প্যারোলে মুক্তি নিয়ে এ মাসেই লন্ডন যাচ্ছেন খালেদা জিয়া

প্রশান্তি ডেক্স॥ দুর্নীতি মামলায় কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন তার ভাই-বোনেরা। উন্নত চিকিৎসার জন্য চলতি মাসে বিদেশ যাচ্ছেন- এমন গুঞ্জন এখন বিএনপির সর্বত্র।চলতি বছরের শুরু থেকে বিএনপি বেগম জিয়ার প্যারোলে মুক্তি নিয়ে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে আসছিল। সরকারও রাজি ছিল। কিন্তু বাধ সাধে বিএনপির ঢাকা আর লন্ডনের দ্বিমুখী সিদ্ধান্ত। এখানে বিএনপির রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির হিসাব আছে, বিষয়টি খালেদা জিয়া নিজেও জানেন।


সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত মঙ্গলবার (১১ ফেব্রুয়ারি) বিএসএমএমইউতে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে পরিবারের পক্ষ থেকে ‘উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ পাঠানোর’ আবেদন করা হয়। যদিও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ‘খালেদা জিয়ার পরিবারের আবেদনের’ বিষয়টি জানেন না বলে জানান। গত ১২ ফেব্রুয়ারি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পরিবারের পক্ষ থেকে চিঠি দেয়া হয়েছে কি-না, সেটা আমার জানা নেই। তবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের শুক্রবার দাবি করেন, বেগম খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে আমার সঙ্গে ফখরুল ইসলামের টেলিফোনে কথা হয়েছে। তিনি আমাকে অনুরোধ করেছেন, আমি যেন প্রধানমন্ত্রীকে খালেদা জিয়ার প্যারোলের বিষয়ে বলি। এদিন রাজধানীর ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
‘বিএনপি বারবার সরকারের কাছে খালেদা জিয়ার মুক্তি বা প্যারোলে মুক্তি চাচ্ছে, কিন্তু বিষয়টি রাজনৈতিক মামলা নয়। সরকার বিষয়টি তখনই বিবেচনা করতে পারতো, যদি সেটা রাজনৈতিক হতো’- বলেন ওবায়দুল কাদের।
বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে বিশেষায়িত হাসপাতালে খালেদা জিয়ার চিকিৎসার দাবি করে আসছে। কিন্তু কারাবিধি অনুযায়ী বন্দি হিসেবে তাকে সরকারি হাসপাতাল বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের কেবিনে ভর্তি করে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। খালেদা জিয়ার দাঁত ও জিহ্বার চিকিৎসা সেখানে ভালোভাবে সম্পন্ন হলেও তার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এটি খুব ঊর্ধ্বমুখী। এর প্রভাবে তিনি যেকোনো সময় আরও বেশি অসুস্থ হয়ে যেতে পারেন- এমন দাবি পরিবার ও বিএনপির। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে সরকার খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি বিবেচনা করবে।
সূত্রের দাবি, সরকার ও যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে বেগম খালেদা জিয়াকে নেয়া হবে। গত বছরের মার্চ থেকেই শোনা যাচ্ছে, উন্নত চিকিৎসার জন্য প্যারোলে মুক্তি নিয়ে কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বিদেশ যাবেন।
সূত্র আরও বলছে, বেশকিছু দেশের কূটনীতিকরাও খালেদা জিয়ার প্যারোলের বিষয়ে সরকারের কাছে সুপারিশ করেছে। কূটনীতিকদের পরামর্শ অনুযায়ী বিএনপি সংসদে ফিরেছে এবং গঠনমূলক রাজনীতির অংশ হিসেবে বিএনপি মহাসচিব বিভাগীয় পর্যায়ে সমাবেশ করছেন। সেখানে সরকারের পক্ষ থেকে কোথাও কোনো বাধা দেয়া হয়নি।
জানা গেছে, খালেদা জিয়ার প্যারোলের বিষয়ে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল লন্ডনে অবস্থানরত তার বড় ছেলে তারেক রহমান। কিন্তু খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবনতির কারণে তিনি নিজের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। তার সঙ্গে কথা বলেই শামীম ইস্কান্দার পরিবারের পক্ষ থেকে সর্বাধুনিক সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে তাকে বিদেশ প্রেরণের জন্য মেডিকেল বোর্ডের সুপারিশ চেয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল (বিএসএমএমইউ) কর্তৃপক্ষকে পরিবারের পক্ষ থেকে চিঠি দিয়েছেন।
