মেট্রোরেল আগামী বছর চালু নিয়ে সংশয়

প্রশান্তি ডেক্স ॥  দেশের প্রথম উড়াল মেট্রোরেল এমআরটি-৬ চালু হওয়ার কথা আগামী বছর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে। কিন্তু এটি নির্ধারিত সময়ে পূর্ণাঙ্গরূপে চালু করা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। কারণ ইতোমধ্যে বেড়েছে রুটের দৈর্ঘ্য ও স্টেশন সংখ্যা। এর সঙ্গে বাড়ছে নির্মাণ খরচও।

ঢাকা মহানগরী ও পার্শ্ববর্তী এলাকার যানজট নিরসনে অত্যাধুনিক গণপরিবহন মেট্রোরেল চালু হচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ৬টি মেট্রোরেল থাকবে ঢাকা শহর ঘিরে। এর মধ্যে রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল লাইনটির নাম এমআরটি লাইন-৬। এটি এখন কমলাপুর পর্যন্ত ধরা হয়েছে। আর এমআরটি লাইন-৫ হচ্ছে হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা পর্যন্ত। এটিও সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ থেকে জলসিঁড়ি আবাসন প্রকল্প পর্যন্ত বর্ধিত হচ্ছে। এমআরটি-৫ (নর্দার্ন) নির্মাণেও খরচ বাড়বে। অ্যালাইনমেন্ট এলাকার কর্তৃপক্ষের সমঝোতা স্মারক সই ছাড়া রুট নির্ধারণে তৈরি হয়েছে জটিলতা। তাদের পক্ষ থেকে এখন রুট বাড়ানোর শর্ত আসায় বেড়ে যাচ্ছে নির্মাণ খরচও।

২০২১ সালের ডিসেম্বরে প্রথম মেট্রোরেল এমআরটি-৬ উদ্বোধনের সিদ্ধান্ত ছিল। এরও আগে ফার্মগেট পর্যন্ত অংশ চালুর কথা ছিল। পরে একসঙ্গে উত্তরা থেকে মতিঝিল সম্পূর্ণ অংশ চালুর ঘোষণা দিয়েছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী। এখন মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১.১৬ কিলোমিটার বর্ধিত করা হবে। এ জন্য ১৬ স্টেশনের পরিবর্তে ১৭টি স্টেশন করা হবে। মেট্রোরেল চালুর জন্য এখনো ভাড়া নির্ধারিত করা যায়নি। তবে ভাড়া দিয়ে লাভজনক করা যাবে না, এমন বিবেচনায় ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট হাব ও স্টেশন প্লাজা গড়ে তোলা হবে।

এদিকে মেট্রোরেল নির্মাণের অগ্রগতি নিয়ে একেক জায়গায় একেক তথ্য দিয়েছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। সরকারের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) কাছে বলা হয়েছে, করোনা ভাইরাস সংক্রমণ সত্ত্বেও মেট্রোরেলের কাজ কোনো দিনই বন্ধ রাখা হয়নি। কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের প্রথম থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ অব্যাহত রাখা হয়। বর্তমানে পুরোদমে নির্মাণকাজ এগিয়ে চলছে। আর ফাস্ট ট্র্যাক কমিটিতে পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনার কারণে মেট্রোরেল প্রকল্পের বিভিন্ন প্যাকেজে নিয়োজিত ঠিকাদার ও পরামর্শকদের একটি অংশ নিজ দেশে ফিরে গিয়েছিলেন। পরে তারা পুরোপুরি না ফেরায় নির্মাণকাজ প্রত্যাশিত মাত্রায় বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

মেট্রোরেল প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৫২ দশমিক ২৪ শতাংশ। এর নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। তবে বাস্তবায়ন বিলম্বে প্রকল্পটির ব্যয় বেড়ে যাবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। মেট্রোরেল নির্মাণ করা হচ্ছে ঢাকা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের অধীনে। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সাবেক সচিব এমএএন ছিদ্দিক আমাদের সময়কে বলেন, প্রকল্পের ডিপিপিতে ধরা সময়ের আগেই প্রথম মেট্রোরেল চালু হবে। বর্ধিত অংশের ডিজাইন করা কঠিন হবে না। আগের লাইন ধরেই কাজ চলবে। আশা করি সাশ্রয়ীভাবেই শেষ করা যাবে ওই অংশের কাজ।

মেট্রোরেলের অবকাঠামোর ওপর বসানো হয়েছে রেললাইন। মিরপুর ১২ নম্বর থেকে সম্প্রতি তোলা।

