ফিরে দেখা আওয়ামী লীগের আটষট্টি বছর

বিপ্লব চক্রবর্তী॥ ২৩ জুন আওয়ামী লীগের আটষট্টিতম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৪৯ সালের এই দিনে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্থানের শোষিত-বঞ্চিত মানুষের পক্ষে শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, আবুল হাশিম, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, আতাউর রহমান খান, ইয়ার মোহাম্মদ প্রমুখ প্রবীণ-নবীন নেতৃবৃন্দ মুসলিম লীগের অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আচরণের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর নিখিল ভারত মুসলিম লীগ রূপান্তরিত হয় পাকিস্তান মুসলিম লীগ নামে। মুহম্মদ আলী জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান, নূরুল আমিন, চৌধুরী খালিকুজ্জামান, খাজা নাজিমউদ্দিনসহ মাত্র কয়েকজন নেতার পকেটে বন্দী হয় পাকিস্তান মুসলিম লীগ । নিজেদের স্বার্থে পাকিস্তান মুসলিম লীগ ব্যবহার হয়।
পূর্ববঙ্গের মুসলিম লীগ নেতাদের মধ্যে মওলানা আকরম খাঁ, খাজা নাজিম উদ্দিন, খুররম খান পন্নী, শাহ আজিজুর রহমান, নূরুল আমিন, সবুর খানদের ছাড়া কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ আর কাউকে বিশ্বাস করেনি। প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম প্রগতিশীল রাজনৈতিক ঘরানার নেতা ছিলেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক শিষ্য শামসুল হক, আতাউর রহমান খান, আবুল হাশিম, শেখ মুজিবুর রহমান, ইয়ার মোহাম্মদ, আনোয়ারা খাতুন প্রমুখ নেতা পূর্ববঙ্গের জনগণের জন্য রাজনীতি করতেন।
পাকিস্তান মুসলিম লীগ যেহেতু মুষ্টিমেয় কয়েকজন নেতার হাতে বন্দী ছিল এবং সরকারী রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচালিত হচ্ছিল সেহেতু শহীদ সোহরাওয়ার্দী একটি গণতান্ত্রিক ও মুসলিম লীগ বিরোধী রাজনৈতিক দল গঠনের চিন্তা করেছিলেন। পাঞ্জাবের মুসলিম লীগ সভাপতি ইফতিখার উদ্দিন, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মানকী শরীফের পীর ও আসাম প্রদেশের সভাপতি মওলানা ভাসানী আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনে শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছিল।
পূর্ব বঙ্গের পুরনো ঢাকার ১৫০ মোগলটুলি ‘ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’(কর্মী শিবির) অফিসে আবুল হাশিম বসতেন। এই ক্যাম্পের অন্যতম সদস্য ছিলেন আতাউর রহমান খান, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, মোশতাক আহমেদ, ইয়ার মোহাম্মদ, মিসেস আনোয়ারা খাতুন, কামরুদ্দিন আহম্মেদ প্রমুখ। উল্লেখ্য, ১৯৪৪ সালে শামসুল হক পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগ কর্মী শিবির (‘ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’) নামে ১৫০ মোগলটুলিতে (‘ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’) অফিসটি খোলেছিলেন। ১৯৪৩ সালে আবুল হাশিম বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলে প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মকান্ডের প্রসার ঘটে এই ১৫০ মোগলটুলিতে।
প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আকরম খাঁ ও খাজা নাজিমউদ্দিন, নূরুল আমিন জোট কখনও চাননি শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুসারী তরুণ নেতৃবৃন্দ মুসলিম লীগের সঙ্গে যুক্ত থাকুক। ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের তরুণ নেতৃবৃন্দ মওলানা আকরম খাঁর কাছে মুসলিম লীগের প্রাথমিক সদস্যপদের রসিদ বই চাইলে আকরম খাঁ রসিদ বই দিতে অস্বীকৃতি জানান। পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সভাপতি চৌধুরী খালিকুজ্জামানও একই কথা বলে দেন পূর্ববঙ্গের আতাউর রহমান ও আনোয়ারা খাতুন কেন্দ্রীয় সভাপতির সঙ্গে দেখা করতে গেলে।
পাকিস্তান মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক নেতাদের কখনই পাকিস্তানের রাজনীতিতে জায়গা দিতে চায়নি। দেশভাগের পূর্বে ১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় সম্ভব হয়েছিল একমাত্র শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে অথচ দেশভাগের পর পূর্ব বঙ্গের প্রধানমন্ত্রী করা হয় খাজা নাজিম উদ্দিনকে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে পাকিস্তানের মূল ভূখন্ড ও রাজনীতির মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো। শুধু তাই নয় ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব বাংলাকে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান এবং কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, মুদ্রা ব্যবস্থা ও বাংলাকে রাষ্ট্রভভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদান, বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদকরণ এবং ভূমিহীনদের মাঝে উদ্বৃত্ত জমি বিতরণ, আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী সমবায় কৃষি ব্যবস্থা, শিল্প শ্রমিকদের সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠাকরণ ও অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন পূর্ব বাংলার জনগণের প্রাণের দাবি ছিল। কিন্তু মুসলিম লীগ সরকার এসব দাবির প্রতি কোন গুরুত্ব দেয়নি।
