পাহাড়ে নিস্পেষিত মানুষের মৃত্যুর দায়ভার কার!

মৃত্যু যদিও বেদনার কিন্তু তা নিরন্তর শান্তির। আফসোসের, আক্ষেপের, বেদনার সর্বোপরি দোষারুপের। এই মৃত্যু যতই মধুর হোক না কেন তা কিন্তু প্রকারান্তরে কারো না কারো কাঁধে দায় চাপিয়ে যায়। জ¤িœলে মরিতে হইবে এই কথাটি যেমন সত্য তেমনি মৃত্যুর পর দোষারোপের বোঝাটিও সত্য। নানান উপায়ে- নানান মানুষের উপর, রোগের উপর, ঘটনার এমনকি সৃষ্টিকর্তার উপরও দায় চাপিয়ে নিরন্তর শান্তনাটুকুই খুঁজে ফিরে আপনজন, কাছের মানুষজন। যত আছানেই মৃত্যু হোক না কেন এর পক্ষে ও বিপক্ষে হাজারো যুক্তি এবং দায় চাপানোর খোঁড়া যুক্তি উপস্থাপিত হবেই। এটাই আমাদের বাঙ্গালী সমাজের রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার জন্মের পর থেকে আজ অব্দি কাছের ও দুরের এমনকি পরিচিত হাজারো জনের মৃত্যু পরখ করে এই দোষারোপের খোঁড়া যুক্তি এবং পক্ষে-বিপক্ষে নানান ধর্মীয় ইতি ও নেতিবাচক কথা শুনেছি। এই রেওয়াজ রীতি থেকে বের হয়ে আসার কোন উপায় কি আছে? হয়ত আছে কিন্তু এর সুত্র বা চর্চার ধারে কাছে আজও আমরা পৌঁছতে পাড়ি নাই।
এই মৃত্যু নিয়ে কথা বলা বা লিখা শেষ হওয়ার কোন আলামত বা প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত সৃষ্টিকর্তা কিয়ামতের আগ পর্যন্ত কাউকে দেননি এবং দিবেনও না। এটাই তাঁর আশ্চর্য ক্ষমতার একটি যা সৃষ্টির কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছেন। তিনিই সকল কিছু জানেন এবং করেন। তিনি নির্দোষ থাকার জন্য কোন না কোন উছিলায় পৃথিবী থেকে মানুষকে তার কাছে নিয়ে নেন। মৃত্যু একটি চিরাচরিত নিয়ম এবং এই নিয়মের উদ্ধে কেউ নন বা এর বাইরেও কেউ নন। মৃত্যুর স্বাদ একবার সবাইকেই গ্রহণ করতে হবে। কারো বেলা অতি শৈশবে আবার কারো বেলায় অতি বৃদ্ধে, মাঝে মাঝে কখনো কখনো যৌবনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিচ্ছেদে মানুষ মৃত্যুর স্বাদ গ্রহন করেন এবং সেই স্বাদ অন্যরকম এক বেদনারও হয়। মৃত্যু যদিও বেদনার কিন্তু এই বেদনারও আরো এক অন্যরকম বেদনার ইতিহাস রচিত হয়ে থাকে বিভিন্ন সময় সময়ের পরিক্রমাই। এই পরিক্রমাই ঘোরপাক খেয়ে মানুষ যখন ঘুরে দাঁড়ায় এবং নুতন করে আবার শুরু করে পৃথিবীর নিরন্তর জীবন যাপন আর তখন আবার ঘটে আরেকটি নির্মম ইতিহাসের- যা কখনো কখনো পুনরাবৃত্তিও বটে আবার কখনো কখনো নব্য আঙ্গিকে নতুন এক চেতনারও বটে।
আজকে শুধু একটি পুনরাবৃত্তির নব্য সারা ফেলানো বেদনার কাহীনির পেছনের দায় নিয়ে আলোচনা করতে চাই। এইতো আমরা শোকে কাতর আবার এই শোককে পাত্তা না দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সংগ্রামে ব্যস্ত। আবার কেউ কেউ এই মৃত্যু শোকের মাঝে আবার দুনিয়াবী লাভের আশায় লিপ্ত। কেউ বা ক্ষমতার লোভ নিয়ে এই শোককে বিকেন্দ্রিকরণ করে কিছু একটা করার পায়তারায় ব্যস্ত। মৃত্যু যদিও কারো গাড়ে দায় চাপিয়ে দিয়ে যায় কিন্তু সেই দায়কে পুঁজি করে কেউ কেউ আবার অন্যরকম দায় চাপানোর কাজে লিপ্ত হয়েছে। ক্ষমতা এবং ক্ষমতার বাইরে অবস্থানকারী দুই গ্রুপে এখন ব্যস্ত কিভাবে এই মৃত্যুর দায় অন্যের ঘারে চাপিয়ে ফায়দা লোটা যায়। সর্বোপরি এই দায় কার!
