প্রশান্তি ডেক্স ॥ ওয়াহিদুজ্জামান অনিক বেসরকারি চাকরিজীবী। অন্য স্বাভাবিক দিনের মতোই খ্রিষ্ট বছরের প্রথম দিন গত (বুধবার) সকালে নিজ কর্মক্ষেত্রে (অফিসে) উপস্থিত হন। স্বাভাবিকভাবেই তার পাশের ডেস্কে বসা সহকর্মী জুবায়ের আল হাসান উচ্চস্বরে বলে উঠলেন ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ অনিক ভাই। তখনও ওয়াহিদুজ্জামান অনিক কোনো উত্তর না দিয়ে মুখটা গোমড়া করেই রাখলেন। কিছুক্ষণ পর কিছুটা হতাশাগ্রস্তভাবে উত্তর দিলেন, জুবায়ের ভাই আমরা যারা জীবিকার তাগিদে ঢাকায় ভাড়া বাসায় থাকি তাদের জন্য প্রতি বছরের শুরুটা দুঃখ দিয়ে শুরু হয়। রাজধানী ঢাকায় এমনিতেই অনিয়ন্ত্রিত বাসা ভাড়া। যেখানে বেশিরভাগ মানুষেরই বেতনের সিংহভাগই চলে যায় বাসা ভাড়া দিতে। তারপর আবার বাসা মালিকরা অপেক্ষায় থাকেন কখন নতুন বছর আসবে। নতুন বছর আসলেই তারা বাসা ভাড়া বাড়িয়ে দেন। নতুন বছর আসা উপলক্ষে আমি যে বাসায় থাকি সেই বাসার মালিক ১ হাজার টাকা ভাড়া বাড়িয়েছেন। তাই নতুন বছরের প্রথম দিন মনটা বেশি খারাপ। শুধু ওয়াহিদুজ্জামান অনিকই নন, রাজধানীতে বসবাসকারী বেশিরভাগ ভাড়াটিয়াই এমন সমস্যার পড়েছেন বছর শুরুর দিন। কারণ বেশিরভাগ বাসার মালিকই নতুন বছরে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই ভাড়ার বাড়তি বোঝা চাপিয়ে দেন ভাড়াটিয়াদের কাঁধে। ফলে প্রতি বছর জানুয়ারি এলেই ভাড়া বৃদ্ধির খড়্গ নামে ভাড়াটিয়াদের ওপর। বছরের শুরুতে বাসা ভাড়া বাড়ার বিষয়ে ওয়াহিদুজ্জামান অনিক অনেকটা ক্ষোভ প্রকাশ করে এই প্রতিবেদককে বলেন, বাসা ভাড়া যন্ত্রণা থেকে কিছুটা রেহাই পেতে মগবাজার অফিস হওয়া সত্ত্বেও মিরপুরের কাজিপাড়ার ভেতরের দিকে বাসা নিয়েছি। বর্ষার সময় যে এলাকায় থাকে হাঁটু পানি, যাতায়াতের জন্য বাসেও ঠিকমতো উঠতে পারি না। কারণ বাসে আগে থেকেই অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই হয়ে আসে। কোনো মতে বাদুড় ঝোলা হয়ে অফিসে আসতে হয়। অফিস মগবাজার তবুও এত দূরে বাসা ভাড়া নিয়েছি এর একটাই কারণ যেন তুলনামূলক কম ভাড়ায় থাকতে পারি। তিনি বলেন, ১১ হাজার টাকায় দুই বছর আগে এই বাসায় উঠেছি, এখানে গ্যাস পানি বিদ্যুৎসহ সব মিলিয়ে ১৩ হাজার টাকা লাগে। আমি বেতনই পাই ২৫ হাজার টাকা, যার সিংহভাগই চলে যায় বাসা ভাড়া দিতেই। এছাড়া সংসার খরচ আছে, আমার যাতায়াত খরচ আছে। ফলে মাসের শেষে শুরু হয় অভাব অনটন। এর মধ্যে আবার নতুন বছর উপলক্ষে বাসার মালিক ১ হাজার টাকা ভাড়া বাড়িয়েছেন। আমি প্রতিবাদ করলে বাসার মালিক বললো না পোষালে চলে যান। অনেক ভাড়াটিয়া আছে। এখন যদি বাসা পরিবর্তন করি তাহলেও এক বড় খরচ, তাই সেটাও করতে পারছি না। বাসা ভাড়া বাড়িয়ে বাড়িওয়ালারা নতুন বছরকে স্বাগত জানালো। যে কারণে ভাড়াটিয়াদের কাছে নতুন বছর শুরু হয় বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির আতঙ্ক নিয়ে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ২০০৭ সালে ঢাকা শহরের ৭৭৫টি এলাকায় ১০টি রাজস্ব আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প, কাঁচাবাড়ি, পাকা ঘর, সেমি পাকা, মেইন রোডের তিনশ ফিট ভেতরে এবং বাইরে