মানুষের জীবনে ইন্টারনেট /আন্তর্জাল

তাজুল ইসলাম (হানিফ)॥ ইন্টারনেট হল সারা পৃথিবী জুড়ে বিস্তৃত, পরস্পরের সাথে সংযুক্ত অনেকগুলো কম্পিউটার নেটওয়ার্কের সমষ্টি যা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত এবং যেখানে আইপি বা ইন্টারনেট প্রটোকল নামের এক প্রামাণ্য ব্যবস্থার মাধ্যমে ড্যাটা আদান-প্রদান করা হয়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে অনেকে ইন্টারনেট এবং ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবকে সমার্থক শব্দ হিসেবে গণ্য করলেও প্রকৃতপক্ষে শব্দদ্বয় ভিন্ন বিষয় নির্দেশ করে।
আরো বলা যাই যে, ইন্টারনেট হচ্ছে ইন্টারনেট্ওয়ার্ক (রহঃবৎহবঃ হবঃড়িৎশ) এর সংক্ষিপ্ত রূপ। এটা বিশেষ গেটওয়ে বা রাউটারের মাধ্যমে কম্পিউটার নেটওয়ার্কগুলো একে-অপরের সাথে সংযোগ করার মাধ্যমে গঠিত হয়। ইন্টারনেটকে প্রায়ই নেট বলা হয়ে থাকে। ইন্টারনেট এবং ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব এক নয়। ইন্টারনেটের হার্ডওয়্যার এবং সফ্টওয়্যার পরিকাঠামো কম্পিউটারসমূহের মধ্যে একটি আন্তর্জাতিক তথ্য যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করে। বিপরীতে, ওয়েব ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রদত্ত পরিষেবাগুলির একটি। এটা পরস্পরসংযুক্ত কাগজপত্র এবং অন্যান্য সম্পদ সংগ্রহের, হাইপারলিংক এবং টজখ-দ্বারা সংযুক্ত।
১৯৬০-এর দশকে মার্কিন সামরিক বাহিনীর গবেষণা সংস্থা অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্ট্স এজেন্সি বা আরপা (অজচঅ) পরীক্ষামূলকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাগারের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। প্যাকেট সুইচিং পদ্ধতিতে তৈরি করা এই নেটওয়ার্ক আরপানেট (অজচঅঘঊঞ) নামে পরিচিত ছিল। এতে প্রাথমিকভাবে যুক্ত ছিল। ইন্টারনেট ১৯৮৯ সালে আইএসপি দ্বারা সবার ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। ১৯৯০ এর মাঝামাঝি থেকে ১৯৯০ এর পরবর্তি সময়ের দিকে পশ্চিমাবিশ্বে ইন্টারনেট ব্যাপক ভাবে বিস্তৃত হতে থাকে।
গত ২০ই জুন ইত্তেফাক পত্রিকায়  ইকরাম কবীরের লেখা “জীবনের জন্য ইন্টারনেট” কলামটি পড়ে অসম্ভব ভালো লেগেছে। তাঁর দেয়া তত্ব মতে,  উদ্ভাবন আর আবিস্কারই পৃথিবী বদলে দিয়েছে। টেলিফোন, প্রিন্টিং প্রেস, টেলিভিশন, রেডিও, রেলওয়ে, অটোমোবাইল—সব উদ্ভাবন আমাদের জীবনকে বদলে দিয়েছে। বদলে দিয়েছে আমাদের সমাজ। মানুষের সঙ্গে সংযোগ বাড়িয়েছে এই আবিষ্কারগুলো। যখন অনেক মানুষ একত্র হয়, তখনো অনেক চমৎকার বিস্ময়কর কাজ করা যায়। সংযোগ ঘটলেই আমরা মানুষের সঙ্গে মিশতে পারি, নতুন তথ্য অনুসন্ধান করতে পারি। সংযোগ হলেই নতুন কর্মক্ষেত্র, সুযোগ আর ধারণার খোঁজ পেতে পারি। প্রযুক্তি কখনোই একা উন্নত হতে পারে না। প্রযুক্তির বিকাশ পুরো সমাজব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে। ইন্টারনেট সংযোগ শুধু মুষ্টিমেয় ধনী কিংবা শক্তিশালী মানুষের জন্য নির্দিষ্ট হতে পারে না। এটা সবার জন্য উন্মুক্ত সুযোগ।
বিজ্ঞান, শিক্ষা আর গবেষণাকে গুরুত্ব দেওয়ার ফলেই এমন অসাধ্য সাধন হয়েছে। এখন এর সঙ্গে ইন্টারনেটকে গুরুত্ব দিতেই হবে। ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে অনেক মানুষের জীবন বদলে দেওয়া সম্ভব। বর্তমানে সারা পৃথিবীর মাত্র এক-তৃতীয়াংশ মানুষের ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ আছে। আর দুই-তৃতীয়াংশের বেশি মানুষ এখনো ইন্টারনেট সংযোগের বাইরে। বর্তমানে ২.৭ বিলিয়নের মতো মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে। আর ৪.৪ বিলিয়ন মানুষের ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ নেই। এদের মধ্যে ৩.৪ বিলিয়ন মানুষের বাস মাত্র ২০টি দেশে, উন্নয়নশীল ও দারিদ্র্যপীড়িত দেশগুলোতেই তাদের বসবাস।
