গওহার নঈম ॥ না আসা ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের ফেলে যাওয়া বৃষ্টিতে অনেক কৃষক আমনের ফলন ঘরে তুলতে পারেননি। তাই আগামী খোরাকির প্রয়োজনে কৃষকেরা একটু আগেভাগে বোরোর বীজতলা তৈরির কাজে হাত দিয়েছেন। পেটে পাথর বেঁধে দিনরাত গা-গতরে খেটে চেষ্টা করছেন ইরি–বোরো ধরার জন্য; ঘুরে দাঁড়ানোর আকাঙ্ক্ষায়। মাগুরা, ঝিনাইদহ আর যশোরের বিভিন্ন জায়গায় জাওয়াদ–পরবর্তী বা এলাকার বাস্তবতা বিবেচনা করে বেশির ভাগ কৃষক উফশী ব্রি-২৮, হাইব্রিড এ এসএল ৮ এইস জাতের ধান চাষের লক্ষ্যে বীজতলা তৈরি করেছেন। হাইব্রিড ধান চাষে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ফলন বৃদ্ধি হয়।
ঝড়–বৃষ্টির কারণে শেষ মুহূর্তে উঠতি ফসল আমনের ক্ষতি আমাদের খাদ্যনিরাপত্তাকে আরও নাজুক করে দিয়েছে। গত বোরো মৌসুম থেকেই আমরা ঘাটতির মধ্যে আছি। আঁচ–অনুমানভিত্তিক হিসাবের নানান গরমিল থাকলেও এটা এখন স্পষ্ট যে সর্বশেষ বোরো মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১০ লাখ টন কম উৎপাদন হয়েছিল। পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ২ কোটি ৮ লাখ ৮৫ হাজার টনের বিপরীতে ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে উৎপাদিত হয়েছে ১ কোটি ৯৮ লাখ টন মাত্র। ফলে দেশের চাহিদা মেটাতে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসেই ৮ লাখ ৬৫ হাজার টন চাল আমদানি করতে হয়েছে। ফলন কম হওয়ার চেয়ে দুশ্চিন্তার আরেকটি কারণ বোরোর আবাদ কমে যাওয়া। আগের মৌসুমের তুলনায় গত বছর আবাদ কমেছে প্রায় ১৪ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে।
কাজেই ফলন বৃদ্ধির একটা চাপ কৃষি কর্মকর্তারা অনুভব করছেন। কৃষকদের মধ্যে আছে আমনের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চাপ। এই দুই চাপের সমাধান দিতে কি এবার উফশী ব্রি-২৮, হাইব্রিড এ এসএল ৮ এইস জাতের কদর বেড়েছে? মাগুরা, ঝিনাইদহ, যশোর অঞ্চলে অনেক কৃষকের কাছে হাইব্রিড এ এসএল ৮ এইস একেবারে নতুন। কৃষি কর্মকর্তাদের মতে, এই জাতের ধানে আগের জাতের ধানের তুলনায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ফলন বেশি হয়। এটা ঠিক যে আমাদের খাদ্যের চাহিদা পূরণের জন্য হাইব্রিড ধানের আবাদ বাড়াতে হচ্ছে। সেই সঙ্গে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের নানান প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে অনেক কৃষকই জানেন না, হাইব্রিড জাতের ধানের বীজ থেকে উৎপাদিত ধান পুনরায় বীজ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। করলেও তাতে আগের মতো ফলন পাওয়া যাবে না। ক্রমেই বীজ কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে বীজ আর তাদের বেঁধে দেওয়া দরে কৃষককে কিনতে হবে ফসলের প্রাণ বীজ। অনেক বীজ কোম্পানি বীজ বিক্রির পর টিনের চশমা পরে কথা বলে। কৃষককে আর চেনে না। বীজের মান আর দামের প্রতি সরকারের নজরদারি সার্বক্ষণিক আর কৃষকস্বার্থের অনুকূল থাকতে হবে। অগ্রহায়ণের বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত নীলফামারীর কৃষকেরা আগাম পেঁয়াজ চাষে মন দিয়েছেন। গত বছরের চেয়ে এবার বেশি জমিতে পেঁয়াজ চাষ করেছেন জেলার কিশোরগঞ্জের স্থানীয় কৃষকেরা। আবহাওয়া আর বাজার থাকলে বিঘাপ্রতি ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা লাভ পাবেন, এমনটাই আশা পেঁয়াজ চাষিদের।
ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলায় পেঁয়াজের চারার ভালো ফলন হয়েছে। বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজের চারা বীজতলা থেকে তুলে জমিতে রোপণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন কৃষকেরা। এ উপজেলা পেঁয়াজের চাষে অন্যদের থেকে এগিয়ে আছে। উপজেলায় চাষযোগ্য ২৮ হাজার ৫০০ হেক্টর জমির মধ্যে চলতি মৌসুমে পেঁয়াজের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ হাজার ৮৯০ হেক্টর। সরেজমিনে দেখা গেছে, এখানে বারি-১–এর পাশাপাশি বেসরকারি বীজ কোম্পানির লাল তীর, লাল তীর কিংসহ বেশ কয়েকটি জাতের পেঁয়াজের চাষ বেশি হচ্ছে। অনেক কৃষক সুখসাগর জাতও চাষ করেছেন। শৈলকুপার কৃষকেরাও বীজের গুণগত মানের নিশ্চয়তা চান, চান বীজের দামের স্বচ্ছতা; দামটা যেন তাঁদের নাগালের মধ্যে থাকে।
জাওয়াদের আগে গত অক্টোবরে তিস্তা ব্যারাজ কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে বাঁধ খোলা পানিতে তিস্তা অববাহিকার গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার রোপা আমন, কাঁচামরিচ, চিনাবাদামসহ প্রায় ৩৪৫ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। নানান প্রক্রিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ১০ হাজার কৃষককে প্রণোদনার আওতায় আনে সরকার। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় কিষান-কিষানিরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। তাঁরা শীতকালীন সবজিসহ মিষ্টিকুমড়া, আগাম আলু ইত্যাদির চাষে নেমে গেছেন।
করোনাকালে ফুলচাষিরা বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলেন। একদিকে করোনা মহামারি, অন্যদিকে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ব্যবসা ও চাষ দুটোই লাটে উঠেছিল। চলতি মৌসুমে ভালো দাম পাচ্ছেন বলে জানান কৃষকেরা। তবে তাঁদের ভয়, অমিক্রনের কারণে আবার বিধিনিষেধের কবলে পড়লে কী হবে? তাঁদের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পটা যেন মাঝপথে আটকে না যায়।
ভয়ে ধুঁকছেন হাওরের এক ফসলনির্ভর কিষান–কিষানিরা। নানান প্রতিকূলতার মধ্যে তাঁরা বোরো আবাদের পস্তুতিতে নেমে পড়েছেন। এবার হাওর থেকে পানি নামতে বেশ দেরি হওয়ায় বীজতলা তৈরিতে বিলম্ব হয়। তারপরও তীব্র শীত উপেক্ষা করে পুরোদমে কাজ করছেন তাঁরা। কাকডাকা ভোর থেকে তাঁদের কাজ শুরু হয়। শ্রমিকসংকট, সময়মতো টেকসই বাঁধ না হওয়ার ঝুঁকি, পানি আটকে থাকা, স্থানীয় ভোটের ডামাডোল ইত্যাদির প্রতিকূলতার সঙ্গে এবার যুক্ত হয়েছে ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্যবৃদ্ধি। সব মিলিয়ে এবার উৎপাদনের খরচও বাড়বে। জমিতে সেচ দেওয়া, ধান কাটা-মাড়াইও ডিজেল এবং কেরোসিনের ওপর নির্ভরশীল। ধানের দাম না বাড়লে তাঁদের লোকসানে পড়তে হবে। ইতিমধ্যে লোকসানে পড়েছেন ঠাকুরগাঁওয়ের আগাম আলুচাষিরা। মৌসুমের শুরুতে কিছুটা দাম মিললেও ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে দাম কমে যায়। কোল্ড স্টোরেজে আলু আটকে রেখে যাঁরা একসময় আলুর দাম বাড়িয়েছিলেন, তাঁরাই এখন বাজারে পুরোনো আলুর সরবরাহ বাড়িয়ে দিয়ে নতুন আলুর সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছেন। ফলে হকের দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন আগাম জাতের আলুচাষিরা। ন্যায্যতার ভিত্তিতে সার–বীজ–তেলের দাম নির্ধারণ করার সঙ্গে সঙ্গে ফাটকাবাজদের হাত থেকে বাজার রক্ষা করতে না পারলে কৃষকদের ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা হালে পানি পাবে না।
ক্স গওহার নঈম ওয়ারা লেখক, গবেষক। nayeem5508@gmail.com