কোটি টাকার মেডিকেল সামগ্রী এখন ‘ডাম্পিংয়ে’

মফিজুল সাদিক ॥ মুন্সিগঞ্জ ডায়াবেটিস হাসপাতালের ফ্লোরে পড়ে নষ্ট হচ্ছে অ্যানালগ এক্স-রে মেশিন। একইভাবে পড়ে আছে বায়োকেমিস্ট্রি অ্যানালাইজারসহ আরও ৫৩৩টি মেডিকেল যন্ত্রপাতি। যেগুলো কিনতে সরকারের খরচ হয়েছে এক কোটি ৪৯ লাখ ২৫ হাজার টাকা। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রকল্পের সমাপ্তি বিষয়ক প্রতিবেদন (পিসিআর) থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
স্থানীয় সমাজসেবী, শিল্পপতি ও হিতৈষীদের সহায়তায় ১৯৯৮ সালে মুন্সিগঞ্জ ডায়াবেটিক সমিতি প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ সমিতি ডায়াবেটিস রোগীদের চিকিৎসা ও পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করে আসছিল। কিন্তু দেশের অন্য স্থানের মতো মুন্সিগঞ্জেও ডায়াবেটিস রোগী দিন দিন বাড়তে থাকায় তাদের প্রয়োজনীয় সেবা দেওয়া মুন্সিগঞ্জ ডায়াবেটিক সমিতির সীমিত সামর্থ্যে সম্ভব হচ্ছিল না। সেজন্য সরকারের আর্থিক সহায়তায় সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে ২৪ কোটি ৮৫ লাখ ১৮ হাজার টাকা ব্যয়ে ‘মুন্সিগঞ্জ ডায়াবেটিস হাসপাতাল স্থাপন’ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়, ডায়াবেটিস রোগের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি, ডায়াবেটিস রোগীদের নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন সম্পর্কে সঠিক পরামর্শ দেওয়া, দেশে ক্রমবর্ধমান ডায়াবেটিস রোগীদের স্বাভাবিক জীবনযাপন সম্পর্কে চিকিৎসা/ সামাজিক পরামর্শ/সেবা দেওয়াসহ পরিবারে রোগীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা, ডায়াবেটিস রোগীদের প্রয়োজনীয় উপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং দরিদ্র রোগীদের কমপক্ষে ৩০ শতাংশ বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া।
জানুয়ারি ২০১৫ থেকে জুন ২০১৭ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। এরপর জুন ২০১৯ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ করা হয়। তবে প্রকল্পের কাজ সমাপ্তির দুই বছর পেরিয়ে গেলেও সেখানে সেবা পাচ্ছেন না কেউ। সরকারের কোটি টাকা খরচে কেনা দামি যন্ত্রপাতি পড়ে আছে হাসপাতালের ফ্লোরে। আইএমইডির প্রতিবেদনে দেখা গেছে, প্রকল্পের আওতায় ৫৩৪টি মেডিকেল যন্ত্রপাতি কেনার পাশাপাশি আরও বিভিন্নখাতে খরচ হয়েছে। এর মধ্যে ভূমি অধিগ্রহণে তিন কোটি ২৯ লাখ ২৯ হাজার টাকা, নির্মাণকাজ বাবদ ১৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এছাড়া ১১ লাখ টাকা ব্যয়ে ৪৩২টি আসবাবপত্র, ২৫ লাখ টাকায় একটি জেনারেটর, ১৩ লাখ ৫৫ হাজার টাকায় অফিস যন্ত্রপাতি, ১৩ লাখ ৮৫ হাজার টাকায় পানি সংরক্ষণাগার নির্মাণ ও সোলার প্যানেল কেনা হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রকল্পের আওতায় ২২ কোটি ৫৮ লাখ ৬৮ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।
আইএমইডি পরিচালক মো. মোশারফ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, যন্ত্রপাতি কিনেও চালু করতে না পারার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। অনেক সময় হসপিটাল নির্মিত হয়, যন্ত্রপাতিও কেনা হয় অথচ নানা কারণে চালু হয় না। আমরা এসবের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়ে থাকি। পর্যবেক্ষণ রিপোর্ট লিখে মন্ত্রণালয় ও বিভাগে পাঠাই।
প্রকল্প বাস্তবায়নে অসঙ্গতি, অযতেœ যন্ত্রপাতি