পাঁচ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত প্রতি স্কয়ার ফিট ভাড়া নির্ধারণ করা করে দেয়। কিন্তু এটির প্রয়োগ কোথাও দেখা যায় না। এছাড়া বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৯১ এ রয়েছে সুনির্দিষ্ট বিধান। আইনের ১৬ ধারায় বলা হয়েছে, বড় কোনো ধরনের নির্মাণকাজ বা পরিবর্তন আনা ছাড়া বাসার মালিক দুই বছরের মধ্যে মূল ভাড়া বৃদ্ধি করতে পারবেন না। রাজধানীতে বসবাসকারী বেশিরভাগেরই বেতনের সিংহভাগই চলে যাচ্ছে বাড়ি ভাড়া পরিশোধ করতে। সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু জীবনযাপনের অংশ হিসেবে বাসস্থানের অর্থাৎ বাড়ি ভাড়া নিয়ে মানসিকভাবে প্রচন্ত চাপ আর যন্ত্রণার মধ্যে থাকতে হয় ভাড়াটিয়াদের।
রাজধানীর উত্তর বাড্ডায় ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে স্ত্রী-সন্তানসহ দুই রুমের একটি বাসায় উঠেছিলেন আমিনুল ইসলাম নামের এক বেসরকারি চাকরিজীবী। নতুন বছরের আগমন উপলক্ষে বাসার ভাড়াও ৫০০ টাকা বাড়িয়েছেন বাড়ির মালিক। আমিনুল ইসলাম বলেন, নতুন বছর আসলে আমরা ভাড়াটিয়ারা থাকি আতঙ্কে, কারণ প্রতি বছর বাসা ভাড়া বাড়ানো বাড়ি মালিকদের কাছে একটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। বাসা ভাড়া বাড়ালে সেই রাগে যে বাসা পরিবর্তন করবো, সেটাও করা যায় না। কারণ বাসা পরিবর্তন করতে কমপক্ষে অতিরিক্ত ৫-৬ হাজার টাকা খরচ করতে হবে। এছাড়া নতুন বাসায় কমপক্ষে এক মাসের অগ্রিম ভাড়া দিতে হবে। এত খরচ বহন করা কঠিন, তাই বাসা মালিকদের চাপিয়ে দেয়া ভাড়া বৃদ্ধির খড়্গ নিয়েই থাকতে হয় আমাদের মতো অসহায় ভাড়াটিয়াদের। রাজধানীর মিরপুরের এক বাসার মালিক এরশাদ আলীও নতুন বছর উপলক্ষে ভাড়াটিয়াদের ৫০০ টাকা বৃদ্ধি করা হবে মর্মে নোটিশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, যারা চাকরি করে তাদের তো প্রতি বছরই ইনিক্রিমেন্ট বা বেতন বৃদ্ধি হয়। এছাড়া জীবনযাত্রায় সব কিছুরই দাম বাড়ছে। তাহলে বছরে আমরা যদি ৫০০ টাকা বাড়ি ভাড়া বাড়াই তাহলে কেন এত আপত্তি। কোটি কোটি টাকা খরচ করে একটা বাড়ি বানানো হয়, এটাই আয়ের প্রধান উৎস। গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ে, নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে, যারা চাকরি করেন তাদের বেতন বাড়ে…। তাহলে তো আমরাও প্রতি বছর বাড়ি ভাড়া বাড়ানোর অধিকার রাখি। এ বিষয়ে ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহরানে সুলতান বাহার বলেন, বছরের প্রথম মাস এলেই বাড়িওয়ালারা বাড়ি ভাড়া বাড়িয়ে দেন। আমরা যারা ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকতে বাধ্য তাদের এই নির্মম অত্যাচার সহ্য করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। নিজেদের কর্মস্থল এবং বাচ্চাদের স্কুল-কলেজের জন্য হলেও ভাড়া বৃদ্ধিতে আমরা থাকতে বাধ্য হই। আমাদের আয়ের প্রায় ৬০-৭০ শতাংশ বাড়ি ভাড়া দিতে হয়। এমন সমস্যা সমাধানে আইন ও বিধি যুগোপযোগী করে তার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সিটি কর্পোরেশনকে মনিটরিংয়ের পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হবে।