প্রশান্তি ডেক্স ॥ দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা রাজশাহীর জামায়াত। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি দলটির নেতাকর্মীদের। তবে এবার নতুন ছকে এগুচ্ছে দলটি। নেতারা বলছেন, তাদের টার্গেট যেকোনো মূল্যে মাঠের রাজনীতিতে ফেরা। আর এজন্যই নেতৃত্বে আনা হয়েছে পরিবর্তন। নগরীতে গড়ে তোলা হয়েছে অন্তত ছয়টি আলাদা প্রভাব বলয়। দিন দিন শক্তি বাড়ছে এসব বলয়ে। অভিযোগ উঠেছে, পুলিশকে ম্যানেজ করে রাজনীতিতে ফিরছেন একাধিক মামলা মাথায় নিয়ে দীর্ঘদিন পলাতক ও আত্মগোপনে থাকা শীর্ষ নেতারা। ফলে রাজশাহীর রাজনীতিতে উত্তাপ বাড়ছে। জামায়াতের নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সামনে থেকে রাজশাহী নগর জামায়াতকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ড. কেরামত আলী। গত বছর তাকে নগর জামায়াতের আমীরের দায়িত্ব দেয়া হয়। এর আগে ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত নগর শিবিরের সভাপতি ছিলেন কেরামত আলী। পরে প্রভাবশালী ছাত্র মৈত্রী নেতা ডা. জামিল আক্তার রতন হত্যা মামলা এজাহারভূক্ত আসামি হয়ে রাজশাহী ছাড়েন। মাঝে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। কেন্দ্রীয় শক্তিশালী লবিং তাকে ফের নগর জামায়াতের রাজনীতিতে ফেরায়। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, নগরীর অন্যতম প্রকেশপথ পবা থানাধীন বায়া এলাকা জামায়াতের একটি প্রভাব বলয়। এখানে বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করছেন ড. কেরামত আলী। তিনি নিজেকে আবু মারুফ হিসেবে পরিচয় দেন। এখান থেকেই নগরীর রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন ড. কেরামত। এর বাইরে নগরীর কেন্দ্র শিরোইল এলাকায় রয়েছে জামায়াতের সবচেয়ে বড় প্রভাব বলয়। দলের নায়েবে আমীর প্রফেসর নজরুল ইসলামের বাসা থেকে ওই এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে জামায়াত। এ বাসাটিকে টর্চার সেল হিসেবেও ব্যবহার করে জামায়াত। দলের ভিন্নমতাবলম্বী নেতাদের এনে এখানেই মানসিক এমনকি শারীরিক নির্যাতন চালান নেতারা। এ টর্চার সেল নিয়ন্ত্রণ করেন নগর জামায়াতের সেক্রেটারি মাইনুল ইসলাম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সাবেক সভাপতি মাইনুল ইসলাম এখনও বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের উপদেষ্টা। শিরোইল এলাকা বাদেও বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিনোদপুর এবং নগরীর পশ্চিমাঞ্চ কোর্ট-হড়গ্রাম এলাকাটিও তার নিয়ন্ত্রণে। এছাড়া শিরোইল এলাকার নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন নগর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি শাহাদাৎ হোসাইন এবং বোয়ালিয়া (পূর্ব) জামায়াতের আমীর সিরাজুল ইসলামের হাতে। নগরীর তেরখাদিয়া এলাকার নিয়ন্ত্রণ নগরীর বোয়ালিয়া থানা পশ্চিম জামায়াতের আমীর আমিনুল ইসলামের হাতে। আমিনুল ইসলাম সাবেক আমীর আতাউর রহমানের ভাই। নগরীর রাজপাড়া থানা জামায়াতের আমীর কামরুজ্জামান সোহেল এবং কাশিয়াডাঙ্গা থানা আমীর ফরিদ উদ্দিন আত্তারেরও রয়েছে আলাদা প্রভাব বলয়। গোয়েন্দা সূত্র আরও জানাচ্ছে, নগর জামায়াতের শীর্ষ এ ছয় নেতা জামায়াত নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশ মসজিদ মিশন পরিচালিত রাজশাহী মসজিদ মিশন একাডেমীর শিক্ষক। শিক্ষকতার আড়ালে সক্রিয় রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছেন এরা। এদের একেক জনের নামে অন্তত ২০ থেকে ৫০টি পর্যন্ত নাশকতার মামলা রয়েছে। জামায়াত নেতা মাইনুল ইসলাম প্রতিষ্ঠানটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সিনিয়র প্রভাষক। এছাড়া শাহাদাৎ হোসাইন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক, সিরাজুল ইসলাম ইসলামী শিক্ষা বিষয়ের প্রভাষক, আমিনুল ইসলাম সহকারী প্রধান শিক্ষক, কামরুজ্জামান সোহেল ব্যবসায় সংগঠন বিষয়ের প্রভাষক এবং ফরিদ উদ্দিন আত্তার সহকারী শিক্ষক। নগরীর প্রাণকেন্দ্র সাহেববাজার এলাকায় অবস্থিত এ বিদ্যালয়টিতে নিয়মিত হাজির হচ্ছেন জামায়াত নেতারা। সেখান থেকেই তারা কৌশলে চালাচ্ছেন তাদের রাজনৈতিক কর্মকান্ড। এ জন্যই বোয়ালিয়া থানা পুলিশকে ম্যানেজ করতে প্রতিমাসে মোটা অর্থ গুনতে হচ্ছে নগর জামায়াতকে। বিষয়টি স্বীকার করেছেন জামায়াতের একাধিক শীর্ষ নেতা। নগরীর ১০টি সাংগঠনিক থানার প্রতিটিতে মাসে অন্তত ২৫ লাখ টাকা করে আদায় হয়। এ অর্থ আসে কর্মী-সমর্থকদের ইয়ানত (চাঁদা) থেকে। প্রতি মাসেই এ অর্থ আদায় হয়। এর বাইরে মামলা পরিচালনায় বিশেষ আদায়ও হয়। সব মিলিয়ে থানা আমীরদের হাতে থাকে মোটা অর্থ। এর একটি অংশ যায় আমীরের হাতে। এ অর্থ তারা সংগঠন গুছিয়ে নিতে ইচ্ছেমতো খরচ করেন। এ অর্থে অনেকেই বিলাসী জীবনযাপনও করছেন। জামায়াতের এ সূত্রটি আরও জানিয়েছে, কেবল অর্থ-ই নয়, জামায়াতের প্রত্যেক থানা আমীরকে দেয়া হয়েছে একটি করে মোটরসাইকেল, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ও স্মার্টফোন। অর্থসহ অন্য সুবিধাগুলো পাচ্ছেন শিবিরের শীর্ষ নেতারাও। ফলে নতুন করে জেগে উঠছে জামায়াত। এদিকে, গত মঙ্গলবার বিকেলে নগরীর সাহেববাজার মসজিদ মিশন একাডেমীতে অভিযান চালিয়ে পুলিশ রাজশাহী জামায়াতের শীর্ষ আট নেতাসহ ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে। পুলিশ বলছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রাজশাহীর টিপু রাজাকারের রায় ঘিরে নাশকতার সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এরা গোপন বৈঠক করছিলেন। তাদের কাছ থেকে জিহাদি বই উদ্ধারেরও দাবি করেছে পুলিশ। গ্রেফতারকৃতরা হলেন, নগর জামায়াতের সেক্রেটারি মাইনুল ইসলাম,প্রচার সেক্রেটারি শাহাদাৎ হোসাইন, বোয়ালিয়া (পশ্চিম) থানা আমীর আমিনুল ইসলাম, রাজপাড়া থানা আমীল কামরুজ্জামান সোহেল, কাশিয়াডাঙ্গা থানা আমীর ফরিদ উদ্দিন আত্তার, সূরা সদস্য সিরাজুল ইসলাম, নগর শ্রমিক কল্যাণ সভাপতি আবদুস সামাদ, জামায়াত সদস্য মাহফুজুল্লাহ জহির, আরিফিন মৃধা ও তহিদুল ইসলাম। ওই দশ জামায়াত নেতাকে গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নগর পুলিশের মুখপাত্র গোলাম রুহুল কুদ্দুস। তিনি বলেন, নাশকতার উদ্দেশ্যে গোপন বৈঠকের খবর পেয়ে অভিযান চালিয়ে মসজিদ মিশন একাডেমী থেকে ওই ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তবে পালিয়ে গেছেন আরও বেশ কয়েকজন। এ নিয়ে গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে নাশকতার একাধিক মামলা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, জামায়াতের কর্মকান্ড গভীরভাবে নজরে রাখছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। ফলে নতুন করে সংঘটিত হয়ে নাশকতা ঘটনার সুযোগ নেই। জন নিরাপত্তায় পুলিশ সব ধরনের ব্যবস্থা নেবে। পুলিশের বিরুদ্ধে জামায়াত নেতাদের তোষণের অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে। এর আগে গত ৮ ডিসেম্বর রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম নেতাকর্মীদের সর্তক করেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের এখন সুখের সময় নয়। আমাদের লড়াই শেষ হয়নি। বিএনপি-জামায়াত ও জঙ্গিরা বিষধর সাপ। সুযোগ পেলেই তারা আমাদের ছোবল দেবে। ওই সময় লড়াইয়ের জন্য নেতাকর্মীদের প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন নাসিম।
Share on Facebook
Follow on Facebook
Add to Google+
Connect on Linked in
Subscribe by Email
Print This Post