জানা গেছে, এমআরটি লাইন ৬-এর রুট অ্যালাইনমেন্ট মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত করতে সোশ্যাল সার্ভে শেষ হবে আগামী মাসে। এই মেট্রোরেলের দৈর্ঘ্য ২০.১০ কিলোমিটার থেকে বেড়ে ২১.২৬ কিলোমিটারে দাঁড়াবে। এর সংশোধিত অ্যালাইনমেন্ট হচ্ছে- উত্তরা তৃতীয় পর্ব-পল্লবী-রোকেয়া সরণির পশ্চিম পাশ দিয়ে খামারবাড়ি হয়ে ফার্মগেট-হোটেল সোনারগাঁও-শাহবাগ-টিএসসি-দোয়েল চত্বর- তোপখানা রোড-বাংলাদেশ ব্যাংক-জসিম উদ্দিন রোডের প্রথম অংশ হয়ে দক্ষিণ দিক দিয়ে সার্কুলার রোডসংলগ্ন কমলাপুর রেলস্টেশনসংলগ্ন এলাকা। নতুন স্টেশন কমলাপুর পর্যন্ত বর্ধিত করতে অতিরিক্ত সময়ের প্রয়োজন। সোশ্যাল সার্ভে শেষ হওয়ার পর একই সঙ্গে ভূমি অধিগ্রহণ ও ডিজাইনের কাজ শুরু হবে। এ মেট্রোরেল নির্মাণে চার দেশের পাঁচটি কোম্পানির কনসোর্টিয়াম এনকেডিএম অ্যাসোসিয়েশন পরামর্শক হিসেবে কাজ করছে। নতুন প্যাকেজ অন্তর্ভুক্ত হওয়া, কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেল বর্ধিত করা ইত্যাদি কারণে পরামর্শকের কাজের পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে পরামর্শক নিয়োগ ব্যয় প্রায় ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনুমোদনের জন্য প্রস্তাবটি পাঠানো হয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে।

প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, পরামর্শকের চুক্তির মেয়াদ ২০২৪ সালের ৩০ জুন। চুক্তিমূল্য ছিল এক হাজার ৬৩ কোটি ৭১ লাখ টাকা। এর মধ্যে প্রকল্পের একটি প্যাকেজ (সিপি) শেষ হয়েছে। বাকি সাতটি প্যাকেজ চলমান। নতুন আরেকটি প্যাকেজ এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট (ইআরএম) সিস্টেম সংযোজন হচ্ছে।

প্রস্তাবনায় আরও বলা হয়েছে, বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে- শুধু ভাড়া আদায়ের আয় থেকে লাভজনকভাবে মেট্রোরেল পরিচালনা করা যায় না। তাই মেট্রোরেলের জন্য সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা ২০৩০-এ অন্তর্ভুক্ত নেটওয়ার্ক আন্তঃলাইন সংযোগ স্টেশনসংলগ্ন এলাকায়, ডিপো এলাকায় ও প্রধান প্রধান স্টেশনগুলোর সংলগ্ন এলাকায় ক্রমান্বয়ে ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট হাব ও স্টেশন প্লাজা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এগুলোর ডিজাইনের জন্য পরামর্শকের কাজের পরিধি ও আনুষঙ্গিক ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে পরামর্শক ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে ২৬২ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। প্রস্তাবটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে।

তথ্যমতে, মেট্রোরেলের ভাড়া এখনো নির্ধারণ হয়নি। শুরুতে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত সর্বোচ্চ ভাড়া ৫৫ টাকা রাখার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তা ৮০-১০০ টাকা পর্যন্ত নির্ধারণের পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু এ বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় রয়েছে ভাড়া নির্ধারণ কমিটি।

এদিকে রাজধানীর পূর্ব-পশ্চিমে সংযোগ বাড়াতে হচ্ছে আরেকটি মেট্রোরেল। গত বছরের অক্টোবরে হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা পর্যন্ত এমআরটি লাইন-৫ (নর্দার্ন রুট) শীর্ষক প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। গত জুনে মেট্রোরেলটির বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন ও নির্মাণকাজ তদারকিতে পরামর্শক নিয়োগ করা হয়। এই মেট্রোরেলটি হেমায়েতপুর থেকে বলিয়ারপুর, মধুমতি, আমিনবাজার, গাবতলী, দারুস সালাম, মিরপুর-১, মিরপুর-১০, কচুক্ষেত, বনানী, গুলশান-২ ও নতুনবাজার হয়ে ভাটারা যাওয়ার কথা। ১৯ দশমিক ৬০ কিলোমিটারের মধ্যে ১৩ দশমিক ৬০ কিলোমিটার মাটির নিচে ও বাকি ছয় কিলোমিটার উড়ালপথে হওয়ার কথা। এখন এ রুটও বর্ধিত করা হবে। এ মেট্রোরেলটি যাবে ঢাকা সেনানিবাসের ভেতর দিয়ে। তাই সেনাসদরের অনাপত্তি দরকার। এ জন্য তারা কয়েকটি শর্ত দিয়েছে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) চার শর্তের একটি হচ্ছে- হেমায়েতপুর থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে জাতীয় স্মৃতিসৌধ এবং ভাটারা থেকে ৬ কিলোমিটার জলসিঁড়ি আবাসন পর্যন্ত রুটটি বর্ধিত করা।

প্রকল্পের কর্মকর্তারা বলেন, প্রকল্প অনুমোদনের আগেই বিষয়গুলো সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল। এখন সমস্যা হচ্ছে- মেট্রোরেলের দৈর্ঘ্য আরও ২২ কিলোমিটার বাড়লে এর খরচ বাড়বে। এ ক্ষেত্রে জাইকার মতামত নিতে হবে। দাতা সংস্থাটি রাজি না হলে বিকল্প অর্থায়নে তৈরি হতে পারে জটিলতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published.