সব সুবিধা চান সচিবরা বিরক্ত প্রধানমন্ত্রী

আবদুল আখের॥ চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরও নিজেদের প্রাধিকার সুবিধা চেয়েছেন সচিবরা। অর্থাৎ অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) থাকার সময় গাড়ি, বাড়ি, গৃহকর্মীসহ যেসব সুবিধা তাঁরা পান, পেনশন ভোগের সময়ও সেসব সুবিধা তাঁরা চাচ্ছেন। একই সঙ্গে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার বয়সসীমা বাড়ানো, নিজেদের স্বতন্ত্র অবস্থান প্রকাশের জন্য প্রতীক বরাদ্দ এবং সিনিয়র সচিবের পদ বাড়াতেও প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন। গতকাল রবিবার সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত সচিব সভায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও সিনিয়র সচিবরা এসব অনুরোধ জানান।

sob subida chan sochibra pm
এসব সুবিধা চাওয়া নিয়ে প্রধানমন্ত্রী তাৎক্ষণিক কিছু না বললেও অন্য কয়েকটি বিষয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেন। সচিবালয় শেরেবাংলানগরে স্থানান্তরের জন্য মাস্টারপ্ল্যান করা হয়েছে বলে বৈঠকে ঘোষণা দেওয়া হলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কে বলেছে মাস্টারপ্ল্যান করতে। ওখানে (শেরেবাংলানগরে) লুই কানের নকশার বাইরে কিছু হবে না। যুক্তরাষ্ট্র থেকে নকশা আনা হয়েছে, সে মতেই সব হবে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শূন্য পদ বেড়ে যাওয়ায়ও বিরক্ত হয়েছেন। আন্ত ক্যাডার বৈষম্য দূর করা ছাড়াও দুর্নীতি বন্ধ করতে বলেন। একইভাবে সরকারি স্বার্থসংশ্লিষ্ট মামলায় হেরে যাওয়ার জন্য সচিবদেরও দুষেছেন প্রধানমন্ত্রী।
বৈঠক শেষে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। সচিবসভায় ৭১ জন সচিব উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ১৬ জন বিভিন্ন ইস্যুতে কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী সচিবদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন দীর্ঘ ৩৮ মাস পর। ২০১৪ সালে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর শেখ হাসিনা সচিবদের সঙ্গে বৈঠকটি করেছিলেন একই বছরের ৭ এপ্রিল। এরপর বিভিন্ন ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী সচিবদের সঙ্গে বৈঠক করলেও সচিবসভা হয়নি। তাই ৩৮ মাস পর গতকাল অনুষ্ঠিত সচিবসভা নিয়ে সচিবদের মধ্যে চাঞ্চল্য ছিল, ছিল তাঁদের হোমওয়ার্ক।
সভায় সচিবদের পক্ষে তাঁদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সুদূরপ্রসারী বক্তব্য দেন স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম। তিনি দেশের উন্নয়নে সচিবদের অবদান রয়েছে উল্লেখ করেন এবং সরকারি চাকরি থেকে অবসরের বয়স ৬২ বছর করার প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে সরকারি চাকরিজীবীরা অনেক বেশি বয়সে অবসরে যান। আমাদের দেশেও বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি পেশায় ৬৫ বছরে অবসরে যাওয়ার বিধান রয়েছে। ’ তিনি আরো বলেন, যে বয়সে একজন সরকারি কর্মচারী সবচেয়ে বেশি সেবা দিতে পারেন তখনই তাঁকে অবসরে চলে যেতে হয়। তিনি নিজেদের (সচিবদের) স্বতন্ত্র অবস্থানের জন্য মনোগ্রাম চান এবং সিনিয়র সচিবের সংখ্যা বাড়ানোরও প্রস্তাব দিয়েছেন। বর্তমান পদ্ধতিতে সিনিয়র সচিব না করে একটি নির্দিষ্ট সময় চাকরি করার পর সিনিয়র সচিব করার প্রস্তাবও দেন তিনি। শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের এই সচিব চাকরি থেকে অবসরের পর সচিবদের পিআরএল (অবসরোত্তর ছুটি) কালীন সুবিধা বহাল রাখার প্রস্তাব করেছেন। অর্থাৎ সরকারের সচিবরা পিআরএল ভোগ করার সময় বাড়ি, গাড়ি, গৃহকর্মীসহ অন্য যেসব প্রাধিকার ভোগ করেন, তা পেনশনের পুরো সময়টাতেও বহাল রাখার প্রস্তাব করেন।
২০১১ সালের ২৬ ডিসেম্বর সরকারি কর্মচারীদের অবসরের বয়স বাড়িয়ে ৫৯ করা হয়। আর মুক্তিযোদ্ধা কর্মচারীদের অবসরের বয়স ৬০ বছর করা হয় ২০১৩ সালে। সচিব সভার একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনপ্রশাসনসচিব ড. মো. মোজাম্মেল হক খানকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘কী ব্যাপার, দিন দিনই শূন্য পদ বাড়ছে কেন? দ্রুত শূন্য পদ পূরণ করুন। উল্লেখ্য, সরকারের প্রায় তিন লাখ পদ শূন্য রয়েছে। প্রতিবছরই সরকারের শূন্য পদ বাড়ছে। বর্তমানে ব্যাপকহারে শূন্য পদ বেড়ে যাওয়ার কারণ হচ্ছে সামরিক শাসনামলে যেসব বিধিবিধান করা হয়েছে তা আদালতের রায়ে বাতিল করা হয়েছে। সেসব বিধিবিধানের মধ্যে নিয়োগবিধিও রয়েছে। এই নিয়োগবিধির জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রায় ৩০ হাজার পদ শূন্য রয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের রয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার পদ শূন্য। প্রায় প্রতিটি মন্ত্রণালয়েরই কমবেশি পদ শূন্য রয়েছে সামরিক শাসনামলের বিধির কারণে। এসব বিধি প্রণয়ন শেষ না হলে শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব নয়।’
