প্রশান্তি ডেস্ক ২০১৬ সালের অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে দুই দিনের সফরে ঢাকায় এসেছিলেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। সে সময় পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ, কর্ণফুলী নদীর নিচে টানেল নির্মাণ, যোগাযোগ অবকাঠামো, তথ্য ও যোগাযোগ-প্রযুক্তিসহ নানা ধরনের উন্নয়ন কাজে ২৭টি প্রকল্পে ২ হাজার ৪শ’ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি দেয় চীন। তবে তিন বছরে সেই ২৭টি প্রকল্পের মাত্র ৬টির ঋণচুক্তি করা সম্ভব হয়েছে দেশটির সাথে। এতে প্রতিশ্রুত ঋণের মাত্র ৫ শতাংশ অর্থছাড় করেছে চীন।
অথচ সে সময়ের সমঝোতা অনুযায়ী, এসব প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২০ সালের মধ্যে। সে হিসাবে হাতে আছে মাত্র ১২ মাস। ফলে এই সময়ের মধ্যে চীনের প্রতিশ্রুত অর্থ পাওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা। শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফরে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার সম্পর্কে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা আসে। ২০১৭ সালকে বন্ধুত্বের বছর হিসেবে ঘোষণাও করেছিলেন শি জিনপিং। এরই অংশ হিসেবে তার সফরে ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলার ঋণ প্রদানে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়। এ বিষয়ে সরকারের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘গত তিন বছরের চেষ্টায় এখন পর্যন্ত চীনের সঙ্গে ৬টি ঋণচুক্তি করা সম্ভব হয়েছে। আর দেশটি এখন পর্যন্ত পাঁচটি প্রকল্পে এক বিলিয়ন (১০০ কোটি) মার্কিন ডলারের কিছু বেশি অর্থ ছাড় করেছে।’ তিনি বলেন, ‘২০২০ সালের মধ্যে ২৭টি সমঝোতা ঋণচুক্তি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। এতে আরও সময় লাগবে। দুপক্ষ আলোচনার মাধ্যমে মেয়াদ বাড়াবে।’ তবে সবগুলো চুক্তি সম্পন্ন হতে কতদিন লাগবে সে সম্পর্কে কোনো ধারণা দিতে পারেননি ওই কর্মকর্তা। বিশ্লেষকরা বলছেন, জিটুজি (গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট) ভিত্তিতে দেয়া এ ঋণে বাস্তবায়িত প্রকল্পের ঠিকাদার হবে চীনের প্রতিষ্ঠান। দরপত্র ছাড়াই এসব ঠিকাদার নিয়োগ দিতে হয়। ফলে পারস্পরিক দর-কষাকষির মাধ্যমে প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারিত হবে। চীনের প্রতিষ্ঠানের কাজের মান নিয়েও সংশয় রয়েছে। এর অন্যতম উদাহরণ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ। নির্ধারিত সময়ে এটি বাস্তবায়ন করতে না পারায় প্রকল্প ব্যয় কয়েক দফা বেড়েছে। একই অবস্থা ছিল ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেন প্রকল্পেও। পদ্মা সেতু ছাড়া দেশের অগ্রাধিকারমূলক অন্যান্য প্রকল্পে তেমন কোনো গতি নেই। এছাড়া চীন থেকে কেনা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) বাস ও রেলওয়ের ডেমু ট্রেন এখন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েক বছরের মধ্যেই অকেজো হয়ে পড়ে এসব বাস ও ট্রেন। পাশাপাশি এগুলো মেরামতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। তাই উচ্চ সুদহার ও কঠিন শর্তের কারণে এ ঋণ বাংলাদেশের দায় হয়ে উঠবে কি-না তা নিয়ে সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, চীনের কাছ থেকে ঋণ নেয়ার একটি ঝুঁকি আছে। তাদের কাছ থেকে ঋণ নেয়া অধিকাংশ দেশই ওই ঋণের জালে আটকা পড়েছে। এর অন্যতম কারণ প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। তাদের প্রকল্প খরচ প্রকৃত খরচের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি হয়। এদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য চীনের সহায়তা প্রয়োজন। তবে আমরা ঋণের ফাঁদ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, চুক্তি অনুযায়ী ঋণচুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত বাংলাদেশকে কোনো সুদ দিতে হবে না। তবে এর পর শতকরা দুই ভাগ অর্থ সুদ হিসাবে দিতে হবে। জানা গেছে, দুই শতাংশ সুদহার ছাড়াও চীনের ঋণে দশমিক ২০ শতাংশ কমিটমেন্ট চার্জ ও দশমিক ২০ শতাংশ ম্যানেজমেন্ট চার্জ দিতে হবে। ঋণ ছাড় করতে যত দেরি হবে কমিটমেন্ট ও ম্যানেজমেনট চার্জ তত বাড়তে থাকবে। আর পাঁচ বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ ২০ বছরে পরিশোধ করতে হবে পুরো ঋণ। আর ঋণে নতুন শর্ত হিসেবে ১৫ শতাংশ সরকারকে দিতে হবে। এছাড়া ঋণের কিছু অংশ হবে বাণিজ্যিক ভিত্তিক। এ ঋণের সুদের হার হবে চার শতাংশ ও পরিশোধ করতে হবে ১৫ বছরে। উল্লেখ্য, ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড নীতি ধরে এগিয়ে যাওয়া চীনের সহযোগিতা কার্যক্রম সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে ২০১৬ সালে বাংলাদেশে আসেন শি জিনপিং। এর আগে ১৯৮৬ সালে লি শিয়ানইয়ান চীনের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে প্রথম বাংলাদেশ সফরে আসেন। ২০১৬ সালে জিনপিংয়ের সফরে যে প্রকল্পগুলোতে ঋণচুক্তি সই হয়েছে সেগুলো হলো- ৫০ কোটি ডলারের ‘ইন্সটলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপলাইন’ প্রকল্প, ২০ কোটি ডলারের ‘মর্ডানাইজেশন অব টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক ফর ডিজিটাল কানেক্টিভিটি’ প্রকল্প, ১৬৫ কোটি ৮৫ লাখ ডলারের ‘পদ্মা ব্রিজ রেল লিংক (ফেজ-১)’ প্রকল্প এবং ৯১ কোটি ৭১ লাখ ডলারের ‘পদ্মা ব্রিজ রেল লিংক (ফেজ-২)’ প্রকল্প। এছাড়া ‘ডেভেলপমেন্ট অব ন্যাশনাল আইসিটি ইনফ্রা-নেটওয়ার্ক ফর বাংলাদেশ গর্ভমেন্ট ফেজ-৩’ এবং ‘কন্সট্রাকশন অব টানেল আন্ডার দ্য রিভার কর্ণফুলী’ প্রকল্প। এ দুটির সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয় যথাক্রমে ১৫ কোটি ও ৭০ কোটি ৫৮ লাখ ডলার।