মানুষ যেভাবে আল্লাহর খলিফা

কাসেম শরীফ ॥ পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘স্মরণ করো, যখন তোমার রব ফেরেশতাদের বললেন, আমি পৃথিবীতে খলিফা সৃষ্টি করছি…। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ৩০) এ আয়াতে বর্ণিত ‘খলিফা’ শব্দের অর্থ নির্ণয়ে তাফসিরবিদদের বিভিন্ন মত এসেছে। মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক বলেন, এর অর্থ স্থলাভিষিক্ত হওয়া। অর্থাৎ আল্লাহ ফেরেশতাদের সম্বোধন করে বলছেন যে আমি তোমাদের ছাড়া এমন কিছু সৃষ্টি করতে যাচ্ছি, যারা যুগ যুগ ধরে বংশানুক্রমে একে অন্যের স্থলাভিষিক্ত হতে পারে।
(তাফসিরে ইবনে কাসির)
ইবনে জারির (রহ.) বলেন, আয়াতের ব্যাখ্যা হচ্ছে, আমি পৃথিবীতে আমার পক্ষ থেকে প্রতিনিধি নিয়োগ করতে চাই, যে আমার সৃষ্টিকুলের মধ্যে ইনসাফের সঙ্গে আমার নির্দেশ বাস্তবায়ন করবে। আর এ প্রতিনিধি হচ্ছে আদম এবং যারা আল্লাহর আনুগত্য ও আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে ইনসাফের সঙ্গে তাঁর বিধান প্রতিষ্ঠায় আল্লাহর স্থলাভিষিক্ত হবে। (তাফসিরে তাবারি) ‘খলিফা’ শব্দের এমন ব্যাখ্যা কোরআনের অন্য আয়াতে দেখা যায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর আমি (আল্লাহ) তাদের পর পৃথিবীতে তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করেছি—তোমরা কেমন কাজ করো, তা দেখার জন্য। ’ (সুরা : ইউনুস, আয়াত : ১৪)
তাফসিরবিদ ইবনে আশুর (রহ.) বলেন, (প্রথম) খলিফা মূলত আদম (আ.)। আর তাঁর খিলাফত হলো পৃথিবীতে আল্লাহর উদ্দেশ্যের বাস্তবায়ন। অর্থাৎ আল্লাহপ্রদত্ত প্রজ্ঞা ও ওহির আলোকে পৃথিবীকে আবাদ করা এবং আদমসন্তানকে এই পৃথিবীতে আল্লাহর ইচ্ছা ও উদ্দেশ্যের ব্যাপারে তাগিদ দেওয়া। (আত-তাহরির ওয়াত তানভির) তাফসিরবিদ ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, খলিফা অর্থ এমন জাতি, যারা একে অন্যের পরে আসবে। পবিত্র কোরআনে এই মর্মে এসেছে, ‘তিনিই (আল্লাহ) তোমাদের দুনিয়ার প্রতিনিধি বানিয়েছেন…। ’ (সুরা আনআম, আয়াত : ১৬৫)
বিখ্যাত ইসলামিক স্কলার আল্লামা তাকি উসমানি তাঁর ‘ইসলাম আওর সিয়াসি নজরিয়াত’ গ্রন্থে লিখেছেন, পবিত্র কোরআনে খিলাফত বা খলিফা শব্দ বহু জায়গায় এসেছে। তাফসিরবিদরা বলেছেন, খিলাফত দুটি অর্থে ব্যবহৃত হয়। এক অর্থ হচ্ছে, প্রত্যেক ব্যক্তি—যে আল্লাহর ওপর ঈমান রাখে, সে আল্লাহর খলিফা। ব্যক্তির কাছে প্রত্যাশা হচ্ছে এই যে সে আল্লাহর বিধিবিধানের আনুগত্য করবে এবং আল্লাহর আখলাকের সঙ্গে সাদৃশ্য অবলম্বন করবে। অন্য অর্থে ‘আল্লাহর বৈশিষ্ট্যে বিশিষ্ট’ হওয়া। এই অর্থে প্রত্যেক মুসলমান আল্লাহর খলিফা। মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব বা খিলাফত গ্রহণ করবে—এটাই তার কাছে