প্রবীণদের নিঃসঙ্গতা রোধে আমাদের করণীয়

মুফতি মুহিউদ্দীন কাসেমী ॥ মানুষ সামাজিক প্রাণী। একাকী বসবাসে অভ্যস্ত নয়। আদম (আ.) জান্নাতের সুখশান্তিতে বসবাস করেও একাকিত্ব অনুভব করেন। তাঁর সঙ্গিনী আদি মাতা হাওয়াকে সৃষ্টি করার পর আদমের একাকিত্ব দূর হয় এবং মন ভালো হয়ে যায়। এটাই সৃষ্টির অমোঘ নিয়ম।
ছেলেমেয়েদের বিয়ে-শাদি দেওয়ার পর এবং চাকরি বা কাজকর্ম থেকে অবসরের পর মানুষ একা হয়ে যায়। তখন স্বামী বা স্ত্রী মারা গেলে তার সঙ্গী/সঙ্গিনী বিপাকে পড়ে যায়, একাকী হয়ে যায়। মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার পর স্বামীর বাড়ি চলে যায়। তাই যাদের একটি মাত্র ছেলে কিংবা ছেলেই নেই, তারা বেশি সমস্যায় পড়ে যায়। ছেলের বউয়ের আচরণ খারাপ হলে সমস্যা আরো বেড়ে যায়। ইসলামে মা-বাবা এবং মুরব্বিদের সম্মান রক্ষা করার এবং হক আদায় করার ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘সে আমার উম্মতভুক্ত নয় যে আমাদের বড়দের হক আদায় করে না এবং ছোটদের স্নেহ করে না। ’ (আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ৩৫৫)
ওাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘বয়স্ক মুসলিম, কোরআনের হকপন্থী ধারকবাহক এবং ন্যায়পরায়ণ বাদশাহর সম্মান করা মহান আল্লাহর সম্মানের মতো। ’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৮৪৩) রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : ‘কোনো যুবক যদি কোনো বৃদ্ধকে তার বার্ধক্যের কারণে সম্মান করে, তাহলে আল্লাহ তাআলা তার বার্ধক্যের সময় তাকে সম্মান করবে এমন লোক নিয়োজিত রাখবেন। ’ (তিরমিজি, হাদিস : ২০২২) তাই আমাদের করণীয় হলো
০১. পরিবারের এবং আশপাশের প্রবীণদের খোঁজখবর নেওয়া, সহযোগিতা করা। তাই আমরা মা-বাবা, নানা-নানির খোঁজ নেব, নিয়মিত দেখা করব। আত্মীয়দের মধ্যে যেসব প্রবীণ পরিবারের অবহেলিত, তাদের সন্তানদের সতর্ক করব।
০২. রমজান, ঈদ বা বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে এলাকায় কিছু দিতে চাইলে আমরা প্রবীণদের দেখে দেখে দেওয়ার চেষ্টা করব।
০৩. হয়তো আপনার নানা মারা গেছেন, শুধু নানি বেঁচে আছেন। ব্যস্ত জীবনে খোঁজ নেওয়া হয় না। এটা মারাত্মক ভুল। আপনার নানির খোঁজ নিন, আপনার বাসায় বা বাড়িতে এনে কিছু দিন রাখুন।
০৪. হতে পারে আপনার শ্বশুর বা শাশুড়ি মারা গেছেন। হয়তো তার ছেলে নেই কিংবা থাকলেও তেমন দেখাশোনা করে না। আপনার ঘরে তার মেয়ে আছে, আপনার মেয়ের মা-বাবাকে আপনার বাড়িতে নিয়ে আসুন। স্থায়ীভাবে না থাকলেও বছরে কয়েক মাস রাখার ব্যবস্থা করুন। জামাইয়ের সঙ্গে বসবাস করা লজ্জার কিছু নয়। তাদের সেবা করা আমাদের সৌভাগ্যের বিষয়।
০৫. অনেক মানুষ শরিয়তের নিয়ম লঙ্ঘন করে জীবিত থাকাকালীন ছেলেমেয়েকে পুরো সম্পদ লিখে দিয়ে ফেলে, যে কারণে কুলাঙ্গার ছেলেমেয়েরা বাপ-মায়ের সেবা করে না, অবহেলা করে। এমন দৃশ্যও দেখছি আমরা। তাই পরামর্শ থাকবে, আপনার ছেলেমেয়েকে পুরো সম্পদ লিখে দেবেন না, আপনার মৃত্যুর পর তো শরিয়তের নিয়ম অনুযায়ী তারা সব সম্পদ পেয়ে যাবে। তাই তাড়াহুড়া করার কোনো দরকার নেই। শরিয়তের নিয়ম হলো মৃত্যুর পর সম্পদ বণ্টন করা। আপনি শরিয়তের নিয়মের খেলাফ করেছেন, হতে পারে এ জন্যই আপনার ওপর আজাব এসেছে যে আপনার সন্তানরা আপনার সেবা করে না।