খালেদা জিয়ার আবেদনটি মেডিকেল বোর্ডে পাঠানো হয়েছে বলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রও নিশ্চিত করেছে। পরিবারের পক্ষ থেকে খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর জন্য তার পরিবারের পক্ষ থেকে এটাই প্রথম লিখিত আবেদন বলে জানায় ওই সূত্র।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, খালেদা জিয়ার প্যারোলের বিষয়ে সরকার শুরু থেকে আন্তরিক থাকলেও রাজনৈতিক নানা সমীকরণ মেলাতে গিয়ে বিলম্ব করেছে বিএনপি। দলটি না পেরেছে মুক্তির আন্দোলনে রাজপথ উত্তপ্ত করতে, না পেরেছে আইনি প্রক্রিয়ায় সামনে এগোতে। বিএনপির ক্ষয়িষ্ণু রাজনৈতিক সক্ষমতার ওপর ভরসা রাখতে পারেনি খালেদার পরিবার। তবে, পরিবারের পক্ষ থেকে খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর জন্য এবারই প্রথম লিখিত আবেদন করা হলো।
সূত্রের দাবি, সমঝোতার অংশ হিসেবেই আবেদন করা হয়েছে। খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক তথা ভাগ্নে ডা. মামুন সব প্রক্রিয়া গুছিয়ে আনছেন। সব আইনি প্রক্রিয়া সেরে মেডিকেল বোর্ডের সার্টিফিকেট ও স্থানান্তরের সুপারিশ নিয়েই খালেদা জিয়াকে লন্ডন পাঠানো হতে পারে।
খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে পরিবারের আবেদন সম্পর্কে শামীম ইস্কান্দার বলেন, তার দ্রুত অবনতিশীল স্বাস্থ্যের পরিপ্রেক্ষিতে যেকোনো অপূরণীয় ক্ষতি এড়াতে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত বিদেশি হাসপাতালে চিকিৎসা প্রয়োজন। খালেদা জিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে ব্যয় বহনসহ তাদের দায়িত্বে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে আবেদনে। আবেদনটি বিবেচনা করা হবে বলে আশা করছে পরিবার।
গংশ্লিষ্টদের সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১৫ এপ্রিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কেবিনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ও গয়েশ্বরচন্দ্র রায়। আবেগঘন পরিবেশে প্রাথমিক কুশল বিনিময়ের পর প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি খালেদা জিয়ার সামনে উপস্থাপন করা হয়।
দেখা করতে যাওয়া তিন নেতার মধ্যে দুইজন প্যারোলের পক্ষে নানা ধরনের যুক্তি তুলে ধরেন। তারা বোঝাতে চেষ্টা করেন- নিজের জন্য না হোক, দল ও দেশের জন্য হলেও খালেদা জিয়াকে বাঁচতে হবে। আর বাঁচতে হলে তার উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন। কিন্তু কারাবন্দি অবস্থায় তার উন্নত চিকিৎসা হবে না। এজন্য প্রয়োজন মুক্তি।
কিন্তু আইনি প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা যাচ্ছে না। আর রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার মতো সাংগঠনিক শক্তি বিএনপির নেই। সুতরাং এখন একটি পথই খোলা- নির্বাহী আদেশ বা প্যারোলে মুক্তি।
দলের শীর্ষ দুই নেতার এমন যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিক উত্তর কী দেবেন সেটিই ভাবছিলেন খালেদা জিয়া। কিন্তু সেখানে উপস্থিত থাকা তৃতীয়জন প্যারোলে মুক্তির বিপক্ষে তার মত তুলে ধরেন। তিনি বলার চেষ্টা করেন, প্যারোল মানেই খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো স্বীকার করে নিয়ে সরকারের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ। আপসহীন নেত্রী হিসেবে পরিচিত খালেদা জিয়ার জন্য প্যারোল মোটেই সম্মানজনক হবে না। শেষ পর্যন্ত খালেদা জিয়া ওই তিন নেতাকে জানিয়ে দেন প্যারোল নয়, তারা যেন আইনি প্রক্রিয়ায় বা জামিনের মাধ্যমে মুক্তির ব্যবস্থা করেন। প্যারোল তিনি নেবেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত খালেদা জিয়া তার ‘আপসহীন’ অবস্থানে আর থাকতে পারছেন না বলে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে মতামত জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, জীবিত খালেদা জিয়া আমাদের কাছে বেশি প্রয়োজন। সুতরাং স্বজনরা যদি খালেদা জিয়ার প্যারোলের ব্যাপারে আবেদন করেন এবং ম্যাডাম যদি সেটা মেনে নেন, তাহলে আমাদের কিছু বলার থাকবে না।
জিয়া অরফানেজ এবং চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দু’টি দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়া ১৭ বছরের সাজা নিয়ে জেল খাটার দুই বছর পুরো হয়েছে গত ৮ই ফেব্রুয়ারি। এর মাঝে প্রায় ১০ মাস ধরে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। কিছুদিন আগে সুপ্রিমকোর্ট থেকে তার জামিন আবেদন নাকচ হয়েছে। তার মুক্তি না পাওয়ার বিষয়কে আইনগত বলে সরকার বলে আসছে। কিন্তু বিভিন্ন সময় যখন বিদেশে চিকিৎসার কথা এসেছে, তখন খালেদা জিয়া নিজে তা চান কিনা-সেই প্রশ্নও উঠেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.