সৌদী রাজবংশের শাসনও উৎখাত হয়ে যেতে পারে

ছানাউল্লা সুমন, রিয়াদ প্রতিনিধি॥ ১৮৩৯ সালে সুলতান আব্দুল মজিদ অটোম্যান সাম্রাজ্যের আধুনিকায়ন এবং ইউরোপের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য কিছু আইনী, প্রশাসনিক এবং সামাজিক সংস্কার করেছিলেন। যা ইতিাহসে অটোম্যান তানজিমাত নামে পরিচিত। তার পিতা সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ যে আধুনিকায়ন শুরু করেছিলেন তারই ধারাবাহিকতায় তিনিও ওই তানজিমাত সংস্কার করেছিলেন। ১৮০৮ সালে ক্ষমতায় এসেই সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ সেনাবাহিনীর সংস্কারে মনোযোগ দেন। এই সংস্কার কাজ সর্বশেষ অটোম্যান সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ পর্যন্ত চলেছিল। যাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করা হয় ১৯০৯ সালে।

Saudi rajtontra is difficulties
তানজিমাতের ওই সংস্কার শেষ পর্যন্ত ছয়শত বছর ধরে বিরাজমান অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়েছিল। এছাড়াও আরো অনেক কারণ ছিল অট্যোম্যানদের পতনের পেছনে, যেমন, রাষ্ট্রীয় বন্ধ্যাত্য এবং অনমনীয়তা। তবে অটোম্যানদের পতনের সবচেয়ে বড় কারণ ছিল একতরফা রাজনৈতিক আধিপত্য এবং স্বৈরাচার।
নজিমাতের সংস্কারের সময় শুধু সেনাবাহিনী, প্রশাসন এবং আইনের সংস্কার করা হয়েছে কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কোনো সংস্কার করা হয়নি। ঠিক একই রকম পরিস্থিতি এখন ঘটে চলেছে সৌদি আরবে। ক্রাউন প্রিন্স সালমান বিন মোহাম্মদও এখন সৌদি আরবে রাজনীতি ছাড়া আর বাকী সব ক্ষেত্রেই এক আবেগতাড়িত এবং অপরিকল্পিত সংস্কার করে চলেছেন। তিনি সবগুলো ঐতিহাসিক স্তরকেই পোড়াতে চাইছেন সৌদি রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক এবং সামাজিকভাবে সংস্কার করার জন্য। অথচ একই সময়ে দেশটির ওপর চেপে বসে আছে এমন এক রাজনৈতিক স্বৈরাচার যার কারণে সৌদি সমাজ নিজেকে মুক্তভাবে প্রকাশ করতে পারছে না।
বিন সালমানের সংস্কার কর্মসুচির যাত্রা শুরু হয়েছে গত বছরের এপ্রিলে, যার শিরোনাম দেওয়া হয়েছে সৌদি ভিশন ২০৩০। যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে নিজের নায্যতা গড়ে তোলার জন্যই তিনি এই সংস্কার প্রচেষ্টা শুরু করেছেন। এছাড়া তারা বাবা রাজা সালমান বিন আব্দুল আজিজের পর সিংহাসনের উত্তরাধীকারী হিসেবে নিজের দাবির নায্যতা উৎপাদনও তার এই সংস্কার কর্মসুচির একটি লক্ষ্য। বিশেষ করে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন নায়েফকে উৎখাতের পরিপ্রেক্ষিতে এটাই এখন মূল লক্ষ্য।
সৌদি রাজ সিংহাসনের বর্তমান এই উত্তরসূরি দেশটির ধর্মতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সঙ্গেও রাজবংশের যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক ও যোগসাজশ ছিল তা ভাঙ্গতে চেষ্টা করছেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়কালে দিরিয়াহ আমিরাত প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সৌদি আরবের ওই ধর্মতাত্ত্বিক গোষ্ঠী সৌদি আরবের রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলা এবং এর নায্যতা উৎপাদনে কাজ করে আসছিল।
বিন সালমানের সংস্কার শুরু হয়েছে সৌদি নারীদেরকে গাড়ি চালানোর অনুমতি প্রদান করার মধ্য দিয়ে। যা সৌদি ধর্মতাত্ত্বিকদের কাছে একটি ‘মহাপাপ’ হিসেবে গণ্য হয়। কিন্তু বিন সালমানের সংস্কার কর্মসুচি শুধু এই একটি ‘মহাপাপ’ করেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। বরং এই সংস্কার কর্মসুচির অধীনে সৌদি ধর্মতাত্ত্বিকদের নিয়ে গঠিত নৈতিকতা সংক্রান্ত কমিটিটিও বিলুপ্ত করার বা অন্তত এর ক্ষমতা সীমিত করার আলোচনাও চলছে। শরীয়া আইন বলবতকরনের জন্য ওই সংস্থাটির অধীনে একটি ধর্মীয় পুলিশ বাহিনীও আছে। ওই কমিটি মূলত ধর্মীয় দৃষ্টিতে যেসব কাজ সদকাজ বলে গণ্য হয় সেসব কাজে মানুষকে উৎসাহিত করা এবং অসদকাজ প্রতিরোধে গঠন করা হয়েছিল।
