আর্ন্তজাতিক মার্তৃভাসা দিসব ও করণীয়

প্রতি বছরের ন্যায় এবারও পালিত বা উৎযাপিত হলো আর্ন্তজাতিক মার্তৃভাষা দিবস বা একুশে ফেব্রুয়ারী অথবা ভাষা দিবস। এ দিবসটিকে কেন্দ্র করে নানান বর্ণীল আয়োজনে সজ্জ্বিত হয় পুরো বাংলাদেশ এমনকি বিশ্বের বিভিন্নপ্রান্তে বসবাসরত বাঙ্গালীরাও মেতে উঠে এই দিবসটিকে নিয়ে। এই দিবসটি আসলেই আমরা মমতাই পূর্ণ হই, আবেগে তাড়িত হই এবং মমতা ও আবেগের সমন্বয়ে গেয়ে উঠি আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারী; আমি কি ভুলিতে পারি। হ্যা সত্যিই বলতে চাই আসলেই কি ভুলিতে পারি। আর একদিন বাদে ৩৬৪দিন কি এই ভাষার কথা কাজে, আচরণে এমনকি রাষ্ট্রিয় ও ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ব্যবহার করি? মধ্যবিত্ত এবং শিক্ষিত ও উচু অর্থবিত্তশালী মহলে এই বাংলা ভাষার গুরুত্ব ও মমত্ব কতটুকু বা এর গভীরতার শিকড়ই বা কোথায় প্রোথিত। যাই বলি না কেন আমরা শুধু ৮ই ফালগুন বা একুশে ফেব্রুয়ারীতে ভাষাকে সীমিত রাখতে বা স্মরণ করতে উৎসাহি।
মার্তৃভাষার অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে পৃথিবীর বহু জাতিই ইতিহাসে স্থান পেয়েছে তন্মর্ধ্যে আমাদের স্থান সমুজ্জ্বল এবং এই সমাজ্জ্বলতাকে সম্মান জানাতেই বিশ্ব ২১শে ফেব্রুয়ারীকে স্বীকৃতি দিয়েছে আন্তর্জাতিক মার্তৃভাষা দিবস হিসেবে। এতে করে ভাষার জন্য সংগ্রাম করে যাওয়া মানুষগুলো অধিকার পেয়েছে এবং সম্মানের স্থানে স্বৃকীতি লাভ করেছে। যা বিশ্ববাসি সকল ভাষাশহীদদের আত্মত্যাগ স্মরণ করে এই দিনটিকে তাদের স্মরণে উৎযাপন করবে এবং আগামীর দৃষ্টান্ত হিসেবে বহমান রাখবে। আমাদের প্রাণের ভাষা মায়ের ভাষা বাংলাকে ব্যবহারোপযোগী রাখতে ১৯৫২’র এই দিনে আমাদের তরুণেরা ঢাকার রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। আজ আমরা গভীর শ্রদ্ধার সাথে সেই মহান তরুণদের শ্রদ্ধাভরে ভালবাসায় স্মরণ করছি: ভাষাশহীদ সালাম, জব্বার, রফিক, বরকত ও শফিউরকে। তোমাদের এই ঋণ কোনদিন শোধ হবে না; সালাম সালাম হাজার সালাম; সালাম শহীদ স্মরণে, আমার হৃদয় গেয়ে যায় গান তোমাদের স্মৃতি স্মরণে। বরেণ্য এই বিখ্যাত কথা চয়নগুলো উচ্চারন করে সেই দিনের স্মৃতিরোমন্থন করে এগিয়ে যায় তাদের স্মৃতির প্রতি শদ্ধা জানাতে।
শৈশব থেকে জেনে ও শিখে এবং শুনে ও পালন করে আসছি এই দিনের আত্মত্যাগ আর স্বীকৃতি আমাদের প্রাণে সঞ্চারিত মায়ের ভাষা বাংলা ভাষা। ২১ শে ফেব্রুয়ারীতে রাত ১২.০০ আমরা একুশ তপধ্বণি বা ২১টি বাজি ফাটিয়ে উৎযাপন করতাম এবং সারারাত জেগে ফুলের মালা প্রস্তুত করতাম যেন সকালে প্রভাত ফেরী করতে পারি এমনকি শহীদ বেদিতে বা শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে পারি। এই যে আনন্দ এবং উদ্দি¦পনা ও উৎসাহ তা হৃদয়ের গভীরে থেকে উৎসরিত এবং দিনের অর্ন্যান্য কার্যক্রমগুলো ঐ ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগকে সমুন্নত রাখে। যেমন গান, কবিতা, নাটক