০৬. শেষ জীবনের সঙ্গিনী/সঙ্গী মারা গেলে বিয়ে করানো উচিত। বিশেষত পরুষদের। মুআজ ইবনে জাবাল (রা.) একজন বিখ্যাত সাহাবি। বিয়ে করেছেন। সন্তানও হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর আগে স্ত্রীর ইন্তেকাল হয়। তিনি মৃত্যুশয্যায় শায়িত। তখন সবাইকে ডেকে বললেন : ‘তোমরা আমাকে বিয়ে করাও। আমি অবিবাহিত অবস্থায় আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা অপছন্দ করি। ’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ১৬১৫৭)
আমাদের সমাজে প্রায়ই এমন দেখা যায় যে বউ মারা যাওয়ার পর ছেলেরা বাবাকে আর বিয়ে করাতে চায় না। মনে করে, আরো সন্তান হয়ে গেলে সম্পদ দখল করে ফেলবে! বাবাকে ভালোবাসার চেয়ে সম্পদের মহব্বত বেশি হয়ে গেল? অথচ এসব সম্পদ বাবার। এসব কুসংস্কার ছাড়ুন, প্রবীণদের বিয়েকে সহজ করুন। লজ্জার কিছু নেই। কুসংস্কার, রেওয়াজ ও লজ্জার চেয়ে মানুষের জীবনের দাম বেশি, শরিয়তের নির্দেশের গুরুত্ব বেশি।
০৭. শেষ জীবনে অনেক মানুষ আল্লাহর পথে ফিরে আসে। পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে, এটা বুঝতে পেরে দ্বিনের পথে চলার চেষ্টা করে। তাই তাদের দ্বিনের পথে চলার সহযোগিতা করতে হবে।
প্রবীণদের দ্বিনের পথে চলার সহযোগিতা
প্রবীণদের দ্বিনের পথে চলার সহযোগিতা করার লক্ষ্যে আমরা তিনটি কাজ করতে পারি :
ক. ইমাম সাহেবদের দায়িত্ব হলো, আপনার এলাকায় যেসব প্রবীণ রয়েছে, তাঁদের পেছনে মেহনত করা। তাঁদের পৃথক সময় দেওয়া, কোরআন শেখানো, দ্বিন শেখানো, দরদের সঙ্গে কথা বলা। ওই সময় মানুষ কথা বলার লোক খোঁজে।
খ. স্থানীয় দাওয়াত ও তাবলিগের লোকদের দায়িত্ব তাঁদের পেছনে বিশেষ মেহনত করা। সম্ভব হলে জামাতে বের করা, নইলে মহল্লায় মেহনতের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া।
ঘ. মাদরাসার পাশে বৃদ্ধাশ্রম স্থাপন করা। বৃদ্ধাশ্রম হবে নামে, কামে হবে মাদরাসা। বাসায় কেউ নেই, এখানে এসে কিছু দিন থাকল। কোরআন শিখল, দ্বিন শিখল, জামাতে নামাজ পড়ল এবং কোরআনের পাখিদের সঙ্গে কোলাহলে সময় কেটে গেল। যেসব মাদরাসার বিশাল জায়গা আছে তারা এই কাজটি করতে পারেন। জেলায় অন্তত একটা করে হওয়া দরকার। ঢাকার আশপাশে কয়েকটা হতে পারে। কেরানীগঞ্জ, সাভার, নারায়ণগঞ্জ প্রভৃতি এলাকায়। ঢাকার কোলাহল থেকে দূরে গিয়ে কিছু দিন দ্বিনি পরিবেশে সময় কাটাতে পারবে মানুষ। তাদের জন্য পৃথক ব্যবস্থা থাকবে।
বিশেষত বিত্তবান শিক্ষিত মানুষগুলো বেশি একাকী হয়ে পড়ে। তারা কিছু পড়তে চায়, জানতে চায়, মানুষকে জ্ঞান দিতে চায়, অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চায়, সারা জীবনের গল্পের পসরা সাজিয়ে বসতে মন চায়। কিন্তু তার কথা শোনার মতো কেউ থাকে না। ছেলে থাকে লন্ডনে, মেয়ে থাকে আমেরিকায়। এ রকম অবস্থা অনেক ফ্যামিলির। তাই মাদরাসার সঙ্গে দ্বিনি পরিবেশে বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। মাদরাসারও ফায়দা হবে, আশা করি। মহান আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published.