এছাড়া আগে নিষিদ্ধ ছিল এমন কিছু আইনী এবং প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও চলছে, যেমন, দেশটিতে সিনেমা হল চালু করা। এবং এমন পর্যটন এলাকা প্রতিষ্ঠা করা যেখানে নারীদের বিকিনি পরার এবং মদপানের অনুমতি থাকবে। অটোম্যান সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ এবং প্রথম আব্দুল মজিদের চোখ শুধু বস্তুগতভাবে সমৃদ্ধ পশ্চিমের ওপরই পড়েছিল, ভাবগতভাবে সমৃদ্ধ পশ্চিমের দিকে নয়। তেমনি বিন সালমানের চোখও অর্থনৈতিক এবং সামরিক দিক থেকে সমৃদ্ধ পশ্চিমের ওপরই পড়ে আছে। এছাড়া প্রতিবেশি সংযুক্ত আরব আমিরাতের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পশ্চিমাকরণের প্রতি তার নজর পড়েছে; যে দেশটি শুধু দৈনন্দিন ভোগ-বিলাসের পণ্যগত দিক থেকেই নিজেদের আধুনিকায়ন করেছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কোনো সংস্কার করেনি।
অটোম্যান সুলতান প্রথম আব্দুল মজিদকে তার সংস্কার কর্মসুচি বাস্তবায়নে পরামর্শ সহায়তা দিয়েছিলেন ফ্রান্স এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ থেকে আসা উপদেষ্টারা। ঠিক তেমনি সৌদি প্রিন্স বিল সালমানকে পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করছেন আমেরিকান ও ব্রিটিশ উপদেষ্টারা। এই উপদেষ্টাদের আবার যাচাই-বাছাই করে পাঠিয়েছে সৌদি আরবের বন্ধু রাষ্ট্র সংযুক্ত আরব-আমিরাত। কারণ সে দেশটির আবার এই বিষয়ে অভিজ্ঞতা বেশি।
অটোম্যানদের পুনর্গঠন এবং সংস্কার প্রক্রিয়ায় সাধারণ জনগনকে সম্পৃক্ত না করেই ওপর থেকে বলপ্রয়োগপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যার পরিণতিতে অটোম্যান সাম্রাজ্যই ভেঙ্গে পড়েছিল। উনিশ শতকের শেষদিকে অটোম্যান সাম্রাজ্যে নানা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে জর্জরিত হয়ে পড়ে। তুরস্ক থেকে শুরু করে মিশর, পূর্ব ইউরোপ এবং বলকান অঞ্চলে শরু হয় নৈরাজ্য এবং বিদ্রোহ।
ইউরোপ এবং রাশিয়াও অটোম্যানদের সাম্রাজ্যে হানা দিতে থাকে এবং উনিশ শতকের শেষদিক ও বিশ শতকের প্রথমদিকে অটোম্যান সাম্রাজ্যকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে থাকে। আর ওই পরিপ্রেক্ষিতেই অটোম্যানদের নামকরণ করা হয় ‘সিক ম্যান অফ দ্য ইউরোপ’ বা ‘ইউরোপের রুগ্ন মানুষ’। সেই রুগ্ন মানুষটির পুরোপুরি মৃত্যু হয় ১৯২৪ সালে গিয়ে। কামাল পাশার হাতে খেলাফত উচ্ছেদকরন এবং আধুনিক তুরস্ক প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে।
সৌদি প্রিন্স বিন সালমান এবং তার উত্তরসূরিরাও বুঝতে পারছেননা যে, সৌদি আরবের মতো একটি গোঁড়া সমাজের উপর থেকে সংস্কার চাপিয়ে দিলে তা হিতে বিপরীত ফল বয়ে আনতে পারে। সৌদি আরবও ‘সিক ম্যান অফ দ্য মিডল ইস্ট’ হয়ে উঠতে পারে। কেননা এই ধরনের সংস্কার গ্রহণ করতে সৌদি সমাজের একটি লম্বা সময় দরকার।
এছাড়া তিনি এও বুঝতে পারছেন না যে, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক এবং সামজিক সংস্কারের ফলে রাজনৈতিক সংস্কারের দাবিও উঠবে। কারণ এই সংস্কারের ফলে আরো সচেতন এবং উচ্চাভিলাষী নতুন নতুন সামাজিক গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটবে। যার ফলে এমনকি তার নিজের এবং তার পরিবারের এবং সৌদ রাজবংশের শাসনও উৎখাত হয়ে যেতে পারে।
মোহাম্মদ বিন সালমান এও বুঝতে পারছেন না যে, বর্তমানে তিনি যে নজিরবিহীন দমন-পীড়ন চালাচ্ছেন তার ফলে এমন সব চরমপন্থী সেল এবং নেটওয়ার্কেরও উত্থান ঘটতে পারে যারা তার এই দ্রুত সংস্কার কর্মসুচিকেই তার বিরোধীতার জন্য অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করবে। সৌদি আরবের এই ক্রাউন প্রিন্স এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের উচিত অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতনের ইতিহাস পাঠ করা। যাতে তারা বুঝতে পারেন সব একতরফা সংস্কারেরই একটি মূল্য শোধ করতে হয়; তাকেও হয়তো এই মূল্য শিগগিরই শোধ করতে হবে।
সূত্র: মিডল ইস্ট মনিটর ; ডেইলি বাংলাদেশ

Leave a Reply

Your email address will not be published.