এই দায় কি আমার, আপনার নাকি যারা পরিস্থিতির স্বীকারে পরিণত মৃত্যুকুলে আবদ্ধ সেইসকল মৃত মানুষদের। নাকি পার্বতাঞ্চলী পাহারের সন্নিকটে বসবাসকারী ঐ জনসমাজের। নাকি সরকারের, প্রশাসনের, পরিবেশবাদীদের, রাষ্ট্রের। আসলে এই দায় কারোরই না। এই দায় লোভ এবং মৃত্যু নামক শব্দটির। কেউ আবার দায় চাপানোর চেষ্টা করেন প্রাকৃতিক দুর্যোগের। সবই একটি খেলা আর এই খেলার পিছনে রয়েছে সৃষ্টিকর্তার অসীম ক্ষমতার ছাপ বা প্রকাশের আশ্চর্য দিকদর্শন। বিশেষ করে তিনি তাঁর সৃষ্টিকে সতর্ক এবং ব্যালেন্স করনার্থে কিছু বাস্তব শিক্ষা দেয়ার নিমিত্তে এই সকল ঘটনার বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করতে সাহায্য করেন মাত্র। মহান রাব্বুল আল আমিন বলেছেন, ‘‘লোভ মানুষকে মৃত্যুর কোলে পতিত করে, লোভ এর পুর্ণতাই পাপের জন্ম হয়। আর পাপের পূর্ণতাই মত্যৃর জন্ম হয়। কখনো কখনো মৃত্য হয় রূহানীক আর কখনো কখনো মৃত্যু হয় পৃথিবী থেকে বিদয়া নেয়ার বা পৃথীবির চ্যাপ্টার ক্লোজ করার”। আমি ঐ মৃত্যুর দায় কারো উপর না চাপালেও প্রকারান্তরে ঐ অঞ্চলে বসবাসকারীদের উপরই বর্তায়। প্রকারান্তরে মৃত্যু লাশগুলোও এর দায় থেকে রেহাই পায়নি। আল্লাহ আমাদের জ্ঞান দিয়েছেন যাতে ঐ জ্ঞান পরিপূর্ণরূপে ব্যবহার করে নিজেদেরকে রক্ষা করে অন্যদের সাহায্যে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতে পারি। কিন্তু ঐ মৃত্যুগুলো জ্ঞানের ব্যবহার করা হয়েছে এমন কোন আলামত আমাদের সামনে হাজির করাতে ব্যর্থ হয়েছে।
সরকার এবং প্রশাসন যন্ত্রের তাদের প্রচেষ্টার কোন কমতি বা ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়নি। গত ১৫ বছর যাবৎ এই খন্ডকালীন মৃত্যুর মহড়ার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বলতে পারি দিনকি দিন আমাদের সরকার যতেষ্ঠ আন্তরিকতার সাহিত জনগণের জাম-মাল রক্ষাকল্পে সকল ধরণের পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিন্তু সেই পদক্ষেপে আমরা যারা সারা দেইনি এমনকি বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে নিজেদের লোভ চরিতার্থ করতে চেষ্টা করেছি সেই তাদেরই কল্যাণে বার বার আমরা এই মৃত্যুর যন্ত্রনা ভোগ করছি এবং দেশবাসী শোক সাগরে ভাসছে। সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষে যা যা করনীয় তার সবটুকুই করেছে এমনকি কঠোরতাও অবলম্বন করা হয়েছে… কিন্তু ফল কি? হয়ত ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ কমেছে কিন্তু শুন্যের কোটায় নামানো সম্ভব হত যদি আমরা সকলে মিলে সরকারকে সহযোগীতা করতাম।
কবে আমরা হব পরিপূর্ণ সচেতন? কবে বুঝতে শিখব আমার জীবন রক্ষা আমাকেই করতে হবে। সরকার বা সমাজ আমাকে জীবন রক্ষা করে দিবে না। বরং আমাকেই আমার জ্ঞান ব্যবহার করে এই কাজটুকু করতে হবে এবং সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহযোগীতা করে নিজেকে এবং অন্যকে বাঁচার ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে হবে। যারা ক্ষতিগ্রস্থ তাদের প্রতি সম্পূর্ণ সহানুভুতি ও সহমর্মিতা প্রকাশ করেই বলছি যদি আগে থেকে সাবধান হয়ে অন্যত্র সরে যেতাম বা সাময়িকভাবেও সরে যেতাম তাহলেও হয়ত জীবনের এমন অপুরনীয় ক্ষতি সাধিত হতো না। বরং এর থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী দিনে যাতে এমন ক্ষতির সম্মুখীন হতে না হয় সেই লক্ষ্যে স্থানীয়ভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করে