আইএমইডি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এ প্রকল্পের আওতায় ৫১৮টি মেডিকেল যন্ত্রপাতি বাবদ এক কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল। পরে প্রকল্পের আন্তঃখাত সমন্বয় করে ৫৩৪টি যন্ত্রপাতি কেনা হয়। আইএমইডির প্রতিনিধিদের সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, কেনা এসব যন্ত্রপাতির অধিকাংশই ভবনের বিভিন্ন কক্ষে ডাম্পিং করে রাখা হয়েছে। দীর্ঘদিন এসব যন্ত্রপাতি অব্যবহৃত থাকায় নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে আল্ট্রাসাউন্ড মেশিন, অটোম্যাটেড বায়োকেমিস্ট্রি অ্যানালাইজার, ৫০০ এমএ এক্স-রে মেশিন, অটোক্লেভ/স্টিম স্টেরিলাইজারের মতো যন্ত্রপাতিও রয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ৪৩২টি মেডিকেল আসবাবপত্র কেনা হয়েছে। অযতেœ পড়ে আছে এসব আসবাবপত্রও। আইএমইডির প্রতিবেদনে প্রকল্প বাস্তবায়নে নানা অসঙ্গতির কথা বলা হয়েছে। প্রকল্পের সমাপ্তি প্রতিবেদনে (পিসিআর) বলা হয়েছে, ভবনটির নিচ থেকে চতুর্থ তলা পর্যন্ত ভবনের উত্তর পাশের টয়লেটগুলোর পশ্চিম পাশে ডার্ক গ্লাস স্থাপনের পরিবর্তে স্বচ্ছ গ্লাস স্থাপন করা হয়েছে। লন্ড্রি রুমে মেশিনের জন্য পানির পয়েন্ট ও ওয়াটার ডিসপোজালের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। সাব-স্টেশন ভবনের ছাদে ওঠার জন্য সিঁড়ির ব্যবস্থা রাখা হয়নি। লিফট মেশিন রুমে প্রবেশের জন্য স্থায়ী সিঁড়ি এবং লিফটম্যানের জন্য রুম নির্মাণ করা হয়নি। লিফটের ভেতর ওয়ালফ্যান লাগানো হয়নি। অথচ লিফট স্থাপন বাবদ ব্যয় করা হয়েছে ৭৭ লাখ ৬৫ হাজার টাকা।
ভবনের ছাদে নির্মিত আরসিসি ওয়াটার ট্যাংকের চারদিকে ওয়ালের অধিকাংশ স্থানে নোনা ধরতে দেখা গেছে। অনুমোদিত নকশা অনুসরণ না করে চিলেকোঠার পিলার ব্যবহার করে আরসিসি ওয়াটার ট্যাংকটির একাংশ নির্মাণ করা হয়েছে। ভবনটির ছাদে আরসিসি ওয়াটার ট্যাংক যথা স্থানে নির্মাণ করা হয়নি।
প্রকল্পে আইএমইডির সুপারিশ
প্রকল্পের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের কিছু সুপারিশ দিয়েছে আইএমইডি। সেখানে বলা হয়েছে, নির্মিত হাসপাতাল ভবনের নিচতলা থেকে চতুর্থ তলা পর্যন্ত ভবনের উত্তর পাশের টয়লেটগুলোর পশ্চিম পাশে স্বচ্ছ গ্লাস পরিবর্তন করে ডার্ক গ্লাস স্থাপন, লন্ড্রি রুমে মেশিনের জন্য পানির পয়েন্ট ও ওয়াটার ডিসপোজাল স্থাপন করতে হবে। সাব-স্টেশন ভবনের ছাদে ওঠার জন্য সিঁড়ির ব্যবস্থা করা, লিফটম্যানের জন্য রুম নির্মাণ, আরসিসি ওয়াটার ট্যাংক পুনরায় রং করা এবং লাইট সরবরাহ ও স্থাপন নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া অনুমোদিত নকশা অনুসরণ না করে চিলেকোঠার পিলার ব্যবহার করে আরসিসি ওয়াটার ট্যাংকটির একাংশ নির্মাণের ব্যাখ্যা দিতে হবে প্রকল্প পরিচালককে। প্রকল্পের কাঙ্ক্ষিত সুফল প্রাপ্তির জন্য অব্যবহৃত মেডিকেল যন্ত্রপাতির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার তাগিদ দেওয়া হয় আইএমইডির তরফ থেকে। মেডিকেল যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়া প্রসঙ্গে মুন্সিগঞ্জ জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. মাইনুদ্দিন সরকার জাগো নিউজকে বলেন, যন্ত্রপাতি কেনার একটা সময়সীমা ছিল। এ কারণে আগেই যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। যন্ত্রপাতি না কিনলে টাকা খোয়া যেত। তবে কোনো যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়নি বরং ভালো মতো সংরক্ষণ করা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published.