হয় ভোর ৪ঃ৩০ এর দিকে জেগে উঠে এবং একত্রে সেহেরী নামক ভোজনে অংশগ্রহন করার মধ্যদিয়ে। সেহেরী শেষ হয়ে থাকে সকাল ৫ঃ৩০টা আগে, দিন শুরুর পূর্বে। যখন ভোর হতে থাকে তখন প্রতিদিন পাঁচবার নামাজের প্রথম জামাতটি ফজর এর জন্য আহবান করা হয়। প্রত্যেক সময়ই ইসলাম ধর্মানুসারীগণ নিজেদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, তাদের রোজা থাকার প্রধান উদ্দেশ্য হলো আল্লাহকে খুশী করা এবং তাঁর দয়ার অনুসন্ধান করা। তারা শ্রদ্ধার সঙ্গে দুপুরের আগে ও পরে যথারীতি দ্বিতীয় এবং তৃতীয় নামাজ আদায় করে। রোজার মধ্যদিয়ে একজন ক্ষুদার্থ লোককে অনুভব করা যায় এবং পেট খালী থাকলে কেমন লাগে সেটি বোঝা যায়। রোজা একজনকে শিক্ষা দেয় দুর্ভাগা লোকদের দুঃখে সহভাগিতা করতে। ইসলাম ধর্মানুসারীরা বিশ্বাস করে যে রোজা একজনকে পরিচালনা করে আল্লাহর উদারতাকে উপলব্দি করতে, বঞ্চিতদের জন্য কৃতজ্ঞতা বোধ জন্মাতে। ইসলাম অনুসারীগণকে উৎসাহ দেওয়া হয় যে, সারাদিন ব্যাপি তাদের নিজস্ব পথে আর্থিক এবং মানষিক উভয় দিক দিয়ে অভাবী মানুষদেরকে সাহায্য করতে। কেউ কেউ বিশ্বাস করে যে, এই মাসের (সওয়াব) পুরস্কার সত্তরগুন বা তার চাইতে অধিক। এই মাসে যা খাওয়া- দাওয়া করা হবে তার কোন হিসাব নিকাশ হবে না। এই মাসে শয়তান বন্দি থাকে। বিভিন্ন কারণে রমজান মাসকে ত্যাগ ও উদারতার মাস বলা হয়।
একজন ইসলাম ধর্মানুসারীর কাছে রোজা অর্থ শুধু খাদ্য গ্রহন থেকে বিরত থাকাই নয়, কিন্তু সমস্ত অধার্মিকতা এবং সকল মন্দ কাজ যা আমরা সচেতন বা অসচেতন অবস্থায় করি তা থেকে বিরত থাকা বুঝায়। কারণ এটা বিশ্বাস করলে সারা বছর ধরে সমস্ত অনৈতিক বিষয় এবং কাজকে এড়িয়ে ভাল অবস্থায় থাকতে পারবে। সূর্যাস্তের সময় রোজা ভেঙ্গে ফেলা হয়। হযরত মোহাম্মদ (সঃ) খেজুর দিয়ে রোজা ভাঙ্গার সুপারিশ করেছিলেন, আরো বলেছেন অন্যদের সঙ্গে মিলে রোজা ভাঙ্গার জন্য। এই সমাবেশগুলিকে বলা হয় ইফতার পার্টি। ঠিক রোজা ভাঙ্গার পর এবং রাতের খাবারের পূর্বে ইসলাম ধর্মানুসারীগণ পাঁচবার নামাজের চতুর্থ নামাজটি করে থাকে যেটাকে মাগরিব বলা হয়। রাতের খাবারের পর তারা তাদের এবাদত গৃহে যায় এবং এশার নামাজ আদায় করে, দিনে পাঁচবার নামাজের মধ্যে এটি হল শেষ নামাজ। দিন শেষ হয় একটি বিশেষ ঐচ্ছিক নামাজের মধ্যদিয়ে যাকে বলে তারাবি নামাজ। এটা সম্মিলিতভাবে করা হয়। এই নামাজে কোরান আবৃত্তি করা হয়। ***** এই তারাবি নামাজ আদায় না করলে রোজা কবুল হবে না। যা জমিন এবং আকাশের মাঝে ভাসমান অবস্থায় থাকবে। তারাবি আদায় করলে রোজা আল্লাহর দরবারে পৌঁছিবে।
রমজান মাসকে তিনভাগে ভাগ করা হয়। প্রথম দশদিন রহমতের; ২য় দশদিন বরকতের, ৩য় দশদিন বা শেষ দশ দিন নাজাতের। আবার কেউ কেউ বর্ণনা করেছেন রমজান মাস অত্যান্ত আশির্বাদের বা ফজিলতের। বিশেষ করে ২৭তম রাতকে যাকে শক্তির বা ভাগ্যের রাত বলা হয়।
