সরিষাখেতে মৌচাষ লাভবান চাষি

প্রশান্তি ডেক্স ॥ মধু সংগ্রহ করছেন মৌচাষি গ্রামের খেতজুড়ে আবাদ হয়েছে সরিষা। আর এই সরিষাক্ষেতে মৌচাষ করে লাভবান হচ্ছে কৃষক-মৌচাষি উভয়ই। কারণ সরিষাখেতে মৌচাষ করলে জমির ফলনও বাড়ে। মাঠজুড়ে এখন সরিষার হলুদ রঙের সমারোহ। সরিষার এসব জমির পাশেই মৌচাষের বাক্স বসিয়েছেন মৌচাষিরা। এতে মৌমাছির মাধ্যমে সরিষা ফুলের পরাগায়নে সহায়তা হচ্ছে। ফলে একদিকে সরিষার উৎপাদন বাড়ছে, অপরদিকে মধু আহরণ করা যাচ্ছে। ফলে সমন্বিত এই চাষে লাভবান চাষিরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর টাঙ্গাইল জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলার ১২টি উপজেলার এ বছর ৪১ হাজার ৫০৭ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। এসব খেতের পাশে প্রায় তিন হাজার মৌ চাষের বাক্স স্থাপন করা হয়েছে। এই বাক্স থেকে এবার একশ টন মধু সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে কৃষি বিভাগ। কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, উচ্চ ফলনশীল ও স্থানীয় উভয় জাতের সরিষা কৃষকরা চাষ করে। দুই জাতের সরিষা নভেম্বরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আবাদ করতে হয়। ফসল ঘরে উঠতে সময় লাগে জাত ভেদে ৭০ থেকে ৯০ দিন। টাঙ্গাইল জেলার বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে এখন সরিষা ফুলের সমারোহ। কৃষক যেমন এই মাঠে সরিষার পরিচর্যা করছে, তেমনি খেতের পাশেই মৌমাছির বাক্স বসিয়ে মধু সংগ্রহ করছেন মৌচাষিরা। সরেজমিন নাগরপুরের গয়হাটা, ধুবড়িয়া, ভাদ্রা, মোকনা, দপ্তিয়র, মামুদনগর, বেকড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় মৌচাষি দিয়ে সরিষাখেতের পাশে মৌচাষের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বেশির ভাগ মৌচাষি এসেছেন সাতক্ষীরা, ফরিদপুরসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। কথা হয় সাতক্ষীরার মৌচাষি আব্দুর রহমানের সঙ্গে। তিনি উপজেলার মোকনা ইউনিয়নের বেটুয়াজানীতে তার মৌ চাষের বাক্স স্থাপন করেছে। এসব মৌচাষিদের নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছেন স্থানীয় কৃষকরা। স্থানীয় কৃষক রফিক মিয়া আক্ষেপের সুরে বলেন, আমাদের যদি কৃষি অফিস মৌচাষের প্রশিক্ষণ দিত তাহলে আমরা সরিষার সঙ্গে মৌচাষ করে অধিক লাভবান হতে পারতাম। এছাড়া কালিহাতী উপজেলার মগড়া ইউনিয়নের জোগাপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সরিষা ক্ষেতের পাশে একশ মৌচাষের বাক্স স্থাপন করেছেন মতিয়ার রহমান। সাতক্ষীর শ্যামনগর উপজেলা থেকে তিনি এসেছেন মধু সংগ্রহে। এই বাক্স থেকে পাঁচ থেকে সাত মণ মধু সংগ্রহ করতে পারবেন বলে আশা করছেন। সদর উপজেলার গালা গ্রামে একশ সাতটি বাক্স বসিয়েছেন সাতক্ষীরার মিলন সরদার ও মনিরুল ইসলাম। নাগরপুর উপজেলার ধলেশ্বরী শামছুল হক সেতুর পাশে একশ ২০টি বাক্স বসিয়ে মধু আহরণ করছেন একই জেলার আব্দুর রহমান। তারা জানান, সাতক্ষীরা থেকে টাঙ্গাইল অঞ্চলে সরিষা ফুলের মধু সংগ্রহে ১৫ থেকে ২০ জন মৌমাছি খামারি এসেছেন। পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ের মৌচাষিরাও মধু সংগ্রহ করছেন। টাঙ্গাইল সদর উপজেলার সন্তোষ গ্রামের আমিনুল ইসলাম ৮০টি বাক্স বসিয়েছেন যমুনার চরাঞ্চলের কাতুলী গ্রামে। সংগ্রহ করা মধু ঢাকার বিভিন্ন কোম্পানির কাছে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা করছেন মধু সংগ্রাহকরা। আগে কৃষকের ফলন নষ্ট হবে ভেবে তাদের আবাদি জমিতে মৌ বাক্স বসাতে দেয়নি। অথচ মৌ চাষের ফলে সরিষার ২০ শতাংশ ফলন বাড়ে। শুধু সরিষাই নয়, মৌমাছিরা ফুলের পরাগায়ন ঘটিয়ে নানা ধরনের রবিশস্যের ফলন বাড়ায়। পরে কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে আবাদি জমির পাশে মৌমাছির বাক্স স্থাপন করতে সহযোগিতা করছেন সাধারণ কৃষক। বর্তমানে মৌচাষে প্রতি বাক্স থেকে সপ্তাহে ৪-৫ কেজি মধু সংগ্রহ করা যায়। তবে অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাসে মধু সংগ্রহ বেশি হয়। ৩০টি বাক্সে ১২০ থেকে ১৫০ কেজি মধু সংগ্রহ করা হয়। যার বাজারমূল্য ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা। মৌচাষে অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে। মৌচাষের কারণে একদিকে যেমন সরিষা উৎপাদন বাড়বে, অন্যদিকে অল্প খরচে অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আব্দুল রাজ্জাক জানান, মৌমাছি সরিষার ফুলে উড়ে উড়ে বসে মধু সংগ্রহ করে। এতে সরিষা ফুলে সহজে পরাগায়ন ঘটে। তাই দেখা গেছে সরিষাখেতের পাশে মৌচাষের বাক্স স্থাপন করলে সরিষার ফলন অন্তত ২০ শতাংশ বাড়ে। সঙ্গে মৌচাষির মধু আহরণ করেও লাভবান হতে পারেন। বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন মৌচাষ উন্নয়ন সংস্থার (মউস) নির্বাহী পরিচালক আবুল হোসেন জানান, টাঙ্গাইল অঞ্চলে ৭/৮শ প্রশিক্ষিত মৌচাষি রয়েছে। এরা সরিষাখেত থেকে মধু সংগ্রহ করায় সরিষার উৎপাদন বাড়ছে। পাশাপাশি মধু আহরণ করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করতে পারছে। মৌচাষিদের মধু আহরণের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি মধু সংরক্ষণের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। সংরক্ষণ করতে পারলে মৌচাষিরা আরও বেশি লাভবান হতে পারবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published.