উনিশ’শ’ একাত্তর সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলেও দেশের কয়েকটি বিহারী অধ্যুষিত এলাকা তখনও উত্তপ্ত ছিল। ওই সব স্থানে বাঙালী-বিহারী সংঘর্ষ বেঁধে যেত প্রায়ই। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিহারীদের অমানুষিক ও বর্বর আচরণের কারণে বাঙালীরা ছিল তাদের প্রতি ক্ষুব্ধ। যতদূর মনে পড়ে সময়টা ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে হবে। আমি তখন যশোরে ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের টু-আই-সি। একদিন রাত প্রায় ১২টার দিকে টেলিফোন পেলাম- খুলনায় বাঙালী-বিহারী সংঘর্ষ চলছে। ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তৎকালীন কমান্ডিং অফিসার মেজর মতিন বললেন দুই ঘণ্টার মধ্যে একটি কোম্পানি নিয়ে আমাকে ঘটনাস্থলে যেতে হবে। এর কিছুক্ষণ পরই ৫৫ বিগ্রেডের বিগ্রেড কমান্ডার লে. কর্নেল এম এ মঞ্জুর আমাকে ফোনে খুলনার খালিশপুরে বাঙালী-বিহারী সংঘর্ষের বিস্তারিত জানালেন এবং নির্দেশ দিলেন যত দ্রুত সম্ভব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য। নির্দেশ পেয়ে খুলনা পৌঁছে সূর্য ওঠার আগেই দাঙ্গা কবলিত এলাকায় সেনা মোতায়েন করলাম। গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে মেশিনগান ফিট করলাম। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলো।
কয়েকদিন পর বঙ্গবন্ধু দাঙ্গা কবলিত এলাকা দেখতে এলেন। লে. কর্নেল এম এ মঞ্জুর বিগ্রেড কমান্ডার হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে রিসিভ করলেন। বঙ্গবন্ধু ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনের পর খুলনা সার্কিট হাউসে চলে গেলেন। লে. কর্নেল এম এ মঞ্জুর আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার সময় বললেন, ভূইয়া আমি সার্কিট হাউসে যাচ্ছি, বঙ্গবন্ধু আমাকে ডেকেছেন। শুনে আমি আবেগতাড়িত হয়ে গেলাম। বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখার ইচ্ছে আমারও হলো। কোন কিছু না ভেবেই আমি জেনারেল মঞ্জুরকে বললাম স্যার, আমি কি আপনার সঙ্গে যেতে পারি? আমি কখনও বঙ্গবন্ধুকে দেখিনি। মঞ্জুর বললেন, ঠিক আছে চল, গাড়িতে ওঠ।
স্যারের সঙ্গে সার্কিট হাউসে গেলাম। লে. কর্নেল মঞ্জুর খুলনার পরিস্থিতি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রায় ৪০ মিনিট কথা বললেন। বিদায়ের আগে মঞ্জুর বঙ্গবন্ধুকে বললেন, স্যার, আমার সঙ্গে একজন অফিসার এসেছে, সে আপনাকে কখনও দেখেনি। আপনাকে দেখতে চায়। বঙ্গবন্ধু বললেন, ও তাই নাকি, ওর নাম কি? ঠিক আছে, ওকে ডাক।
