মা হলেন সর্বেসর্বা, যাকে ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ নই, বরং শূন্য’

প্রশান্তি ডেক্স॥ সবার মা কেমন জানিনা। তবে আমার মা, মানুষ হিসেবে মোটেও সুবিধের নন। হ্যা,সত্যিই। মিথ্যেবাদি আর ছলনাময়ী আমার মা! অত্যাচারী ও বটে। সেই ছোটবেলা থেকেই দেখতাম, প্রতিদিনই কোন না কোন মিথ্যাচার কিংবা ছলনার আশ্রয় নিয়েই চলেছে। বাড়ির সবার খাওয়া শেষ হওয়ার অনেক,অনেকক্ষণ পর যখন মাকে জিজ্ঞেস করতাম খেয়েছে কিনা, সে বলত, “ক্ষুধা সহ্য করতে পারিনা আমি, তোদের আগেই, রান্না করার সময়টাতে খেয়ে নিয়েছি!” আবার কোন কোন দিন বলত, “বিকেলে যখন তোরা স্কুলে ছিলি, তখন নাশতা করেছি আচ্ছা মত, গ্যাসে এখন ফুলে আছে পেট”! মায়ের মিথ্যাচার আর ছলনা কখনই ধরা পরতোনা, যদিনা সেদিন ডাক্তার কাকা এসে বলতেন, দিনের পর দিন অযতœ আর অবহেলায় মায়ের শরীরে বাসা বেঁধেছে হরেক রকমের অসুখ।মা আমার অত্যাচারী, এ কথাটি ও মিথ্যে নয়। ঠুসে ঠুসে একগাদা খাওয়ানোর পরে ও বলতেন, “আরেকটু খা, মুখটা কেমন শুকনো দেখাচ্ছে”। কিন্তু আমার চোখে “মা” হলেন সর্বেসর্বা, আমার সেই স্বত্তা, যাকে ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ নই, বরং শূন্য। উপরের কথাগুলো বলছিলেন অজ্ঞাতনামা এক নারী। -বাহ্! বেশ ভালো বললেন তো। কি করেন আপনার মা? -বেঁচে থাকলে হয়তো অনেক কিছুই করতেন, এখন একটাই কাজ-স্বর্গে বসে আমাদের তিন ভাই বোনের জন্য দু’য়া করা। হ্যা, মা আর বেঁচে নেই, মাত্র ৩৭ বছর বয়সে ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন। তিনি নেই সত্যি, কিন্তু আমরা তাঁকে সবসময় দেখতে পাই তাঁর কাজ আর পরিপাটি সাজানো সংসারো মারা যাওয়ার আগে তিনি ছোট ছেলের বিয়ের গয়না টাও গুছিয়ে গিয়েছেন।-আপনিতো কাঁদিয়ে দিলেন আপা। আপনার পেশা?
-আমি? শখ ছিল ইঞ্জিনিয়ার হব। কিন্তু ঢাকা ছেড়ে খুলনা প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আর পড়তে যাওয়া হলনা আমার। আমি যে ১৩ বছর বয়স থেকেই ছোট ভাইটির মা! সংসারের বিশাল দায়িত্ব ছিল আমার ঘাড়ে। তাই পড়াশোনার পাঠ ঢাকাতেই চুকিয়েছি। অর্থনীতিতে পোস্ট গ্রাজুয়েশন শেষ করে চাকরি নেই নামকরা ব্যাংকে। ভালোই চলছিল হ্যান্ডসাম বেতনের চাকরি আর অল্পসময়ের প্রসারে। এখন চাকরি ছেড়ে পাড়ি জমাচ্ছি অনিশ্চিত জীবনে, দুই বাচ্চার ভবিষ্যৎ গড়তে। পেশা আপাতত ছাত্র, স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে মাস্টার্সে এডমিশান নিয়েছি। চলার পথে আত্মবিশ্বাসী এই নারী স্বপ্নপূরণে বার বার বাধাগ্রস্থ হলেও তিনি যখন কথা বলছিলেন, একটি বারের জন্য ও হতাশ মনে হয়নি তাঁকে। বরং কখনো কখনো চেহারা জ্বলজ্বল করছিল-যখন বলছিলেন তার অনন্যা মায়ের কথা, বলছিলেন তাঁর সংসারের, কর্তব্যের কথা, বলছিলেন ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতের কথা। অন্যের মুখে মায়ের গল্প শুনতে গিয়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারলামনা। পৃথিবীর সব মায়েরাই বুঝি এমন হন। নিজের মা কে দেখেছি স্বামী আর ৬ সন্তান নিয়ে