পরিকল্পিত জীবন-যাপন করতে প্রস্তুত করনার্থে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হউক। পাশাপাশি সরকারকে বলব এই ধরণের ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে যারা বসবাস করে তাদেরকে পুর্ণবাসন এমনকি এরমধ্যে যারা অসহায় তাদেরকে স্থায়ীভাবে বসবাসের বসতভিটা প্রস্তুত করে সরকারের ছত্রছায়ায় জীবন যাপনের ব্যবস্থা করে দেয়া হউক। পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন, এমপি, মন্ত্রী এবং সম্পদশালী মানুষদেরও এগিয়ে এসে এই চলমান জীবননাশী সমস্যার একটি সমাধান খুঁজে বের করা এবং সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা এখন সময়ের দাবী।
প্রধানমন্ত্রী দেশ ও এদেশের মানুষের কল্যাণে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন এবং এই মৃত্যু শোখ বহন করে বারবার চোখের জলের পুনরাবৃত্তি চান না। তিনি স্পষ্টই বলেছেন এই সমস্যার সমাধান আশু করতে এবং জান মালের ক্ষয়-ক্ষতিরও তালিকা তৈরী করে পুর্নবাসনে শতভাগ কাজ করতে। যা যা প্রয়োজন সবকিছুই যেন সম্পন্ন করা হয়। এই আহবানে সাড়া দিয়ে আমাদের সকলের যার যার অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে এবং সরকারের সহযোগীতা গ্রহণ করে সেই পরিকল্পনা পরিপূর্ণ করে এগিয়ে যেতে হবে। এখানে কোন রকম শিথিলতা দেখানোর সুযোগ নেই। কারো কোন গাফিলতিও বরদাস্ত না করার স্পষ্ট ঘোষণা প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন। আগামী দিনে যেন হয় শান্তি, স্থিতিশীল নিশ্চয়তা এবং জীবন যাপনের দীর্ঘস্থায়ী একটি সমাধান সেই লক্ষ্যে এই পদক্ষেপকে স্বাগত ও সহযোগীতা করা একান্ত কাম্য। আমরা বিশেষ করে পাহাড়ে এবং তৎসন্নিকটে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে বলতে চাই আপনাদের রক্ষা করা যেমন আমাদের সকলের দায়িত্ব তেমনি আমাদের আহবান ও সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহয়োগীতা করে আপনাদের আগামী সুনিশ্চীত করাও আপনাদের দায়িত্ব। এই সুযোগ নষ্ট না করে এখই ঝাপিয়ে পড়–ন এবং ক্ষত না শুকাতেই এর স্থায়ী সমাধান করুন। এই ধরণের চলমান কান্নার পুনরাবৃত্তি আর দেখতে চাই না এমনকি বদ্ধ হউক এই কান্না, নিশ্চিত হউক সমতার এবং সমঅধিকার ও সুনিশ্চিত ভবিষ্যতের। মুক্তি চাই খোঁড়া যুক্তিনির্ভর দায় চাপানো দোষারোপের দায়ভার থেকে। পাশ্চাত্যের ন্যায় আমরাও বুঝতে শিখি এবং পারি সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা, আখাঙ্খা এমনকি জীবনের প্রতিটি মুহুত্ব উপভোগের এবং মানব কল্যাণের নিমিত্তে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার অভিলাষে।
যারা মৃত্যুবরণ করেছেন এবং যারা ঐ শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্য তাদের সঙ্গে সহমত ও সহমর্মিতা প্রকাশ করে আগামীর সুখ ও সমৃদ্ধি নিশ্চিতকল্পে এগিয়ে যেতে চাই সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনায় মিলিত হয়ে। আমাদের আগামী হউক কান্নাবিহীন এক সুখ সা¤্রাজ্যের এবং পাপ ও লোভ বিহীন এক স্বর্গোদ্যান হিসেবে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত নব দিগন্তের নব উন্মোচন ও আল্লাহর মহা রহমতের আশির্বাদস্বরূপ। জয় হউক বাংলার মানুষের এবং উন্নয়নমূখী সরকারের। পরাজয় হউক সকল অপসংস্কৃতি ও শয়তানের ও তাঁর পরিকল্পনার।

Leave a Reply

Your email address will not be published.