এটা বিশ্বাস করা হয় যে, ঐ রাতে মহানবী মুহাম্মদ (সঃ) কাছে প্রথম কোরআন প্রকাশিত হয়। অনেকের কাছে এই সময়টা আত্মীক গভীরতার সময় এবং তারা মুনাজাত ও কোরআন শরীফ আবৃত্তি করে এই রাতটি কাটিয়ে দেয়। ৩০ দিন রোজার পর রমজান মাস শেষ হয় একটি উৎসবের দিন পালনের মধ্যদিয়ে; তার নাম “ঈদ উল ফিতর”। এই দিন ইসলাম ধর্মানুসারীগণ বা মুসলিম উম্মাহ (গ্রামবাসী, মহল্লাবাসী, শহরবাসী) এক জায়গায় একত্রিত হয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায় ও খুৎবা এবং মোনাজাত এর মধ্যদিয়ে শেষ হয়। এই দিনটির প্রথা হল নতুন কাপড় পড়া, বন্ধু বান্ধবী আত্মীয় স্বজনদের দেখতে যাওয়া। উপহার বিনিময় করা উৎসব উপলক্ষে বিশেষ খাবার তৈরী করা এবং ধৈর্যধরে পরবর্তী বছরের জন্য অপেক্ষা করা। ঈদ মানে সার্বজনীন আনন্দ। ফিতর মানে নিবৃত্তি। মোট কথা ঈদুল ফিতর মানে কষ্ট থেকে নিবৃত্তি। রমজানের ফিতরা একমাত্র সৎপথে উপার্জিত অর্থ দ্বারা ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বেই দিতে হবে। ঈদের আনন্দ যদি সমগ্র ইসলাম বিশ্বাসী বিশ্ব একসাথে উপভোগ করতে না পারে তাহলে সেই আনন্দ কি অর্থবহ হয়। ঈদ মানে টাকার বাহাদুরী দেখানোর উপযুক্ত সময়। নানা বাহারের দামী পোষাক ইত্যাদি। ঈদে বিত্তবানরা যাকাত বা দান (সদকা) দেন। কারণ তা দেয়ার অর্থ হল লোক দেখানো এবাদত করা এবং বড়লোকী হাসেল করা। ঈদ মানে মজাদার খাবারের সমারোহ; বিশেষ করে বিত্তবানদের। ঈদ হল অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার হাতিয়ার। ব্যবসায়ীদের বারতী আয়ের উৎস। আমার ধর্মীয় শিক্ষকের কাছে শুনেছি এবং শিখেছিলাম যে রজমান মাস পবিত্র; এই মাসে শয়তান বন্ধি অবস্থায় থাকে কিন্তু এখন দেখি এই মাসেই শয়তান দ্বারা পরিচালিত হয়ে শয়তানের উদ্দেশ্য খাসেল বেশী হয়। মনে হয় এখন শয়তান মুক্ত হয়ে তাদের কাজ পরিচালনার ক্ষমতা পেয়েছে। ইফতার পার্টি একটি পবিত্রতার প্রতিক কিন্তু এখন এই ইফতার পার্টিটি রাজনৈতিক এবং বিভিন্ন স্বাথ্য হাছিলের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন ধর্মের মতালম্বিরা এই ইফতার পার্টির আয়োজন করে সরলমতা ও রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা লোকদের মন জয় করে থাকে। বর্তমান সমাজে ফিতরা ও যাকাত দেয়ার সমস্ত অর্থই অবৈধ পথে উপার্জন করার ফসল যার কুফল মাঝে মাঝে মৃত্যুর মধ্যেদিয়ে প্রকাশিত হয়। আমার গভেষনায় প্রতিয়মান হয় শতকরা ১০% ভাগ লোক একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এই রোজা এবং ঈদ পালন করেন, আর ৬০% তাদের অবৈধ পয়সার মহরার জন্য, ৩০% সামাজিকতা ও লোক দেখানো এবাদতের জন্য। এখানেই আমার প্রশ্ন আল্লাহ কি এই চান? তাঁর পরিকল্পনা কি এটাই?
ইসলাম ধর্মানুসারীগণ এই চন্দ্র পঞ্জিকা মেনে চলে, যা প্রতি বছর আনুমানিক ১০/১১ দিন এগিয়ে আসে। ২০১৭ সালের রমজান শুরু হয়েছে ২৭ মে বৃহস্পতিবার থেকে এবং শেষ হবে ২৭ জুন তারিখ (বিশেষ করে চাঁদ দেখার উপর নির্ভর করে)। নতুন চাঁদ দেখার উপর নতুন মাস শুরু নির্ভর করে, ফলে কোন কোন দেশে রমজান শুরুর তারিখ ভিন্ন হয়ে থাকে।