ও আলোচনা সভার মাধ্যমে ১৯৫২কে ফুটিয়ে তোলা হতো নতুন প্রজন্মের কাছে। এইভাবেই ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগের অবদান জিইয়ে রেখেছে আমাদের মাঝে। তবে এখানে একটু না বললেই নয় যে, শহর এবং গ্রামে এর ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। যেমন প্রভাত ফেরী হবে প্রভাতে যা গ্রামে এবং বিভাগীয় শহরে আগে হতো কিন্তু এখন এর ভাটা পড়েছে বিশেষ করে শহুরের জীবনে। শহুরের স্কুল কলেজের শিক্ষকগণ এবং অভিভাবকগণ এই ঐতিহ্যে ছেদ গঠিয়ে এই প্রভাত ফেরীর অপমান করে যাচ্ছে বা লোক দেখানো অনুষ্ঠানে পরিণত করে যাচ্ছে যা ভাবার বিষয় এবং কঠোরভাবে রাষ্ট্রিয় আইন দ্বারা পালনে বাধ্য করানো উচিত। যেমন প্রভাত ফেরী হবে প্রভাতে কিন্তু শহরে হচ্ছে ৭টা থেকে ১০টা এর মধ্যে। প্রভাত ফেরী হবে হালি পায়ে কিন্তু শহরে হচ্ছে জুতা পায়ে এই নতুন অপসংস্কৃতির অবসায়নে সরকারের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করছি এবং শিক্ষামন্ত্রণালয়ের বিধি বা প্রোবিধি অথবা সার্কুলারের মাধ্যমে সম্মানের, ঐতিহ্যের, আবেগের, হৃদয়ের গহিণের সুপ্ত বাসনা এবং লালন ও ধারণ করার বিষয়গুলো স্ব স্ব মহিমায় একই আবরণে উৎযাপিত এবং পালিত হউক। এটাই জাতির এবং আত্মত্যাগকারীদের সুপ্ত বাসনার লুকানো ইচ্ছা হিসেবে সমুজ্জ্বল এবং উদ্বাসিত থাকুক।
গত পাঁচ বছর যাবত এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা, লিখা এবং বিভিন্ন ফোরামে বক্তব্য উপস্থাপন অনেক-ই করেছি কিন্তু এর উত্তোরণের কোন দৃশ্যমানতা না দেখে খোদ প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে শৃঙ্খলায়নের এমনকি নিয়মের ঐক্য সাধনের আশা পোষণ করছি। একুশে ফেব্রুয়ারী পালিত হউক একই নিয়মে শহর, গ্রাম ও বন্দরে এবং দেশের বাইরে। তাই হবে আমাদের সুশৃঙ্খল ও সমুজ্জ্বল এক কৃষ্টি কালচারের বহি:প্রকাশ। বাংলাদেশে অবস্থানরত সকল বিদেশী এবং ইংরেজী মাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও একযোগে পালিত হউক আমাদের গর্বের এই একুশে ফেব্রুয়ারী তার বিধান আশু বাস্তবায়ীত হউক শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা বোর্ডগুলোর কঠিন ও কঠোর আইনি প্রক্রিয়ার বাস্তবায়নের মাধ্যমে। বাংলাকে ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ বোধ করতে বাধ্যবাধকতার আবশ্যকতা এখন জরুরী। বাংলা যেন স্ব মহিমায় উদ্ভাসিত হয় সেই চেষ্টা প্রতিটি বাঙ্গালীকে ধারণ ও লালন করতে হবে এবং এই ব্যবস্থায় অগ্রসর হতে রাষ্ট্রকেই আইনি কাঠামোয় পরিবর্তন এসে তা বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকতে হবে। চিন, জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ান, ফ্রান্স, জার্মানী, ইতালি, সুইজারল্যান্ড সহ অনেক দেশেই তাদের মার্তৃভাষাকে প্রাধান্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে নিজস্ব সংস্কৃতির বলয়ে। আর আমরা গ্যা ভাসিয়ে দিচ্ছি অন্যের শেখানো