প্রত্যাশা। বেশির ভাগ তাফসিরবিদের অভিমত এমনই। এ হচ্ছে ঐকিক খিলাফত, এর মধ্যে প্রত্যেক ব্যক্তির পুরো জীবন আল্লাহ তাআলার হুকুমের অধীন হওয়া এবং আল্লাহর বৈশিষ্ট্যে বিশিষ্ট হওয়ার অর্থ আছে। খিলাফতের দ্বিতীয় অর্থ হলো, আল্লাহ তাআলার যে কর্তৃত্বগুণের বৈশিষ্ট্য আছে, তা দুনিয়াতে কার্যকর করার জন্য কেউ তাঁর প্রতিনিধি হওয়া এবং আল্লাহ তাআলার প্রতিনিধিত্ব ও খিলাফতের অধীন হয়ে মানুষের ওপর রাজত্ব পরিচালনা করা। এ অর্থেই পবিত্র কোরআনে দাউদ (আ.)-এর ব্যাপারে বলা হয়েছে, ‘আমি তোমাকে ভূপৃষ্ঠে খলিফা নিযুক্ত করেছি। ’ (সুরা : সাদ, আয়াত : ২৬)
এই দ্বিতীয় অর্থের বিচারে ইসলামে যিনি শাসক নিযুক্ত হন, তাঁর ব্যাপারে মূল নীতি হচ্ছে তিনি সত্তাগতভাবে শাসক নন; বরং মহান আল্লাহর খলিফা। আর যখন তিনি খলিফা, তখন এর আবশ্যিক ফলাফল হলো তিনি রাষ্ট্র পরিচালনায় ঐশী বিধি-বিধানের অনুগত। এখান থেকেই ইসলাম ও অন্য রাজনৈতিক মতাদর্শের মধ্যে একটি স্পষ্ট সীমারেখা সৃষ্টি হয়ে যায়। অর্থাৎ ধর্মবিযুক্ত ব্যবস্থাপনায় শাসক নিজেকে ঐশী বিধি-বিধানের অনুগত সাব্যস্ত করে না; কিন্তু খলিফার জন্য আবশ্যক হলো ঐশী বিধি-বিধানের অনুগত হয়ে আইন-কানুন জারি করা। আল্লামা ইবনে খালদুন তাঁর ‘মুকাদ্দিমা’-এর মধ্যে লিখেছেন, হুকুমত বা রাজত্ব তিন ধরনের—
(ক) প্রাকৃতিক সরকার (খ) রাজনৈতিক সরকার ও (গ) খিলাফত।
ইবনে খালদুন প্রাকৃতিক সরকারের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে— কোনো শাসকের ইচ্ছা, প্রবৃত্তি ও খায়েশের দাবি অনুযায়ী সরকার পরিচালনা করা। স্বেচ্ছাচারী রাজাদের কর্মপন্থা ছিল এমনই।
দ্বিতীয় প্রকার রাজনৈতিক সরকার। এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন—
দেশের সব মানুষকে বিবেকপ্রসূত চিন্তাচেতনা অনুযায়ী ইহলৌকিক কল্যাণ অর্জন এবং ইহলৌকিক ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচতে বাধ্য করা। সেক্যুলার শ্রেণি এর অন্তর্ভুক্ত। কেননা, এর কাছে চিরন্তন কোনো তাকদির বলে কিছু নেই। এ জন্য বিবেকের বিচারে যা ভালো মনে হয়, সেটাই অবলম্বন করা হয়।
তৃতীয় প্রকার খিলাফত। ইবনে খালদুন এই প্রকারের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে—
অর্থাৎ মানুষকে ইসলামী শরিয়তের চিন্তাচেতনা অনুযায়ী পরিচালনা করা, যাতে তাদের পরকালের স্বার্থ পূরণ হয় এবং পূরণ হয় দুনিয়ার স্বার্থও, যার লক্ষ্য পরকালীন কল্যাণ। (ইবনে খালদুন, মুকাদ্দিমা, তৃতীয় অধ্যায়, পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ : ১৮৯)
সুতরাং যিনি যথাস্থানে সত্য প্রতিষ্ঠাকারী এবং আল্লাহর বিধি-বিধানের অনুগত, তিনিই হবেন খলিফা। এরই নাম খিলাফত।
লেখক : ধর্ম বিভাগীয় প্রধান

Leave a Reply

Your email address will not be published.