‘সব সুবিধা আমলারা পান, শিক্ষার উন্নয়ন ঘটবে কীভাবে?’

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ॥ সৈয়দ মনজরুল ইসলাম। বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, সমালোচক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের পর কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন। এখন অধ্যাপনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে।
পাবলিক পরীক্ষায় পাসের হার এবং শিক্ষার মান নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
আমরা শিক্ষা নিয়ে কোনো চিন্তা করি না। আমরা ব্যবসা নিয়ে চিন্তা করেই অস্থির। আমরা সব প্রণোদনা ব্যবসার জন্য রেখে দেই। সব সুবিধা আমলারা পান, শিক্ষার উন্নয়ন ঘটবে কীভাবে? তাদের বেতন সবার চেয়ে বেশি। আমলা মাত্রই দামি গাড়ি, দামি বাড়ি। তাহলে শিক্ষার মান নিয়ে ভাববেন কেন?
সায়েম সাবু: করোনা পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে শিক্ষাব্যবস্থায়। দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এর মধ্যেই পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা হচ্ছে। অটোপাস এবং সীমিত পরিসরে পরীক্ষায় ব্যাপক হারে পাস করছে শিক্ষার্থীরা। এই ফলাফলে আপনার প্রতিক্রিয়া জানতে চাই।
সৈয়দ মনজরুল ইসলাম: করোনা মহামারির ছোবল শিক্ষাব্যবস্থার ওপর প্রবলভাবে পড়েছে। প্রায় দুটি বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। ছেলে-মেয়েরা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিক্ষা নিতে পারেনি। এমনটি কখনো ঘটেছে বলে মনে হয় না। মহাদুর্যোগেও এতদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকেনি। গোটা পৃথিবীতেই তাই ঘটলো। এই দুই বছরে প্রচুর শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। গ্রামের অনেক মেয়ের বাল্যবিয়ে হয়েছে। অনেকে পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে। তারা আর ফিরে আসবে না।
এরপর ডিজিটাল বৈষম্য আরও ক্ষতি ডেকে আনলো। ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নিতে পেরেছে। বাকিরা পারেনি। এর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব তো পড়বেই।
প্রশাসকনির্ভর জাতি হলে কী হবে ভবিষ্যতে, তার ইঙ্গিত তো দেখতে পাচ্ছি। কোনো চিন্তাবিদ আপনি দেখতে পাবেন? নেই। গবেষক নেই। এমন একটি জাতির ভবিষ্যৎ তো অন্ধকার। প্রশাসকরা প্রশাসকই তৈরি করেন। তারা শিক্ষার মর্ম কী বুঝবেন? তারা পরামর্শ দেবেন ভুল জায়গায় বিনিয়োগ করার
শহুরে শিক্ষার্থীরাও যে সবাই সমান সেবা পাচ্ছে, তা নয়। এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে লাখ লাখ শিক্ষার্থী অটোপাস নিয়ে বেরিয়ে গেলো। তাহলে কী ঘটলো? মানে মূল্যায়নটা ঠিক হলো না। অন্তত একটি পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যেত। হয়তো, আপাতত পাসের হার নিয়ে অনেকেই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে। কিন্তু এই মেধা নিয়ে কী ঘটবে তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে।
সায়েম সাবু: শিক্ষার মানের নিম্নগতি আরও আগ থেকেই। আপনি মান নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে আসছেন বরাবরই। এখন শঙ্কা আরও বাড়লো?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: একদম। শিক্ষার মানের এই দুর্গতি বহু আগে থেকেই। কোভিডের আগে থেকেই শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আমরা আন্তর্জাতিক মানের কোনো শিক্ষাব্যবস্থা গড়তে পারিনি। উচ্ছশিক্ষায় আরও বিপর্যয় দেখতে পাবেন। ভাষার ক্ষেত্রে আমরা কোনো মানদন্ড দাঁড় করাতে পারিনি। প্রতিটা ভাষার দক্ষতা যাচাইয়ের জন্য চারটি মানদন্ড থাকে। বলা, শোনা, পড়া এবং লেখা। উচ্চারণের ব্যাপার থাকে। আরও অনেক উপাদান থাকে। অথচ আমরা কোনোটাই মানি না।
তরুণরা বিপথগামী তা অস্বীকার করছি না। কিন্তু বয়স্করা ৯৯ ভাগই বিপথগামী। সমাজের প্রতি কী দায় পালন করছেন সিনিয়র সিটিজেনরা? তরুণদের দোষ দিয়ে লাভ কী? তারা কোথা থেকে শিখবেন। বাবা যদি ঘুসের টাকায়, দুর্নীতির টাকায় সংসার চালান, তরুণদের কী শেখাবেন?