আমি বঙ্গবন্ধুর কক্ষে ঢুকে সামরিক কায়দায় সালাম দিলাম। বঙ্গবন্ধু বললেন, ভূইয়া তুমি কেমন আছ? আমি জবাব দেয়ার আগেই হাসতে হাসতেই বললেন, আরে তুমি মেজর ভূইয়া না ক্যাপ্টেন ভূইয়া? আমি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছি। বঙ্গবন্ধু আবারও বললেন, তুমি যুদ্ধের সময় চট্টগ্রামে ছিলে। তোমরা চট্টগ্রামে যুদ্ধ করেছিলে তা আমি শুনেছি। তারপর বললেন, আমি নাসিরের (শেখ আবু নাসের) বাসায় যাচ্ছি। ইউ বোথ ফলো মি।
বঙ্গবন্ধু সফর সঙ্গীদের নিয়ে শেখ নাসের সাহেবের বাসায় পৌঁছলেন। খানাপিনার সুন্দর আয়োজন। বঙ্গবন্ধু খাবার টেবিলে বসলেন। টেবিলটি (আনুমানিক ২০ ফিট বাই ৪ ফিট) উত্তরে-দক্ষিণে সাজানো। দক্ষিণ দিকে বসলেন তিনি। তাঁর পাশে মন্ত্রী-এমপিরা বসলেন। এম এ মঞ্জুর ও আমি বসলাম অন্য সারিতে উত্তর প্রান্তে শেষ দিকে, মুখোমুখি। বঙ্গবন্ধু এদিক-ওদিক তাকিয়ে বললেন, আরে দেখতো, আমার সঙ্গে দু’জন সামরিক বাহিনীর অফিসার এসেছে, ওরা কোথায়? আমাদের অবস্থান জানার পর তিনি তাঁর ডানে এবং বামে বসা দুই মন্ত্রীকে অন্যত্র বসতে বলে আমাদের তাঁর কাছে এসে বসতে বললেন। আমি বসলাম বঙ্গবন্ধুর ডানে এবং মঞ্জুর বামে। মঞ্জুর আর আমি মুখোমুখি।
খাবার টেবিলেই বঙ্গবন্ধু জানতে চাইলেন, মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে চট্টগ্রামে কি ঘটেছিল। কিভাবে কি করেছিলাম। এক পর্যায়ে তিনি আমাকে ‘তুমি’ থেকে ‘তুই’ সম্বোধন করে কথা বলতে শুরু করলেন। আমি বিস্তারিত সংক্ষেপে বললাম। জানতে চাইলেন, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কথা। এক পর্যায়ে তিনি আমাকে বললেন, ওই ভূইয়া, তোরা তো একটা ভুল করেছিলি। আমাকে পাকিস্তানীরা ধরে নিয়ে গেল আর তোরা রেডিওতে প্রচার করেছিলি আমি তোদের সঙ্গেই আছিÑ এটা কেমনে করলি তোরা।
আমি বললাম, স্যার, আপনার নাম বলা ছাড়া তো আর কোন উপায় ছিল না। আমাদের কে চেনে!
বঙ্গবন্ধু বললেন, শোন্, আমি আছি পাকিস্তানীদের সঙ্গে আর তোরা বলছিলি আমি আছি তোদের সঙ্গে। এই অজুহাতে ওরা যদি আমাকে মেরে?
আমি বললাম, স্যার আসলে ওই সময় তো এত সিরিয়াসলি ভাবিনি। তবে আপনার নাম বলার কারণ ছিল জনসাধারণকে আমাদের পক্ষে টেনে আনা, তাদের মনোবল চাঙা রাখা। জনগণ যদি জানতো এবং বিশ্বাস করতো আপনি আমাদের সঙ্গে নেই, তখন তো যুদ্ধের শুরুতেই দেখা দিত বিশৃঙ্খলা বা হতাশা।
বঙ্গবন্ধু আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এক পর্যায়ে আমি বললাম, স্যার, একটা কথা বলি। আপনি তো দেশটা স্বাধীন হওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন। আমরা আপনার নাম ব্যবহার করার ফলে যদি তারা আপনাকে মেরেও ফেলত, বিনিময়ে যদি আমরা স্বাধীনতা পেতাম, আপনার আত্মা অন্তত শান্তি পেত।
বঙ্গবন্ধু আমার কথা শুনে হাসি দিয়ে খাবার টেবিল মাতিয়ে তুললেন। সেই স্মৃতিময় সাক্ষাত আমাকে আজও বিমোহিত করে। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই তিনি আমাকে তুমি থেকে তুই বলে আপন করে নিয়েছিলেন। এরপর যতবারই দেখা হয়েছে ততবারই তুই বলে সম্বোধন করতেন।
দুই.