ভারতে ২৪ কোটির মতো মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পায়। আমি বিশ্বাস করি, কানেকটিভিটি হচ্ছে মানবাধিকার। আমাদের এই প্রজন্মের মানুষদের পৃথিবীকে সংযুক্ত করাই বিশাল বড় এক চ্যালেঞ্জের কাজ। ইন্টারনেট যেন সবাই ব্যবহার করতে পারে তার জন্য আমাদের কাজ করতে হবেই।
বিশ্বব্যাংক গত বছর তাদের একটি গবেষণায় বলেছিল, বাংলাদেশে ৯০ ভাগ মানুষ এখনো ইন্টারনেট ব্যবহার করে না। নব্বই ভাগ অর্থ প্রায় ১৫ কোটির কাছাকাছি। ওদিকে বাংলাদেশ সরকারের হিসাবে ছয় কোটিরও বেশি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। এই দুই পরিসংখ্যান মিলছে না। বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের গণনার পদ্ধতি ভিন্ন, মতামত ভিন্ন। এই ভিন্নতা কেন হচ্ছে তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবে এটুকু আশা করা যায় যে এই দুই পক্ষ একসঙ্গে কাজ করলে একটি চিত্র পাওয়া যেতে পারে।
আমি ইন্টারনেট শুধুই নিজের জ্ঞান বাড়ানোর কাজে ব্যবহার করেছি। এখনো করে যাচ্ছি। মনে হয়েছে এটাই তো বিশ্বের সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি। কী নেই সেখানে! বই, প্রবন্ধ, ভিডিও, অডিও সব।
ইন্টারনেট সারা বিশ্বের কোটি-কোটি মানুষের জীবন বদলে দিয়েছে, জীবনের মানোন্নয়ন করেছে  পুরো সভ্যতার চেহারাকে বদলে দিয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশেই ইন্টারনেট মানুষের জীবনযাত্রার অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার কথাই ধরুন। মানুষ অফিসে বসেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে জানছে তাদের ফ্রিজে কী কী খাবার আছে এবং কী কী নেই; আজ কী খাবার কিনে বাড়ি ফিরতে হবে। এটি কী করে সম্ভব হচ্ছে? ইন্টারনেটকে যন্ত্রের সাথে জুড়ে দিয়েই এ কাজ করা হচ্ছে। দিনে দিনে সব যন্ত্রের সাথেই ইন্টারনেট যুক্ত হচ্ছে, সব জিনিসের সাথেই ইন্টারনেট যুক্ত হচ্ছে; এক যন্ত্রের সাথে আরেক যন্ত্র ‘কানেক্টেড’ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের টেবিল-চেয়ার থেকে শুরু করে চায়ের কাপ, থালা-বাসন, গাড়ি-সাইকেল সবকিছুই ‘কানেক্টেড’ হয়ে যাচ্ছে। এক যন্ত্র আরেক যন্ত্র সম্পর্কে তথ্য পাচ্ছে। এ সবই হচ্ছে মানুষের কাজে সাহায্য করার জন্য। গুগল ও ফেসবুকের মতো কোম্পানিগুলো যন্ত্রের সাথে ইন্টারনেট যুক্ত করে যন্ত্রকে মানুষের ব্যক্তিগত সহকারীতে পরিণত করছে।
ইন্টারনেট নিজের উন্নয়নে ব্যবহার করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে ব্যবসায়ী ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ সজাগ। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান যারা ইন্টারনেট নিয়েই ব্যবসা করেন, তারা স্কুল-কলেজের ছেলে-মেয়েদের এর সঠিক ও নৈতিক ব্যবহার শেখানো শুরু করেছে। এই শিক্ষার প্রসার প্রয়োজন।
ইন্টারনেট ব্যবহারের আবার অনেক বিপজ্জনক দিকও আছে। হ্যাকাররা ওত পেতে আছে আপনার ব্যাংক একাউন্টে হামলা করার জন্য, মানুষ অযথা কাজের সময় নষ্ট করছে সামাজিক মাধ্যমে, অনেকে পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়ছেন, অনেকে আবার জঙ্গিবাদ শিখছেন। হ্যা, অবশ্যই অনেক অন্ধকার দিক আছে ইন্টারনেট-দুনিয়ার।
ইন্টারনেট-দুনিয়াকে আমরা যত বড় মনে করি এটা তার চেয়েও বড়। সে কারণেই মানুষ এখনো বুঝে উঠতে পারছেন না নিজেকে কীভাবে এই দুনিয়ায় বসবাসের যোগ্য করে তুলবেন। তবে আমরা এটুকু বুঝি যে এই ইন্টারনেট-দুনিয়াই আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যত্ পৃথিবী। ইন্টারনেট আমাদের জীবনের উন্নয়নের কাজে যত বেশি ব্যবহার করা যায়, ততই ভালো।
তাই আমি জোর দিয়ে বলতে চাই,… ইন্টারনেট সবার জন্য কী করে সহজলভ্য করা যায় তা ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে এই রাষ্ট্র তথা পুরো সমাজের। ইন্টারনেট সংযোগের আওতায় সকল মানুষকে আনার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। আমাদের প্রজন্মের জন্য সারা বিশ্বকে এক করাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

Leave a Reply

Your email address will not be published.