সকাল থেকে রাত অব্দি অক্লান্ত পরিশ্রম করতে। এক বেলার খাবার খাওয়ানো শেষ হতে না হতে পরের বেলার খাবার জোগান দেয়ার টেনশান! তার উপর বাচ্চাদের স্কুল, টিউশান, আরো কত কি! যৌবনের সময় থেকেই বাবা ছিলেন ভীষন অলস, এক গ্লাস পানি ও ঢেলে খেতে পারতেন না! তাঁর একটি মাত্র কাজ ছিল টাকা রোজগার করা। এ জন্য অবশ্য সংসারের খুটিনাটি বিষয়ে তাঁর কোন অভিযোগ ছিলনা, মা যেমনটি চালাতেন তেমনি চলতেন। অন্যথায় মায়ের কষ্ট দিগুন হতে পারত। বড় ভাবীকে সংসারের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে আম্মা পুরোপুরি অবসরে চলে যান ভাবীর বিয়ের বছর তিনেকের মাথায়।সেই থেকে শুরু।সপ্তাহের সাতদিন একই রুটিন। উইকেন্ড বলে কিছু নেই তার জীবনে। আমরা যখন ছুটির দিনে বেলা করে ঘুম থেকে উঠি তখনো তার দিন শুরু হয় সূর্য্যিমামার আগে। আর দিন শেষ হয় রাতে সিটিকর্পোরেশানের ঝাড়ুদার রাস্তা ঝাড়ু দেয়ার ও ঘন্টা খানেক পরে। বাড়ির সবাই যখন নাকে ডেকে ঘুমাচ্ছে তখন তার সংগী থাকে কেবল ঐ ল্যাম্পপোস্টের আলো আর আকাশের ঝিকিমিকি তারাগুলো, আর কপাল ভালো হলে জোছনার রূপবতী চাঁদটা।বাচ্চাদের নার্সিং আর পড়াশোনার দেখভাল, পুরো পরিবারের ক্যাটারিং আর সকল প্রকার ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, কর্তা ও তার পরিবারের তদারকি, সমস্ত কিছু সুনিপুণ হাতে সম্পন্ন করার পর নিজের জন্য আলাদা কোন সময় থাকেনা তার। আর হ্যা, এত এত স্কিল্ড ওয়ার্ক কিন্তু সে করে একদম বিনামূল্যে! আর পেশা কি জিজ্ঞেস করলে অমলিন হাসি দিয়ে বলে, “কিছু করিনা”! জ্বী, ঠিক ধরেছেন পেশায় সে গৃহিণী, ভদ্র সমাজ যার নাম দিয়েছে হোম মেইকার। কেউ কেউ আবার হোম ম্যানেজার ও বলে থাকেন।
আমি মধ্যপদধারী ব্যাংকার। মায়ের মত গ্রামের পথে ঘাটে দূরন্তপনা করে শৈশব কাটেনি-কৈশোর কাটেনি মা খালাদের কাছে ঘরকন্না শিখে। আমার শৈশব, কৈশর, যৌবন সবকিছুই কেড়ে নিয়েছে বড় বড় পাঠ্যপন্তুক আর গাল্ ভরা ডিগ্রি। তবে অস্বীকার করবনা, বাবা মায়ের পঞ্চম সন্তান হলেও আমি ছিলাম আদরের দুলালী।ছোটবেলাতেই বড় দুই বোনের বিয়ে হয়ে যায়। আমি তাই বড় হয়েছিলাম বড় দুই ভাইয়ের কোলে পিঠে। পাড়ার লোকজন চিনতো টমবয় হিসেবে। বলার অপেক্ষা রাখেনা, ছুটির বিকেলে পাড়াময় ক্রিকেট, ফুটবল আর ডাংগুলি খেলে বেড়ানো এই আমাকেও একদিন সংসার পাততে হয়। ছোট্ট ছিমছাম গোছানো সংসার আমার। সকালে ঘুম ভাঙতেই ছুটি ওয়াশ রুম এ নয়, পাকের ঘরে। সন্ধ্যায় ও একই কাহিনি, ঘরে ঢুকেই কাপড় ছাড়া নয়, চা বসাতে হয় প্রথমে। তারপর ডিনার আর পরের দিনের লাঞ্চ রেডি করার ফাঁকে গোসলটা ও সেরে ফেলি। আমার পতি দেবতাটি অবশ্য এর মধ্যে বসে থাকেন না। আসবাব এর সাফাই, ঘর গোছানো, ফিল্টার রিফিল ইত্যাদি কাজ যে নিয়মিত তিনিই করে থাকেন। আর হ্যা, মায়ের মত বড় মাছ নিমিশেই টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারিনা বলে তার কোন আক্ষেপও নেই, কারণ এ যুগের ছেলেরা কেবল ঘরকন্না জানা বিবি চায় না-শিক্ষিত, স্মার্ট, প্রেসেন্টেবাল পার্টনার চায়। এইসব গুন অর্জন করতে গিয়ে তাই স্বাভাবিকভাবেই ঘরকন্নার কিছু বিষয় ট্রেইড অফ করতে হয়। অতীতের নারী আদর্শ, নাকি এ যুগের নারী, এ প্রসঙ্গ টানা তাই অবান্তর। যুগে যুগে নারী অদম্য, সংসারের প্রাণ।