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের লড়াইয়ের ঘটনা প্রবাহকে আমি একটি ডায়েরিতে লিখে রাখতাম। যুদ্ধের পর এই ডায়েরিটা আমার শ্বশুর, সমাজসেবক ও আহমদ পাবলিশিং হাউসের কর্ণধার মহিউদ্দিন আহমেদ সাহেবকে দেখালাম। ডায়েরিটা দেখে তিনি বললেন, এটা তো একটা সুন্দর বই হয়। তুমি এটাকে বই আকারে রূপ দাও না কেন? তাঁর এই পরামর্শ আমাকে আগ্রহী করে তুলল। তাঁর এই পরামর্শ মতো খুলনার খালিশপুরে পিপলস জুট মিলে বাঙালী-বিহারী দাঙ্গা দমনের দায়িত্ব পালনের ফাঁকে অবসর সময়টুকু কাজে লাগাই। সেখানে থাকা অবস্থায় প্রায় দুই মাস অনেক পরিশ্রম করে এই স্মৃতিগুলো বই আকারে দাঁড় করানোর জন্য স্ক্রিপ্ট তৈরি করলাম। আমি যেহেতু সেনাবাহিনীর অফিসার, তাই সেনাসদরের অনুমতি ছাড়া বই প্রকাশ করা সম্ভব না। সে জন্য সেনাসদরে ক্লিয়ারেন্সের জন্য পাঠালাম। কিন্তু অনুমতি পেতে বিলম্ব হচ্ছিল।
স্বাধীনতা যুদ্ধের ওপর বই, তাই আমার শ্বশুর বার বার তাগাদা দিচ্ছিলেন। যশোর থেকে ঢাকায় ফিরে আমি একদিন সুগন্ধায় গেলাম। এটা ছিল বঙ্গবন্ধুর সান্ধ্যকালীন অফিস। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেখানে বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। বঙ্গবন্ধু আমাকে দেখেই বললেন, কি ভূইয়া কেমন আছিস?
বললাম, ভাল আছি স্যার।
কেন এসেছিস, কাজ আছে?
বললাম, স্যার, আপনার সঙ্গে কথা ছিল।
তিনি বললেন, একটু অপেক্ষা কর। তারপর গুরুত্বপূর্ণ কাজ ও কথাবার্তা সেরে বঙ্গবন্ধু বললেন, তুই জানি কি বলতে চেয়েছিলি?
আমি বললাম, স্যার, আমি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণমূলক একটি বই লিখেছি। নাম দিয়েছি ‘মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস’। প্রকাশের জন্য অনুমতি চেয়ে সেনাসদরে পাঠিয়েছি; কিন্তু এক মাস হয়ে গেল অনুমতি পাই না।
তিনি বললেন, কেন? অনুমতি পেতে দেরি হচ্ছে কেন?
আমি বললাম, স্যার, কারণ তো বলতে পারব না। তবে ক্লিয়ারেন্স না পেলে তা প্রকাশ করতে পারছি না। তিনি বললেন, কে ক্লিয়ারেন্স দেয়?
আমি বললাম, নিয়মানুযায়ী সেনাসদর। স্যার, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, ছাপিয়ে ফেল না, কী হবে? পরক্ষণেই বললেন, ঠিক আছে, আর কয়েকটা দিন দেখ। বেশি দেরি হলে আমাকে জানাস।
তিন.
আমি তখন ১২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডিং অফিসার। দিনটা ছিল ২৬ ডিসেম্বর ১৯৭২। বঙ্গবন্ধু যশোর ক্যান্টনমেন্ট পরিদর্শনে এলেন। এ সময় ১২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পরিদর্শন করলেন। পরিদর্শনকালে ট্রুপসদের মহড়া দেখলেন, কোয়ার্টার গার্ড পরিদর্শন করলেন, পরিদর্শন বইতে স্বাক্ষর করলেন, অফিসার্স মেসে কিছুক্ষণ কাটালেন। তাঁকে সেদিন মহড়ার সময় এবং পরিদর্শনকালে অতি কাছ থেকে দেখার এবং তাঁর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল আমার। আপ্যায়নের সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এক বিশেষ মুহূর্তের ছবিও রয়েছে আমার।
চার.
