সৌদি আরবে বাপ-ছেলে মিলে বাংলাদেশি দুই নারীকে লাগাতার ধর্ষণ

গোলাম নবী, সৌদি প্রতিনিধি॥ সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে যাওয়া বাংলাদেশি দুই নারীকে এক সৌদি পরিবারের বাবা ও তার ছয় ছেলে মিলে এক মাস ধরে টানা ধর্ষণ করেছে। বহু কষ্ট করে বাংলাদেশে ফিরে আসা ওই দুই নারীর পরিবারের সদস্যরা গুলশান থানায় সৌদি নাগরিকসহ সাত জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।baba selea dorson
সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে গিয়ে বাংলাদেশি দুই নারী সূযের আলো দেখেননি এক মাস। ধর্ষণের নারকীয় ঘূর্ণাবর্তে কেটেছ তাদের দুর্বিষহ জীবন। একই পরিবারের কর্তা ও তার ছয় ছেলে মিলে বার বার ধর্ষণ করেছে তাঁকে। একটু প্রতিবাদ করলেই জুটেছে কিল-ঘুষি-লাথি। আর্তনাদ আর চোখের জলে তাদের মন গলেনি। বরং অত্যাচার বেড়ে গেছে। বিশেষ করে তলপেটে আঘাতের ফলে একাধিকবার মুমূর্ষু অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
এমন এক জীবন্ত নরকের বর্ণনা দিতে গিয়ে বাংলাদেশি ওই দুই নারীর স্বামী ও ভাই বলেন, ভালো চাকরির আশায় প্রত্যেকে আড়াই লাখ টাকা ব্যয় করে সৌদি আরব যান তাঁরা। সেখানে গিয়ে দেখেন যে আশা নিয়ে এসেছেন, সবই মিথ্যা। আদম পাচারকারীদের মাধ্যমে প্রতারিত হয়েছেন। কিন্তু তখন আর চট করে এ ভুল শোধরানোর সুযোগ নেই। পরিণামে গুনতে হলো চড়া মাশুল।
এ ঘটনায় মানবপাচারের অভিযোগ এনে একজন সৌদি নাগরিকসহ বাংলাদেশি সাত নাগরিকের বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে মামলা হয়।
আদালত গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) ঘটনার তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন। আদালতের আদেশে গত ১৬ জুলাই মামলা তালিকাভুক্ত করে গুলশান থানা-পুলিশ। গুলশান থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক বলেন, সৌদি আরবে বাংলাদেশি দুই নারীর ওপর যৌন নির্যাতনের মামলার তদন্ত চলছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে আসামিদের গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা হবে।
মামলার বাদী একটি বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠনের সদস্য মো. ইয়াসিন বলেন, একই সৌদি পরিবারের সাতজন মিলে যেভাবে দুজন বাংলাদেশি নারীর ওপর শারীরিক ও যৌন নির্যাতন চালিয়েছে, তা চিন্তাও করা যায় না। যেসব মানব পাচারকারী এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তাদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
৩৩ বছর বয়সী নারীর গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরে। সেখানে তাঁর বেড়ে ওঠা। আট বছর আগে তাঁর বিয়ে হয়। কয়েক বছরের ব্যবধানে তিন সন্তান হয়। গাড়ি চালক স্বামীর আয়ে সংসার ঠিকমতো চলত না। অভাব-অনটন লেগেই থাকত। সংসারে কিছুটা সচ্ছলতা আনতে স্বামী-স্ত্রী দুজনই বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। স্বামী তাঁর ঢাকার রিক্রুটিং এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। স্বামীর ভিসা না এলেও তাঁর ভিসা আসে। আড়াই লাখ টাকা খরচ করে যান সৌদি আরবে।
বলা হয়েছিল, সৌদি আরবে তিন সদস্যের এক পরিবারে কাজ করতে হবে। পরিবারের ছোট্ট এক বাচ্চাকে দেখাশোনা করাই তাঁর মূল কাজ। পাশাপাশি সংসারের টুকটাক কাজ করা। বেতন দেওয়া হবে ২৫ হাজার টাকা। তিনি সৌদি যান গত ২৭ মে। আর ত্রিশ বছর বয়সী অপর নারীর বাড়ি ঝালকাঠি। কাজ করতেন ঢাকার একটি তৈরি পোশাক কারখানায়। বেতন পেতেন আট হাজার টাকা। বিদেশে চাকরি করলে ভালো বেতন পাওয়া যাবে-এমন কথা জানতে পেরে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করেন। শেষমেশ দালালের সঙ্গে যোগাযোগ করে গত ১ জুন বিদেশ যান। সৌদি আরবে নির্যাতনের অভিযোগে গত ২ জুলাই ঢাকার একটি আদালতে নালিশি মামলার পর গত সপ্তাহে এই দুই নারীকে সেখান থেকে উদ্ধার করে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। প্রধান আসামি হলেন বাংলাদেশি নাগরিক জহিরুল ইসলাম, সৌদি নাগরিক আবদুল আজিজ, রিক্রুটিং এজেন্সি মেসার্স আল-বোখারী ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম ভূঁইয়াসহ সাতজন।
মামলার এজাহারে বলা হয়, এই দুজন নারীকে সৌদি আরবের সাত সদস্যের পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়। বিনিময়ে আসামিরা কয়েক লাখ রিয়াল নেন। সেই পরিবারের সাতজন সদস্য দিনের পর দিন তাঁদের ধর্ষণ করে নির্যাতন চালায়।
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের কাছে এক আবেদনে বলা হয়, ‘ওরা মানুষ না। বাপ-ছেলে সাতজন মিলে দিনের পর দিন গণধর্ষণ করে মেরে ফেলছে।’
অভিযোগ প্রসঙ্গে মেসার্স আল-বোখারী ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম ভূঁইয়া (৫২) বলেন, ‘আমরা একটি মেয়েকে সৌদি আরব পাঠিয়েছিলাম। যখন নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়, তখন তাঁকে সৌদি আরব থেকে তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।’
শরিয়তপুরের নারীর স্বামী বললেন, তাঁর স্ত্রী সৌদি আরবে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন। বাবা-ছেলে মিলে যে যৌন নির্যাতন চালিয়েছে, তা কল্পনা করলে ভয়ে গা শিউরে ওঠে। তাঁর স্ত্রী বহু বার সৌদির বাবা-ছেলের পা ধরে বলেছেন, তাঁকে যেন মুক্তি দেয়। উল্টো তারা বলেছে, যদি সে যৌন কাজে বাধা দেয়, তাহলে তার দেহ তিন টুকরো করে ফ্রিজে রেখে দেবে। ঝালকাঠির নারীর ভাই বললেন, একদিন তার বোন তাঁকে বলে, ‘ভাই আমি আর বাঁচব না। আমাকে নরক থেকে উদ্ধার করেন।’
সৌদি আরব থেকে যেদিন দুজন নারী ঢাকার বিমানবন্দরে নামেন, সেদিন তাঁকে দেখে চিনতে পারছিলেন না স্বজনেরা। সালোয়ার কামিজের বদলে তাঁদের পরনে ছিল শার্ট আর প্যান্ট। এক নারীর স্বামী বললেন, ‘জীবনে কোনো দিন চিন্তা করিনি স্ত্রীর পরনে থাকবে শার্ট-প্যান্ট। অথচ তাঁর শরীরে তাই ছিল। বিমানবন্দর থেকে কীভাবে ওই পোশাকে আনব তাঁকে? বাধ্য হয়ে বোরকা পরিয়ে তাঁকে বাসায় নিয়ে আসা হয়। পরে তাঁকে ঢাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা করান। সৌদি আরবের সেই বাবা-ছেলের যৌন নির্যাতনের চিহ্ন এখনো তার শরীরে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published.