সময়ের সাথে কর্মপরিধি বদলেছে কেবল। তুলনায় তাই তাদের অপমান। আর সময়ের সাথে সাথে যে পরুষ বুঝতে শিখে গিয়েছেন, নারী পরুষে তুলনা চলেনা, এরা দুই গোত্র দুই মেরুতে অবস্থান কারী সংসারের দুই খুঁটি- সেই পুরুষ নিশ্চয়ই বুঝেন নারী জাতি মায়ের জাতি। আর মা জাতির সম্মানে যদি আলাদা একটি দিবস পালিত হয় সেটা নিয়ে তারা বিদ্রুপ করবেননা! এতটুকুন আশা তো করাই যায়। নারী দিবস পালন করে নারীকে সম্মানিত করা হল নাকি অসম্মান ই বাড়ল, সেই তর্কে না গিয়ে বরং উৎসব প্রিয় বাঙালীর জন্য এটাকে একটি বিশেষ দিন হিসেবে ধরে নেয়া কি খুব বেশি ক্ষতির কারণ হবে? কিংবা সংসারের শত কাজের মাঝে নিজের জন্য কিছুটা মুহূর্ত আলাদা করে নেয়ার সময়টুকুও না পাওয়া নারীর উদযাপনের জন্য একটি দিন বরাদ্দ করা-এটাকেও কি খুব বড় বিতর্কের বিষয় না বানালেই নয়! কি এমন ক্ষতি হবে একটা দিন মনে করে মাকে নিয়ে ঘুরতে বের হলে অথবা সংসার আগলে রাখা আপনার সন্তানের মায়ের জন্য একটা দিন একটু সময় বের করে নিলে? নিদেন পক্ষে অফিস ফেরার সময় একগুচ্ছ ফুল নিয়ে এসে দেখুন, নতুবা, অযতেœ অবহেলায় গড়ানো সেই খোপাটায় সযতনে একটি বেলি ফুলের মালা পড়িয়ে দিয়ে দেখুননা। ঠিকঠাক পলিশের অভাবে পুড়ে যাওয়া সেই মুখের নির্মল হাসিটা কিন্তু ঠিকই ঝকমক করে রাঙিয়ে দিবে আপনার মন। আর নারীদের বলছি, সংগীর আশায় বসে না থেকে আমরা নিজেরাই কিন্তু দিবসটি সুন্দর ভাবে উদযাপন করতে পারি। হতে পারে নিজেকে পরিপাটি করে সাজিয়ে, নিজের শরীর কিংবা মনের যতœ নিয়ে, নিজের জন্য বিশেষ কিছু কেনাকাটা করে, পছন্দের রান্না করে, নিজেকে একদিনের ছুটি দিয়ে কিংবা যে অন্য যে কোন উপায়ে।তবে কথা একটাই, পরিবারের প্রয়োজনেই ভালো থাকতে হবে আপনাকে। কারণ, যে নিজে সুখী নয়, সে কখনই অপরকে সুখী করতে পারেনা। সবশেষে নারী দিবস স্মরণে পৃথিবীর সকল আপোষহীন নারীকে জানাই প্রাণঢালা শুভেচ্ছা যারা স্ব স্ব কর্তব্য-ক্ষেত্রে এক একজন বীর যোদ্ধা। আর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া, প্রগতি আন্দোলনের প্রথিতযশা কবি সুফিয়া কামাল, বিপ্লবী- প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদার সহ সকল অগ্রদূতদের যাদের পথ অনুসরণ করে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন স্বপ্নপূরণের পথে। বিঃদ্রঃ এ যুগে পুরুষদের জন্য ও কিন্তু একটি দিবস রয়েছে। গত ১৯ই নভেম্বরে আমি ব্যক্তিগতভাবে সেই দিনটি পালন করেছিলাম মহাসমারহে। কারণ আজ আমার এই অবস্থানে আসার পেছনে যেমন রয়েছে মমতাময়ী কিছু নারীর অবদান তেমনি রয়েছে কিছু বলিষ্ঠ হাতের শ্রম আর চওড়া কাঁধের ছায়া।
লেখক: সৈয়দা আঞ্জমান আরা শারমিন, সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার, এবি ব্যাংক লিমিটেড, আগ্রাবাদ, চট্টগ্রাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published.