’৭৪ সালের কথা। আমি তখন লেফটেন্যান্ট কর্নেল, ব্যাটালিয়নসহ বরিশালে। আমার ওপর দায়িত্ব ছিল আর্মস রিকভারি করার। আমার হেডকোয়ার্টার তখন বরিশালে। আমি আর্মস রিকভারিতে ব্যস্ত। সে সময় বঙ্গবন্ধুর মা সায়েরা খাতুন মারা যান। বঙ্গবন্ধু দাফন শেষে স্টিমারযোগে টুঙ্গিপাড়া থেকে ফেরার পথে বরিশাল এলেন। আমাকে এবং বরিশালের এসপি মোর্শেদকে স্টিমারে তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য খবর পাঠালেন। আমি এবং এসপি সেখানে গেলাম। তিনি আমাদের কাছে অস্ত্র উদ্ধার এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলেন। আমরা তাঁকে বিস্তারিত জানালাম। আজ মনে পড়ছে, সে সময় ওই এলাকার কুখ্যাত ডাকাত কুদ্দুস মোল্লাকে আমরা গ্রেফতার করেছিলাম। পাকিস্তান আমলেই যার ৫৪ বছরের জেল হয়েছিল। তার অত্যাচারে ওই অঞ্চলের মানুষ অতিষ্ঠ ছিল। বঙ্গবন্ধু এই গ্রেফতারের কথা শুনে সেদিন খুব খুশি হয়েছিলেন। সেই সময় তোফায়েল আহমেদও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন। সেদিনই তোফায়েল ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়।
পাঁচ.
আমি তখনও বরিশালে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার এবারের সাক্ষাতটা খুব একটা সুখকর ছিল না। আমি বৃহত্তর বরিশালের দায়িত্বে। আর্মস রিকভারির উদ্দেশ্যে আমার টু-আই-সি এক মেজরকে এক কোম্পানি সৈন্যসহ পটুয়াখালী অঞ্চলে দায়িত্ব দিয়েছিলাম। আর্মস রিকভারি একটি দুরূহ কাজ। কারণ, কেউ তার হাতে থাকা অস্ত্র জমা দিতে চায় না। যেহেতু স্বেচ্ছায় কেউ অস্ত্র জমা দেয় না, সে কারণে তা উদ্ধার করার জন্য মাঝে মধ্যে উদ্ধারকারীরা থার্ড ডিগ্রী মেথড এ্যাপ্লাই করে থাকেন। তখন সমগ্র বরিশালে সর্বহারা, গণবাহিনীর তৎপরতা ছিল। এক কথায় নানা ধরনের অপরাধীদের অভয়াশ্রম ছিল অঞ্চলটি। এদের তৎপরতায় সাধারণ মানুষ ছিল অতিষ্ঠ ও আতঙ্কগ্রস্ত। এ অবস্থায় আর্মস রিকভারি করতে গিয়ে পটুয়াখালীতে ট্রুুপসদের ভূমিকায় কিছুটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে বিস্তারিত জানতে আমাকে গণভবনে তলব করা হয়। সেদিন গণভবনে উপস্থিত ছিলেন সেনাপ্রধান কে এম শফিউল্লাহ, একজন মন্ত্রী ও কয়েকজন নেতা। বঙ্গবন্ধু আমার কাছে বিস্তারিত শুনলেন। কিছুক্ষণ শোনার পর দীর্ঘায়িত না করে বঙ্গবন্ধু অন্যদের বললেন, তোমরা যাও, আমি বিষয়টি দেখছি। আমাকে বললেন, তুই বস। তোর সঙ্গে কথা আছে। সবাই চলে যাবার পর বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, বাসায় চল।
আমি প্রথমে তাঁর কথা বুঝতে পারিনি। পরে তাঁর পেছনে পেছনে এলে তিনি বললেন, গাড়িতে ওঠ। ছোট্ট একটি গাড়ি। গাড়ির দরজা দিয়ে ঢুকতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর কষ্ট হচ্ছিল। আমি গাড়িতে বসে বঙ্গবন্ধুকে বললাম স্যার, আপনি এত ছোট্ট গাড়ি ব্যবহার করছেন?
বঙ্গবন্ধু বললেন, বড় গাড়িতে তেল খরচ বেশি হয়। দেখতেই তো পারছিস, দেশে তেল সঙ্কট চলছে।
আমি বললাম, স্যার আপনি একা সাশ্রয় করলেই কি হবে?
