মোমেনা সোমার বিষয়ে অস্ট্রেলিয়ান পুলিশের তদন্ত শুরু

বিএম হাবিবুল্লাহ॥ অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে ৯ দিনের ব্যবধানে এক ব্যক্তিকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া মোমেনা সোমার বিষয়ে তদন্ত করতে ঢাকায় এসেছে অস্ট্রেলিয়ান পুলিশের একটি দল। এতে আছেন দুই সদস্য। তারা মোমেনা সোমা ও তার ছোট বোন আসমাউল হুসনা ওরফে সুমনা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানার চেষ্টা করছেন। মোমেনা অস্ট্রেলিয়ায় গ্রেফতার হওয়ার দুই দিন পর ঢাকার মিরপুরের বাসায় তার পরিবারকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গেলে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তাকে ছুরিকাঘাতের চেষ্টা করে সুমনা। পরে তাকেও গ্রেফতারের পর কয়েক দফা রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। bangladeshi is momena
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের উপ-কমিশনার মহিবুল ইসলাম খান সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘মোমেনা সোমার বিষয়ে অনুসন্ধান ও তথ্য জানতে অস্ট্রেলিয়ান পুলিশের দুই সদস্য ঢাকায় এসেছেন। আমাদের সঙ্গে তারা কথা বলেছেন। তাদের কাছে যা তথ্য ছিল আমাদের জানিয়েছেন। আমরা মোমেনা ও সুমনার বিষয়ে যেসব তথ্য সংগ্রহ করেছিলাম তা তাদের জানিয়েছি। আমাদের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে তথ্যের আদান-প্রদান হয়েছে।’
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশে নতুনধারার জঙ্গিবাদে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিল তাদের সঙ্গে মোমেনা সোমার যোগাযোগ ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। এজন্য তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে অস্ট্রেলিয়ান পুলিশ যেসব তথ্য পেয়েছে তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
এছাড়া ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তাদের অস্ট্রেলিয়ায় গিয়েও মোমেনা সোমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার ব্যাপারে কথা হয়েছে। কারণ বাংলাদেশের যেসব কর্মকর্তার নতুনধারার জঙ্গিবাদ নিয়ে জানাশোনা আছে, কেবল তারাই এই মেয়েটির কাছ থেকে সেই সময়ের তথ্য আদায় করতে সক্ষম হবেন।
সিটিটিসির কর্মকর্তারা বলছেন, “কয়েক বছর আগেই জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে দুই বোন। প্রথমে বড় বোন মোমেনা সোমা ও পরবর্তী সময়ে বড় বোনের হাত ধরে ছোট বোন সুমনাও বিপথে গেছে। তাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সংগঠন ইসলামিক স্টেট বা আইএসে যোগ দেওয়া একাধিক বাংলাদেশি ‘ফরেন ফাইটারের’ যোগাযোগ ছিল। ওই কর্মকর্তারা আরও জানান বিশেষ করে নজিবুল্লাহ আনসারী নামে এক মেরিন ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে মোমেনা সোমার বিয়ের কথা ঠিক হয়েছিল। নজিবুল্লাহ সিরিয়ায় চলে যাওয়ার পর তার আর কোনও খোঁজ নেই। সিরিয়ায় যাওয়া আরেক আইএস জঙ্গি গাজী সোহানের সঙ্গেও মোমেনা আর সুমনার যোগাযোগ ছিল। সোহান ২০১৪ সালের ১১ ডিসেম্বর সিরিয়ায় গেলেও ২০১৫ সালের মে মাসে দেশে ফিরে আসে। দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকা সোহানকে গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।
সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘২০১২ সালে নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই বদলে যেতে থাকে মোমেনা সোমা। ২০১৩-২০১৪ সালে সে পুরোপুরি জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে। ২০১৪ সালেই তার সঙ্গে নজিবুল্লাহ আনসারী ও গাজী সোহানের সঙ্গে পরিচয় হয়। তখন ইসলামিক স্টেটে যোগ দেওয়ার জন্য ও জিহাদের জন্য যোদ্ধা পাঠাতে সক্রিয় ছিল একটি গ্রুপ। তাদের অনেকের সঙ্গেই মোমেনা সোমার যোগাযোগ রয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার দ্বৈত নাগরিক এটিএম তাজউদ্দিনের সঙ্গেও তার যোগাযোগ থাকতে পারে।’
ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা জানান, মোমেনা সোমা ও নজিবুল্লাহ আনসারী একে অপরকে পছন্দ করতো। তাদের মধ্যে সম্পর্কও ছিল। দু’জনে একসঙ্গে সিরিয়ায় যেতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের বিয়েতে অমত দেয় পরিবার। পরবর্তী সময়ে নজিবুল্লাহ সিরিয়ায় চলে গেলে মোমেনা সোমাও সেখানে যেতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এমনকি ঢাকায় পরিবারের পক্ষ থেকে যখন তার বিয়ের কথা হয়, তখনও পাত্রপক্ষকে বিয়ের শর্ত হিসেবে মুসলিম কোনও দেশে নিয়ে যাওয়ার শর্ত জুড়ে দিয়েছিল সে।
সিটিটিসি’র ওই কর্মকর্তার ভাষ্য, ‘মোমেনা সোমার সঙ্গে তার এক ফুফাত ভাইয়ের বিয়ের কথা হয়েছিল। তাকেও সে একই কথা বলেছে। এমনকি পাত্রপক্ষের জন্য তার যে জীবনবৃত্তান্ত তৈরি করা হয়েছিল সেখানেও শর্ত হিসেবে বিয়ের পর তাকে কোনও একটি মুসলিম দেশে নিয়ে যাওয়ার কথা লেখা ছিল। তবে মোমেনা সোমা মুসলিম দেশ হিসেবে সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায় যেতে অনাগ্রহী ছিল। তার লক্ষ্য ছিল সিরিয়া বা ইরাকে যাওয়া। ’সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ২০১৪ সালে তুরস্কের আতিলিন ইউনিভার্সিটি থেকে স্কলারশিপ নিয়ে তুরস্ক হয়ে সিরিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা করেছিল মোমেনা সোমা। তবে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার তার্কিশ দূতাবাসে ভিসা নিতে গিয়ে রিফিউজড হয় সে।
এরপর তিউনিশিয়ার একটি ইউনিভার্সিটিতে একটি সেমিনারে যোগ দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয় মোমেনা সোমা। তিউনিশিয়িার ওই ইউনিভার্সিটি থেকে আমন্ত্রণপত্রও পেয়েছিল সে। কিন্তু তিউনিশিয়ার যাওয়ার জন মোমেনা ভিসার আবেদন করেছিল কিনা তা জানা যায়নি। আন্তর্জাতিক সংগঠন ইসলামিক স্টেট তথা আইএসে যোগ দেওয়া ফরেন ফাইটারদের মধ্যে তিউনিশিয়ার তালিকা ছিল শীর্ষে।
গত ৯ ফেব্রুয়ারি অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে রগার সিঙ্গারাভেলু নামে এক ব্যক্তির ওপর ছুরি নিয়ে হামলা চালায় মোমেনা সোমা। পরদিন গ্রেফতারের পর হামলাটি আইএসের অনুপ্রাণিত হামলা বলে জানায় অস্ট্রেলিয়ান পুলিশ।
এ ঘটনা জানতে পেরে ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে মিরপুরে ৩৫৫/১ পূর্ব কাজীপাড়ার বাসায় গিয়ে তার বাবা ও ছোট বোন সুমনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে সিটিটিসির এক কর্মকর্তার ওপর ছুরি নিয়ে আক্রমণ চালায় সুমনা। পরে তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দায়েরের পর পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধের জন্য গঠিত বিশেষায়িত সিটিটিসি ইউনিট।

Leave a Reply

Your email address will not be published.