আলোচনার একপর্যায়ে আসে আদালতে মামলার পাহাড় জমে থাকার বিষয়টি। বিষয়টি সচিব সভার এজেন্ডাতেও ছিল। সচিবরা অ্যাটর্নি সার্ভিস চালু করার পরামর্শ দেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী সচিবদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারাও আদালতে সঠিক তথ্য উপস্থাপন করেন না। যেসব তথ্য দরকার তা দেওয়া হয় না। এসব আর চলবে না। সরকারি স্বার্থসংশ্লিষ্ট মামলায় সঠিক তথ্য দিতে হবে। সরকারি স্বার্থরক্ষার চেষ্টা করতে হবে।’ এ সময় সচিবরা আদালতে তাঁদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করানোর বিষয়টি উপস্থাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি আইন সচিবকে দেখার নির্দেশ দেন। আদালতের প্রসঙ্গ আলোচনার সময় ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিষয়টিও আসে। এ সময় সচিবরা ভ্রাম্যমাণ আদালত কেন দরকার তা ব্যাখ্য করেন। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন। অপেক্ষা করেন পূর্ণাঙ্গ রায়ে কী বলা হয়।’ আলোচনার একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী সচিবদের তাঁদের নিজস্ব মন্ত্রণালয় সম্পর্কে সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বের সময় উপস্থিত থাকার নির্দেশ দেন।
বৈঠকের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী সচিবদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন। ঘণ্টাব্যাপী এ বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী সচিবদের ১২ দফা নির্দেশনা দেন। প্রধানমন্ত্রী গ্রাম উন্নয়নের ওপর জোর দিয়ে বলেন, ‘গ্রামের মানুষকে কাজের খোঁজে যেন শহরে না আসতে হয় এবং শহরের ওপর জনসংখ্যার চাপ যাতে না বাড়ে সে ব্যবস্থা করতে হবে। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কমাতে হবে। সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে। উন্নয়ন কর্মসূচি এমনভাবে নিতে হবে যেন সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ সুবিধা পায়। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের হার বাড়াতে হবে। অর্থবছরের শেষ দিকে তাড়াহুড়া না করে বছরের শুরুতেই বাস্তবায়নের কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। বর্ষা মৌসুমে প্রকল্পের পেপার ওয়ার্ক শেষ করুন। কাজের গুণগত মানের সঙ্গে কোনো আপস করা যাবে না। ফাস্ট-ট্র্যাক প্রকল্পগুলো নির্ধারিত সময়ে শেষ করার জন্য আরো আন্তরিক হোন। দক্ষ ও যোগ্যদের গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব দিন। ভালো কাজের জন্য পুরষ্কার আর মন্দ কাজের জন্য তিরস্কারের ব্যবস্থা করুন। সেবা প্রদানকারী সংস্থা থেকে সেবা পেতে সাধারণ মানুষকে যেন ভোগান্তির শিকার হতে না হয় তার ব্যবস্থা নিন। বেতন-ভাতা বাড়ানো হয়েছে। কর্মচারীদের দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। আন্তক্যাডার বৈষম্য দূর করে সবার ন্যায়সঙ্গত পদোন্নতি ও পদায়ন নিশ্চিত করুন। অপেক্ষাকৃত তরুণ কর্মকর্তা, যাঁরা দীর্ঘদিন চাকরি করবেন তাঁদের প্রশিক্ষণে অগ্রাধিকার দিন। জঙ্গিবাদ দমন এবং মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা নিন।’ এ ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণের জন্য সচিবদের নির্দেশ দেন।
সকাল ১০টায় সচিব সভা শুরু হয়ে দুপুর ১টায় শেষ হয়। সভায় অন্যদের মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব ফরিদ উদ্দিন আহমদ বলেন, কাজের সুবিধার্থে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুনর্গঠন করা হয়েছে ঠিকই, কিন্ত্র এখন বসার জায়গা পাচ্ছেন না কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছাড়াও শিক্ষা মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় পুনর্গঠন করা হয়েছে। এসব মন্ত্রণালয়ে একাধিক বিভাগ করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় পুনর্গঠন করতে গিয়ে কর্মচারীদের বসার জায়গার তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। সভা শেষে মন্ত্রিপরিষদসচিব (সংস্কার ও সমন্বয়) এন এম জিয়াউল আলম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। তিনি জানান, ২৪ ঘণ্টাই বাংলাদেশের বিভিন্ন সমুদ্রবন্দর ও স্থলবন্দর খোলা থাকবে। প্রধানমন্ত্রী জেলায় জেলায় পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুদ করার নির্দেশ দিয়েছেন

Leave a Reply

Your email address will not be published.