আমরা শিক্ষার্থীদের শুধুই বলে থাকি, ক্লাসে আসো, মুখস্ত করো, পরীক্ষা দাও। এর বাইরে আমরা আর চিন্তা করি না। এক প্রকার নকলের উৎসব চলছে যেন। দক্ষতা বাড়াতে কোথাও কোনো কাজ হয় না। না গণিতে, না ভাষায়। কোচিং সেন্টারে যাও। নোট বই, গাইড বই পড় আর পাস করে বেরিয়ে আসো। এতে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে নিম্নমুখী করার আয়োজন চলছে।
সায়েম সাবু: শিক্ষা নিয়ে সরকারগুলো আশাবাদের কথা বলে। আপনি হতাশার কথা বলছেন। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও আমরা কেন শিক্ষার মান দাঁড় করাতে পারলাম না?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: এজন্য আমি সমাজের সামগ্রিক ব্যর্থতাকে দায়ী করবো। আমরা শিক্ষা নিয়ে কোনো চিন্তা করি না। আমরা ব্যবসা নিয়ে চিন্তা করেই অস্থির। আমরা সব প্রণোদনা ব্যবসার জন্য রেখে দেই। সব সুবিধা আমলারা পান, শিক্ষার উন্নয়ন ঘটবে কীভাবে! তাদের বেতন সবার চেয়ে বেশি। আমলা মাত্রই দামি গাড়ি, দামি বাড়ি। তাহলে শিক্ষার মান নিয়ে ভাববেন কেন?
আমরা যদি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বেতন সবচেয়ে বেশি দিতে পারতাম, শিক্ষকরা যদি সঠিক মূল্যায়ন পেতেন, তাহলে অবশ্যই মান নিয়ে প্রশ্ন তোলার যৌক্তিকতা থাকতো। শিক্ষার সঠিক মূল্যায়ন হলে আমরা দুই প্রজন্মের মধ্যেই পদ্মা সেতু বানাতে পারতাম। শিক্ষার মানোন্নয়ন মানেই তো সবার উন্নয়ন।
সায়েম সাবু: কিন্তু শিক্ষায় তো বিনিয়োগ আছে এবং সরকারগুলো এই বিনিয়োগে বরাবরই জোর দিয়ে আসছে?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কতটুকু বিনিয়োগ আছে, এটি নিয়ে আগে বিতর্ক হওয়া উচিত। শিক্ষায় আসলে সঠিক বিনিয়োগ হয়নি। যেখানে বিনিয়োগ না হলেও চলবে সরকার সেখানে বিনিয়োগ করে আসছে। সব দেশ প্রশাসকে ভরে গেছে। কোনো বিজ্ঞানী নেই। গবেষক নেই। দার্শনিক নেই। যেদিকে তাকাবেন, শুধুই প্রশাসন দেখতে পাবেন।
সায়েম সাবু: এই প্রশাসকনির্ভর জাতির ভবিষ্যৎ কী?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: প্রশাসকনির্ভর জাতি হলে কী হবে ভবিষ্যতে, তার ইঙ্গিত তো দেখতে পাচ্ছি। কোনো চিন্তাবিদ আপনি দেখতে পাবেন? নেই। গবেষক নেই। এমন একটি জাতির ভবিষ্যৎ তো অন্ধকার। প্রশাসকরা প্রশাসকই তৈরি করেন। তারা শিক্ষার মর্ম কী বুঝবেন! তারা পরামর্শ দেবেন ভুল জায়গায় বিনিয়োগ করার।
সায়েম সাবু: তাহলে আশার কথা নেই?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: আছে। তরুণরা আমার কাছে ভবিষ্যতের জায়গা। তরুণরা যখন দেখবে আমাদের দিয়ে আর কিছু হবে না, তখন তারাই সব বদলে দেবে। দু’মাস আগে বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের অবস্থা দেখেন, আর আজকের অবস্থা দেখেন। ভরসা তো তারুণ্যেই রাখতে হবে।
সায়েম সাবু: কিন্তু তরুণরাই এখন বিপথগামী বেশি বলা হচ্ছে…
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: আমি তা মনে করি না। তবে তরুণরা বিপথগামী তা অস্বীকার করছি না। কিন্তু বয়স্করা ৯৯ ভাগই বিপথগামী। সমাজের প্রতি কী দায় পালন করছেন সিনিয়র সিটিজেনরা? তরুণদের দোষ দিয়ে লাভ কী? তারা কোথা থেকে শিখবেন। বাবা যদি ঘুসের টাকায়, দুর্নীতির টাকায় সংসার চালান, তরুণদের কী শেখাবেন?
আপনি দেখেন, প্রশাসনের কোথায় ঘুস নেই? শিক্ষা প্রশাসনের প্রতিটি জায়গায় ঘুসের কারবার। আপনি শিক্ষা নিয়ে কী সুস্থ চিন্তা রাখবেন।
সায়েম সাবু: শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে কী বলবেন?
সৈয়দ মনজরুল ইসলাম: শিক্ষা পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। নইলে যে তিমিরে আছি, সেখানেই থাকব। শেখানোর প্রতিটি স্তরে পরিবর্তন আনতে হবে। দক্ষতানির্ভর, উদ্ভাবনী এবং সৃজনশীল শিক্ষার প্রবর্তন করতে হবে। মুখস্ত বিদ্যার ইতি টানতে হবে। বেতন-ভাতা বাড়িয়ে মেধাবীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে পারলে আমরা পরিবর্তন আনতে পারব। তা না হলে শেষ পরিণতির জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.