ভুলিতে; যা আমাদের গর্ব, ঐতিহ্য এবং সম্মানের জায়গাকে ছোট করে। তাই এখনই ভাষার বিষয়ে নুতন করে ভাবার সময় এসেছে। আসুন আমরা আমাদের ঐতিহ্যকে ধারণ ও লালন করি এবং গর্বের জায়গাকে সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছে দিতে চেষ্টা করি। সেদিনের আত্মত্যাগ কিন্তু আজকের এই বাংলা বিচ্যুতির জন্য নয়, বাংলিশ হওয়ার জন্য নয় বরং শুদ্ধ বাংলা নিয়ে মাথা উঁচু করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য।
বঙ্গবন্ধুর বাংলায় ভাষণ প্রদান যা জাতিসংঘ এবং বহিবিশ্বে বাংলাকে সম্মানে এগিয়ে দিয়েছিল, এখনও আমাদের সরকার, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ সময় ও সুযোগে বাংলাকে এগিয়ে নিবে বঙ্গবন্ধুর দেখানো ও শেখানো পথে। আইন, আদালত, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসায় এমনকি অফিস ও পরিবারে বাংলার শুদ্ধ ব্যবহার প্রচলিত থাকুক। কোনভাবে বাংলাকে বাদ দিয়ে অন্য ভাষায় প্রাধান্য; আশক্তি কাম্য নয়। জ্ঞানের প্রয়োজনে অন্যভাষা চর্চা বা শিক্ষা ব্যক্তিগত কিন্তু বাংলাকে বিসর্জন দিয়ে নয়। বাঙ্গালী তার প্রধান পরিচায়ক হউক বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও কালচার। এই তিনের সমন্বয়েই পুর্ণ বাঙ্গালী হয়ে জিবন যাপন করবো আগামীর তরে। ভাষা বিষয়ে এখনও যেসকল অসঙ্গতি রয়েছে সেগুলিকে চিহ্নিত করে অগ্রসর হতে হবে। বাংলাদেশের অর্ভ্যন্তরে যে সকল ভাষাগুলো এখনো রয়েছে এবং যেগুলো বিলীন হয়েছে বা বিলীন হওয়ার পথে সেগুলোকে পুনরুদ্ধার করে আমাদোর সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করতে হবে। তাই রাষ্ট্রকেই উদ্যোগ নিয়ে এর যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। ভাষার বিচ্যুতি এবং বিভ্রাট বন্ধ করার জন্য সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। প্রধান মন্ত্রীর আন্তরিক ইচ্ছা ও অভিপ্রায়কে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর মৌখিক কথাই আমাদের জন্য আদেশ তাই সকলেই প্রধানমন্ত্রীর আদেশকে বাস্তবায়ন করার জন্য সচেষ্ট থাকতে হবে। বাংলায় আমাদের সকলকিছু হউক এবং বাংলাকে প্রাধান্য দিয়েই আমাদের অগ্রসরমান উন্নতি এগিয়ে যাক। নতুন স্বীকৃতি স্থায়ী হউক বাংলার উপর দাঁড়িয়েই। এই হউক আমাদের এবারের একুশের প্রতিপাদ্য।
ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা এবং আগামীর পথে তাদের স্মৃতিকে এমনকি অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্তির জন্য বাংলা ও বাঙ্গালীর ঐক্যান্তিক প্রচেষ্টা থাকবে সমুন্নত ও সমুজ্জ্বল। অমর একুশে ফেব্রুয়ারী আমাদের দৈনন্দিন জীবনে উতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকুক এবং যেভাবে বাংলাদেশ জন্মনিয়েছিল সেই চেতনায় ভাষাকে ধারণ ও লালন করে এগিয়ে যাওয়া হউক আমাকের আগামীর আশার বাতি। জয় হউক বাংলার।

Leave a Reply

Your email address will not be published.