উপরন্তু দেশ ভাগের আগে পূর্ববঙ্গের কাঁচা পাট প্রক্রিয়াকরণে ভারত যেসব সুবিধা দিয়ে আসছিল তা প্রত্যাহার করে নিলে এ অঞ্চলের কাঁচা পাটের ব্যবসায়ীরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাটের রফতানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৪৯ সালে আদমজী জুট মিলস্ প্রতিষ্ঠাকরা হলে ‘জুট বোর্ডে’ বাঙালী কোন সদস্য স্থান পায়নি। নানাভাবে বঞ্চিত পূর্ববঙ্গের শিল্প মালিক, ব্যবসায়ী, শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এরকম একটি আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ১৫০ মোগলটুলির ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের নবীন ও প্রবীণ নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে কে এম দাশ লেনের বশীর উদ্দিনের রোজ গার্ডেনের বাড়ির হল রুমে জন্ম হয় আওয়ামী মুসলিম লীগের।
সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, সম্পাদক টাঙ্গাইলের শামসুল হক। সহ-সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫১ সালে শামসুল হক কারাবন্দী হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে শেখ মুজিবুর রহমান ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হন। ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিতব্য প্রাদেশিক নির্বাচনে মুুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিযোগিতা করতে ১৯৫৩ সালে ময়মনসিংহে আওয়ামী মুসলিম লীগের বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশনে গঠন করা হয় ‘যুক্তফ্রন্ট’ । ১৯৫৩ সালের ১৪-১৬ নভেম্বর ঢাকায় মুকুল সিনেমা হলে আওয়ামী মুসলিম লীগের দ্বিতীয় কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এ কাউন্সিলে শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ২১ দফা প্রণয়ন ও অভূতপূর্ব বিজয় অর্জনের পেছনে শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। মুসলিম লীগের বড় বড় নেতা আওয়ামী মুসলিম লীগের তরুণ নেতাদের কাছে পরাজিত হন। যুক্তফ্রন্টের বিজয় মুসলিম লীগ কেন্দ্রীয় নেতরা ভালভাবে নিতে পারেনি। ফলে মাত্র তিন মাসের মাথায় এ কে ফজলুল হকের যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত করেন।
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করা সহজ ছিল না। বৈরী পরিবেশের মধ্যেও ১৯৫৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর রূপমহল সিনেমা হলে আওয়ামী মুসলিম লীগের তৃতীয় কাউন্সিল অুনষ্ঠিত হয়। এ কাউন্সিলে মওলানা ভাসানী সভাপতি ও শেখ মুজিবুর রহমান পুন:সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত ইচ্ছা ও উদ্যোগে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধানে ‘বাংলা’কে পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ জোরাল ভূমিকা রাখেন এবং তা কার্যকর করেন।
১৯৫৭ সালের ৭-৮ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের কাগমারীতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের চতুর্থ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এ কাউন্সিলে সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও সাধারণ স¤পাদক হন শেখ মুজিবুর রহমান। প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বিদেশ নীতির সঙ্গে একমত হতে না পেরে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করে মওলানা ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন। ফলে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হন মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ ও সাধারণ সম্পাদক হন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫৭ সালের ১৩-১৪ জুন বিশেষ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা শাবিস্তান সিনেমা হলে। এ কাউন্সিলে সভাপতি হন মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ ও সাধারণ সম্পাদক হন শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৫৬ সালে ইস্কান্দার মির্জা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন। ১৯৫৮ সালে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করেন। আইয়ুব খান নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে পাকিস্তানের সংবিধান বাতিল এবং পাকিস্তানের সকল রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করেন। সামরিক শাসনের মধ্যে জনগণের মানবিক অধিকার ক্ষুণœœ হতে থাকলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ঘরোয়াভাবে নানা কর্মসূচী পালন ও সকলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। ১৯৫৯ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের কথা থাকলেও সামরিক শাসনের কারণে তা হয়নি। উপরন্তু বেসিক ডেমোক্র্যসি নামে ইউনিয়ন পরিষদের ৮০ হাজার সদস্যদের ভোটে আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট হন এবং ১৯৬২ সালে নিজের তৈরি সংবিধান চালু করেন। পাকিস্তানের এরকম বৈরী রাজনৈতিক পরিবেশে ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের এক জরুরী সভা আহ্বান করেন। ওয়ার্কিং কমিটির সকল সদস্য, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যবৃন্দ বৈঠকে উপস্থিত থেকে সিদ্ধান্ত নেন দলের কাউন্সিল অধিবেশনের। ১৯৬৪ সালের ৬-৮ মার্চ জাস্টিস ইব্রাহিম সাহেবের আমবাগানে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পঞ্চম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এ কাউন্সিলে দলের সভাপতি হন মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৬৫ সালে ১৭ দিন স্থায়ী ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের জনণণের প্রতি পাকিস্তান সরকারের উদাসীনতা ও অরক্ষিত পূর্ব পাকিস্তানের ভূখন্ডের নিরাপত্তা হুমকির বিষয়টি সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানকে বিচলিত করে তোলে। পূর্ব পাকিস্তান জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ভূখন্ডের নিরাপত্তার প্রশ্নে শেখ মুজিবুর রহমান জনগণকে সচেতন করে তোলেন এবং লাহোরে মুসলিম লীগের অধিবেশনে ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বাঙালীর মুক্তির সনদ ছয় দফা পেশ করেন।
১৮-২০ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান ইডেন হোটেলে দলের ষষ্ঠ কাউন্সিল আহ্বান করেন। এই কাউন্সিলে সভাপতি হন শেখ মুজিবুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক হন তাজউদ্দীন আহমদ। উল্লেখ্য, মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ কাউন্সিলে যোগ না দিয়ে তার অনুসারীদের নিয়ে সম্মেলন বয়কট করেন। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। ঐতিহাসিক ছয় দফা এই অধিবেশনেই আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির অনুমোদন লাভ করে। শেখ মুজিবুর রহমান দলের সভাপতি হয়েই তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি অসীম ভালবাসার প্রথম নিদর্শন হিসেবে বাঙালীর মুক্তির সনদ ছয় দফা রচনা ও উস্থাপন করেন।
১৯৬৭ সালের ১৯ আগস্ট পুরানা পল্টন অফিসে আওয়ামী লীগের সপ্তম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এই কাউন্সিলে শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি ও তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক পুন:নির্বাচিত হন। পূর্ব পাকিস্তানের গ্রাম থেকে গ্রামে, শহরে, বন্দরে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ছয় দফার প্রচারণা যখন তুঙ্গে সেমুহূর্তে ১৯৬৮ সালে তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে শেখ মুজিবসহ সামরিক বেসামরিক ৩৪ জনের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করেন। ১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে গণআন্দোলন শুরু হলে ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে বাধ্য হোন। ২৩ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ২৫ মার্চ ১৯৬৯ সেনাবাহিনী প্রধান ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা দিয়ে পদত্যাগ করেন।
১৯৬৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করে ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন ১৯৭০ সালের ৫ অক্টোবর পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ ও ২২ অক্টোবর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ইয়াহিয়া খান সকল রাজনৈতিক দলের কার্যক্রমের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়। ১৯৭০ সালের ৪ জুন আওয়ামী লীগের অস্টম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় । এই কাউন্সিলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি ও তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
সত্তুরের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে ১৭০টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন লাভ করে। ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোর পরামর্শে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে গড়িমসি করে। অনেক আলোচনা সমালোচনার পর ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে বলে ইয়াহিয়া খান ঘোষণা দিলেও শেষ পর্যন্ত ভুট্টোর চাপে ১ মার্চ অধিবেশন স্থগিত করেন। বঙ্গবন্ধু অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে ২ থেকে ৬ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে হরতালের ডাক দেন এবং ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লক্ষাধিক জনতার সমাবেশে বলেন ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দিব তবু এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশআল্লাহ।’ ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’ জয় বাংলা। ২৫ মার্চ ৭১ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন পুনরায় বসবে বলে ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করলেও অধিবেশন না বসে ২৫ মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে হত্যার উদ্দেশ্যে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ চালিয়ে রাতের অন্ধকারে বাঙালীদের হত্যার নক্সা বাস্তবায়ন করা হয়। বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের পর বাঙালীর বিজয় অর্জিত হয়। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
১৩ জানুয়ারি ১৯৭২ মন্ত্রিপরিষদের প্রথম সভায় জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা গান ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি..’ ও রণ সঙ্গীত হিসেবে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা কবিতা ‘চল চল চল.. অনুমোদন দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী হয়ে বঙ্গবন্ধু দলের নবম কাউন্সিল করেন ১৯৭২ সালের ৮ এপ্রিল। এই কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি ও জিল্লুর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সদ্য স্বাধীন দেশের সংবিধান প্রণয়ন ও তা কার্যকর করেন ১৯৭২ সালের ৪ নবেম্বর। স্বাধীনতার পরপরই মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী ভারতের সৈন্যদের দেশে ফিরিয়ে নেয়া হবে কবে তা নিয়ে জল্পনা কল্পনা শুরু হলে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ ভারতের সেনাবাহিনীকে তাদের দেশে ফেরত পাঠান। চলবে… লেখক : ড. মাহবুব মোমতাজ, তেজগাঁও কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের বিভাগীয় প্রধান।

Leave a Reply

Your email address will not be published.