জলজ ফুলের রানি

প্রশান্তি ডেক্স ॥ পদ্ম ফুলের সৌন্দর্যের মুগ্ধতা খুঁজে পাওয়া যায় পদ্য থেকে গদ্য। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি বিখ্যাত কবিতা ‘কেউ কথা রাখেনি’। অনেকেই হয়তো এক-দুবার সরবে অথবা নীরবে এই কবিতার পুরোটা, নয়তো পঙ্ক্তিবিশেষ উচ্চারণ করেছেন। সেই কবিতার একটি অংশ ‘মামা বাড়ির মাঝি নাদের আলী বলেছিল, বড় হও দাদাঠাকুর/ তোমাকে আমি তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাব/ সেখানে পদ্ম ফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর/ খেলা করে!’
এখন প্রাকৃতিক জলাভূমি কমে আসায় পদ্ম ফুলের মাথায় সাপ আর ভোমরার খেলা দেখা ভাগ্যের ব্যাপার। তবে জলের বুকে বিশাল সব সবুজ পাতা ভাসতে দেখা যায়, তার ফাঁকে ফাঁকে পদ্ম ফুলের মাথা দোলানোটাও চোখে পড়ে। পদ্ম (ঘবষঁসনড় হঁপরভবৎধ) প্রতিবেশী দেশ ভারতের জাতীয় ফুল। বিভিন্ন উৎসব-পার্বণে এর রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ব্যবহার। রয়েছে নানান নাম। ইংরেজিতে বলা হয় লোটাস। বাংলায় আছে কমল, উৎপল, পঙ্কজ, কুমুদ, কৈরব, কুবল, অম্বুজ, কুবলয়, শতদল, নলিন, শ্রীপর্ণ, পুষ্কর, তামরস, নলিনী, সরোজ, সরসিজ, সলিলজ, বিসকুসুম, বিসজ, অরবিন্দ, রাত্রিহাস, নীরজ, ইন্দিবর ও কুশেশয়ের মতো প্রতিশব্দ। ধরন অনুযায়ী এর ভিন্ন ভিন্ন বাংলা সম্বোধনও রয়েছে, যেমন শ্বেতপদ্ম বোঝাতে পন্ডরীক ও লাল পদ্ম বোঝাতে কোকোনদ।
গত ২৭ জুন যাওয়া হলো মৌলভীবাজারের হাইল হাওরে। তবে এই আষাঢ়ে হাওরে থইথই পানি থাকার কথা থাকলেও পর্যাপ্ত বৃষ্টির অভাবে তা নেই। ফলে পানির শূন্যতায় এখনো দিব্যি দেখা যাচ্ছে হাওরের মধ্যে থাকা বিলগুলো। এর মধ্যে বাইক্কা বিলও রয়েছে। বাইক্কা বিলে যেন বসেছে পদ্ম ফুলের হাট। বিলের বিশাল বুকজুড়ে ফুটে আছে হালকা গোলাপি-সাদার কোমল মিশ্রণে চোখজুড়ানো পদ্ম ফুল। দূর থেকে মনে হতে পারে, গোলাপি রঙের ঢেউ খেলছে। ঢেউয়ের ভেতর পদ্ম ফুলের কোনোটা পাপড়ি মেলে ফুটে আছে। হাওয়া ও রোদের কাছে মেলে ধরেছে মায়া লাগানো রূপসী শরীর। কোনোটা কলার মোচার মতো হয়ে আছে, এগুলো কুঁড়ি। হয়তো কোনো এক রাতে ফুটবে তারা। কোনোটার ফুলের পাপড়ি ঝরে গেছে। তাতে ফল ধরেছে পদ্ম ফল। স্থানীয়রা এই ফলকে বলেন ‘টনা’। এই টনার বীজ খেয়ে থাকেন অনেকেই। স্থানীয় হাটে ‘টনার বীজ’ বিক্রি হতেও দেখা যায়।
প্রায় দুই দশক ধরে প্রকৃতি ও পাখিপ্রেমী মানুষের কাছে রয়েছে এই বিলের ভিন্ন কদর। এটি মাছ ও পাখির অভয়াশ্রম। বর্ষাকালে বাইক্কা বিলের দেশীয় প্রজাতির মাছ ছড়িয়ে পড়ে হাইল হাওরে। বাইক্কা বিলের ওয়াচ টাওয়ারে দেখা হলো শিক্ষার্থী নিশাত জাহান চৌধুরী, তানজিদা ইসলাম, সুরাইয়া আক্তারসহ কয়েকজনের সঙ্গে। তাঁরা মেডিকেল কলেজ ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। বিলজুড়ে পদ্মের মেলা দেখে তাঁদের চোখেমুখে উপচে পড়ছে সরল বিস্ময়, ভালো লাগার উচ্ছ্বাস। বাইক্কা বিলের অভ্যর্থনা ভবনের কর্মী জামাত আলী বলেন, ‘এবার বৃষ্টি কম হয়েছে, তবে পদ্ম ফুল ফুটেছে।
পদ্ম কন্দজাতীয় মূলাবদ্ধ পত্র-ভাসমান একটি জলজ উদ্ভিদ। শরতের ফুল পদ্ম। কিন্তু মধ্যবর্ষাতেও তার সৌন্দর্য ফুটে ওঠে কখনো। এ সৌন্দর্য থাকে হেমন্ত পর্যন্ত। বর্ষাকালে হাওর, বিল-ঝিল, জলাভূমিতে পদ্ম ফুটতে দেখা যায়। পদ্ম ফুলের পাতা গোলাকৃতির ও বড়। কোনো কোনো পাতা পানিতে লেপ্টে থাকে, কোনোটা থাকে উঁচু হয়ে। ফুলের রং সাদা ও গোলাপির মিশ্রণ। ফুল সুগন্ধি। পদ্ম ফুলের মূল, কান্ড, ফুলের বৃন্ত ও বীজ খাওয়া যায়। পদ্ম ফুল ভেষজ গুণসম্পন্ন, ডাঁটা সবজি হিসেবে খাওয়া যায়। পদ্ম ফুল রাতে ফোটে। রোদ প্রখর হয়ে ওঠার আগপর্যন্ত প্রস্ফুটিত থাকে। পদ্ম ফুলের আদি নিবাস ভারতীয় উপমহাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published.