তিনি বললেন, আমার দেখাদেখি দেখিস অনেকেই তা করবে। আমাকে অনুসরণ করবে। তিনি আমাকে নিয়ে এলেন ৩২ নম্বরের বাড়িতে। বাসার তৃতীয় তলায় বসার জায়গায় বসতে বললেন। এই বাড়িতে আমার এই প্রথম আসা। মিনিট কয়েক পর বঙ্গবন্ধু এলেন। আমাকে দু-একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করার পর তিনি প্রসঙ্গ আনলেন বরিশালের পরিস্থিতি নিয়ে। আবারও জানতে চাইলেন বৃহত্তর বরিশালে সর্বহারা ও গণবাহিনীর তৎপরতা এবং তাদের কাছে অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়ে। আমি তাঁকে বললাম, সেনাবাহিনী মাঠে নামার পর গণবাহিনী এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। আর সর্বহারারা অস্ত্রসহ আত্মগোপনে। তারপরও আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি। তিনি আমাকে এই বিষয়ে কিছু পরামর্শ দিলেন। সেদিন আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর বাসায় চলে আসি।
ছয়.
সালটা ১৯৭৫, প্রথম দিকের কথা। বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রাম সফরে এলেন। আমি তখন বিডিআর-এর সেক্টর কমান্ডার। বঙ্গবন্ধু ভিজিটে আসায় আমাকে সেখানে যেতে হলো। বিকেলে তিনি হিমছড়িতে গেলেন। সেখানে ঝাউগাছ বেষ্টিত বাগানে বঙ্গবন্ধু তাঁর মন্ত্রিপরিষদের কয়েকজন সদস্যকে নিয়ে গল্প করছিলেন। আমি কাছাকাছিই বসেছিলাম। নানা কথার মাঝে বঙ্গবন্ধু এক পর্যায়ে আক্ষেপ করে তাঁর মন্ত্রিসভার এক সিনিয়র মন্ত্রীকে বললেন, দেখ…‘পরশ্রীকাতরতা’ শব্দটি একমাত্র আমাদের বাংলা ডিকশনারিতেই আছে। আর কোন ভাষার অভিধানে নেই। উল্লেখ্য, ওই মন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলার সময় অন্য কারও বিরুদ্ধাচরণ করছিলেন। কথাটি আজও আমার স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে।
সেদিনের আরেকটি ঘটনা এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। বঙ্গবন্ধু আলাপচারিতার এক পর্যায়ে বললেন, শোন, আইয়ুব খানের আমলে আমি যখন হুলিয়া নিয়ে দেশের নানা স্থানে ঘুরে বেড়াই, তখন এই পাহাড়ের পূর্বদিকে এক চৌকিদারের ঝুপড়ি ঘরে আমি আশ্রয় নিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু উপস্থিত ডিসিকে উদ্দেশ করে বললেন, দেখ তো তাঁকে খুঁজে বের করা যায় কিনা। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তাকে আনা হলো। তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু কথা বললেন এবং ডিসিকে তাৎক্ষণিক নির্দেশ দিলেন তার জন্য কিছু খাস জমির ব্যবস্থা করার জন্য।
সাত.
৬ জুলাই ১৯৭৫। বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়িতে দ্বিতীয়বার যাওয়া। আমি তখন চট্টগ্রামে বিডিআরের সেক্টর কমান্ডার। ঢাকায় হেড কোয়ার্টারে এসেছিলাম একটি কাজে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে ছিল। এক পর্যায়ে সুযোগও পেলাম। আমি আর বঙ্গবন্ধু ৩২ নম্বরের বাসায় তৃতীয় তলায় দক্ষিণের বারান্দায় বসে কথা বলছি। বঙ্গবন্ধু দেশের পরিস্থিতির পাশাপাশি আমার কাছে বাংলাদেশ-মিয়ানমার (বার্মা) সীমান্তের চোরাচালান সংক্রান্ত বিষয়াদি জানতে চাইলেন। আমি যেহেতু ওই অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সেক্টর কমান্ডার তাই আমাকে তিনি কিছু দিকনির্দেশনা দিলেন। সাক্ষাতের এক পর্যায়ে শেখ কামাল এলেন। সেনাবাহিনীর অফিসার হিসেবে তার সঙ্গে আমার আগে থেকেই পরিচয় ছিল। তবে বঙ্গবন্ধুকে সেদিন খুব বিষণœ মনে হয়েছিল। তাঁকে চিন্তিত মনে হয়েছিল। এই দীর্ঘ সময়ের কথাবার্তায় কখনও মনে হয়নি আমি একজন রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে কথা বলছি। আসার সময় তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললেন, ‘ভাল থাকিস।’ সেই দেখাই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার শেষ দেখা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এই ভূখন্ডে জন্মগ্রহণ করেছেন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া নামক এক অজপাড়াগাঁয়ে। তারপর অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তিনি শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু এবং জাতির পিতা হয়েছেন। হয়েছেন ইতিহাসের মহানায়ক, সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী। বঙ্গবন্ধু মনেপ্রাণে ছিলেন খাঁটি বাঙালী। তাঁর চলনে বলনে বেশভূষায় বাঙালিত্বের ছাপই লক্ষ্য করা গেছে। সাধারণ জীবন যাপনে তিনি ছিলেন অভ্যস্ত। তাঁর মতো সাহসী রাজনীতিবিদ ইতিহাসে খুবই কম। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও দেশপ্রেমে অটল ছিলেন তিনি। ছিলেন আপোসহীন ও নির্ভীক। দু’বার ফাঁসির মঞ্চ থেকে ফিরে এসেছেন। তিনি ছিলেন দূরদর্শী, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে। এদিন তিনি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এড়িয়ে গিয়ে এমন বক্তব্য দিলেন, যা স্বাধীনতার ঘোষণারই শামিল। মানুষকে খুব সহজে আপন করে নিতেন, যার প্রমাণ আমি নিজেও। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর। হিমছড়ির সেই চৌকিদারের কথা নামসহ মনে রাখা এবং তাকে সহায়তা এর বড় দৃষ্টান্ত হতে পারে। বিশ্বভ্রাতৃত্বের প্রতি তিনি ছিলেন উদার। তাঁর কূটনৈতিক দূরদর্শিতার কারণে অল্পসময়ে সদ্য স্বাধীন একটি দেশকে পৃথিবীর বহু দেশ স্বীকৃতি দিয়েছিল। তাঁর নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্বের কারণেই স্বাধীনতার মাত্র তিন মাসের মধ্যে ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশ ত্যাগ করে। পৃথিবীর ইতিহাসে এই ধরনের ঘটনা বিরল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে ১৯৪৫ সালে। অথচ আজও বিদেশী সৈন্য রয়ে গেছে জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপিন্স, জাপানসহ পৃথিবীর বহু দেশে। শুধু তাই নয়, দেশ স্বাধীনের পর মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রসমর্পণ প্রক্রিয়াটিও হয়েছিল তাঁরই ব্যক্তিত্বের কারণে। এই গুণের কারণে বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন এ দেশের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে হয়ে উঠেছিলেন জাতির প্রতীক। স্কুল জীবন থেকেই ধাপে ধাপে এ পর্যায়ে এসেছেন তিনি। হঠাৎ করে নেতা হননি বা ক্ষমতায় আসেননি তিনি। বড় নেতা তারাই যারা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও বড় হতে থাকেন। তাদের হত্যা করে সমাজ থেকে নির্বাসিত করা যায় না। তারা বারবার ফিরে আসেন। আব্রাহাম লিংকন, মার্টিন লুথার কিং, মহাত্মা গান্ধীকেও কূচক্রীরা হত্যা করেছে, কিন্তু ইতিহাস থেকে মুছতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুকেও বাঙালীর ইতিহাস থেকে মুছে দিতে কম চেষ্টা হয়নি, কিন্তু পারেনি। আসলে ইতিহাস কারও নির্দেশে রচিত হয় না। ইতিহাস তার নিজস্ব গতিতেই চলে। ইতিহাসের সত্য রক্ষার খাতিরে ইতিহাসই বঙ্গবন্ধুকে ধরে রাখবে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর দ্বারপ্রান্তে আমরা। জাতির পিতা সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছি। আমি আজ সৌভাগ্যবান ও গর্বিত যে, জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে কাজ করছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমর্থন নিয়ে পরপর তিনবার কুমিল্লা-১ (দাউদকান্দি ও মেঘনা) আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে এসেছি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কাজে প্রধানমন্ত্রীর পাশে কাজ করছি। আমি গর্বিত একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী দল আওয়ামী লীগের পতাকাতলে আশ্রয় পেয়েছি। আমি জীবনের শেষ দিনটিও যেন আওয়ামী লীগ ও দেশবাসীর জন্য আত্ম-উৎসর্গ করতে পারিÑআল্লাহর দরবারে এই ফরিয়াদ আমার। (সমাপ্ত)
লেখক : সংসদ সদস্য, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি