বা আ ॥ জনকল্যাণে সব ভয়-ভীতি, প্রলোভনের ঊর্ধ্বে থেকে দায়িত্ব পালনে জেলা প্রশাসকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে নিজেদেরকে ‘জনগণের খাদেম’ ভাবার পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি জেলা পর্যায়ের এই শীর্ষ কর্মকর্তাদের ২৪টি নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। গত মঙ্গলবার সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ‘জেলাপ্রশাসক সম্মেলন ২০২২’-এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে এসব নির্দেশনা দেন সরকারপ্রধান। শেখ হাসিনা বলেন, “মানুষের কল্যাণে আপনাদের সকল প্রকার ভয়-ভীতি ও প্রলোভনের ঊর্ধ্বে থেকে আইনানুগ দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানাচ্ছি।”
কোভিড-১৯ মহামারীর জন্য দুই বছর বিরতির পর এবার ভেন্যু বদলে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে জেলা প্রশাসক সম্মেলন শুরু হয়েছে। অন্যান্য বছর জেলা প্রশাসকদের অধিবেশনগুলো হয় সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সভাকক্ষে। মঙ্গলবার শুরু হওয়া এ সম্মেলন শেষ হবে গত বৃহস্পতিবার। উদ্বোধনী বক্তব্যে ১৯৭২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ভাষণ থেকে উদ্ধৃত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সরকারি কর্মচারী ভাইয়েরা, আপনাদের জনগণের সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করতে হবে এবং জাতীয় স্বার্থকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। এখন থেকে অতীতের আমলাতান্ত্রিক মনোভাব পরিবর্তন করে নিজেদের জনগণের খাদেম বলে বিবেচনা করতে হবে।” তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও নিজেকে জণগনের খাদেম হিসেবে অর্থাৎ সেবক হিসেবেই ঘোষণা দিয়েছিলেন। আমিও তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করে নিজেকে জনগণের একজন সেবক মনে করি। “ক্ষমতায় আসা, প্রধানমন্ত্রী হওয়া মানে জনগণের জন্য কাজ করার একটা সুযোগ পাওয়া এবং যেই লক্ষ্য স্থির করেছি সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে আপনাদের সহযোগিতা একান্তভাবে প্রয়োজন,” বলেন সরকার প্রধান।
তিনি বলেন, “সেবার মনোভাব নিয়ে সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকলে আপনাদের পক্ষে যথাযথ দায়িত্ব পালন সম্ভব হবে। এতে সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে। দেশ অব্যাহতভাবে এগিয়ে যাবে।” জেলা প্রশাসকদের ২৪টি বিষয়ে বিশেষ লক্ষ্য রাখার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। ১. করোনাভাইরাসজনিত সংকট মোকাবিলায় সরকারের জারি করা সব নির্দেশনা মাঠপর্যায়ে প্রতিপালন নিশ্চিত করতে হবে। ২. জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে গৃহীত উন্নয়ন ও সেবামূলক কার্যক্রমসমূহের যথাযথ বাস্তবায়ন এবং এর ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে হবে। ৩. খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং বাজারমূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য নেওয়া বিভিন্ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
৪. সরকারি অফিসগুলোতে সাধারণ মানুষ যেন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বিঘ্নে যথাযথ সেবা পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। সেবাপ্রত্যাশীদের সন্তুষ্টি অর্জনই যেন হয় সরকারি কর্মচারীদের ব্রত। ৫. এসডিজির নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে তৎপরতা জোরদার করতে হবে। ৬. গৃহহীনদের জন্য গৃহনির্মাণ, ভূমিহীনদের কৃষি খাসজমি বন্দোবস্তসহ সব সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে যেন প্রকৃত অসহায়, দুস্থ ও সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ সুযোগ পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
৭. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান কার্যক্রমের মানোন্নয়নে উদ্যোগী হতে হবে। কোভিড পরিস্থিতিতে বিকল্প ব্যবস্থায় অনলাইনে বা ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে পাঠদান কার্যক্রম যেন অব্যাহত থাকে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। অপেক্ষাকৃত দুর্গম এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। ৮. কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রগুলো যেন কার্যকর থাকে, প্রতিনিয়ত তার তত্ত্বাবধান করতে হবে এবং নানা কর্মসূচির মাধ্যমে জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়াতে হবে। ৯. শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের লক্ষ্যে তাদের জন্য প্রত্যেক এলাকায় সৃজনশীলতার চর্চা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ও ক্রীড়া সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। ১০. নাগরিকদের সুস্থ জীবনাচারের জন্য জেলা ও উপজেলায় পার্ক, খেলার মাঠ প্রভৃতির সংরক্ষণ এবং নতুন পার্ক ও খেলার মাঠ তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। ১১. পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে উচ্চপ্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ শ্রমশক্তি গড়ে তুলতে কাজ করতে হবে।
১২. জনসাধারণের মাঝে তথ্যপ্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করতে কাজ করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার, গুজব ইত্যাদি রোধে উদ্যোগ নিতে হবে। ১৩. বাংলাদেশের ধর্মীয় সম্প্রীতি ও অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যকে অক্ষুণ্ন রাখার লক্ষ্যে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। ১৪. মাদকমুক্ত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে মাদকের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অব্যাহত রাখতে হবে। মাদকবিরোধী অভিযান নিয়মিত পরিচালনা করতে হবে।
১৫. নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা, নিপীড়ন ও বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাল্যবিবাহ, ইভটিজিং, খাদ্যে ভেজাল, নকল পণ্য তৈরি ইত্যাদি অপরাধ রোধে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হবে। ১৬. বাজারে পণ্যের সরবরাহ মসৃণ রাখতে, কৃত্রিম সংকট রোধ ও পণ্যমূল্য স্বাভাবিক রাখতে বাজার তদারকি কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।
১৭. সরকারি জমি, নদী, বনভূমি, পাহাড়, প্রাকৃতিক জলাশয় রক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য নতুন সরকারি প্রতিষ্ঠান স্থাপনে ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণকে প্রাধান্য দিতে হবে; পরিকল্পিত নগরায়ন ও বনায়ন নিশ্চিত করতে হবে। ১৮. পর্যটন শিল্পের বিকাশ এবং রক্ষণাবেক্ষণে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নতুন নতুন পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। ১৯. জেলার নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষা এবং জেলাভিত্তিক বিখ্যাত পণ্যসমূহের প্রচার ও বিপণনে উদ্যোগী হতে হবে। ২০. জেলার সব সরকারি দপ্তরের কার্যক্রম যথাযথভাবে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছাতে ব্রতী হতে হবে।
২১. জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধি অর্থাৎ সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা যারা পৌরসভার মেয়র এবং যারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি আছে তাদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে হবে এবং উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণে যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে কিনা বা তার বাস্তবায়নও যথাযথভাবে হচ্ছে কিনা সেগুলো সমন্বয় করতে হবে। কারণ উন্নয়ন প্রকল্প যত্রতত্র যেন না হয় সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে।
২২. সমাজের অনগ্রসর শ্রেণি বেদে, জেলে, কৃষক, হিজড়া, হরিজন, পরিচ্ছন্ন কর্মীসহ যারা একেবারে সমাজের অনগ্রসর শ্রেণি, তাদের সার্বিক উন্নয়ন, তাদের বাসস্থান এবং সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে। ২৩. মুক্তিযুদ্ধে যেসব অঞ্চলে গণহত্যা হয়েছে, সেখানে সেই পরিবারদের বর্তমান অবস্থা জানা এবং তাদের যথাযথ সম্মানজনক জীবনযাত্রার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। ২৪. গণকবর সংরক্ষণ এবং যুদ্ধক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে এবং ইতিহাস জনসম্মুখে তুলে ধরতে হবে। শেখ হাসিনা বলেন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্প নেওয়ার সময় তা যথাযথভাবে এবং প্রয়োজনীয়তার সাপেক্ষে নেওয়া, সেগুলো বাস্তবায়নে কোন অনিয়ম হচ্ছে কিনা বা কোন দুর্নীতি হচ্ছে কিনা বা মানসম্মত হচ্ছে, তা নজরদারির ব্যবস্থা ডিসিদেরই করতে হবে।
“জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ সব জায়গায় নির্বাচিত প্রতিনিধি আছেন। তাদের কিছু প্রতিশ্রুতি থাকে জনগণের কাছে। এই প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন (করতে হবে)। তবে আমি অবশ্যই এটা বলবো প্রতিশ্রুতিগুলো আসলে যথাযথ কিনা সেটা বিবেচনা করে সেই ধরনের পরিকল্পনা নেওয়া (দরকার)।” ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, স্বাগত বক্তব্য দেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস। বিভাগীয় কমিশনারদের পক্ষে অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন খুলনার বিভাগীয় কমিশনার মো. ইসমাইল হোসেন, জেলা প্রশাসকদের পক্ষে বক্তব্য দেন চাঁদপুর জেলার জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মসলিশ ও রংপুরের জেলা প্রশাসক মো. আসিব আহসান।
সৌজন্যেঃ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম