খাবার নাকি অসুখ কিনছি

জাকিয়া আহমেদ ॥ সম্প্রতি ‘রেডি টু ইট বা প্যাকেটজাত’ এবং প্রক্রিয়াজাত খাবারের চাহিদা বিশ্বজুড়েই বেড়েছে, বাংলাদেশও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। এসব পণ্য নিয়ে এক দীর্ঘ গবেষণায় দেখা গেছে, প্রক্রিয়াজাত খাবারগুলোর অধিকাংশেই আছে মাত্রাতিরিক্ত লবণ, চিনি ও স্যাচুরেটেড ফ্যাট। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের খাবারগুলো মানুষের স্থূলতা বাড়াচ্ছে। সেই সঙ্গে খাদ্য সর্ম্পকিত অসংক্রামক রোগের প্রধান কারণে পরিণত হয়েছে এসব খাবার।
পরিসংখ্যান বলছে, অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রক্রিয়াজাত খাবারের উৎপাদন বার্ষিক গড়ে শতকরা আট শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ দেশে মোট মৃত্যুর ৭০ শতাংশ হয় অসংক্রামক রোগে; ২০৪০ সালে যা ৮০ শতাংশে ঠেকতে পারে। এর পেছনে বড় নেতিবাচক ভূমিকা রাখবে খাদ্যে ভেজাল কিংবা মাত্রাতিরিক্ত স্বাদবর্ধক উপাদান। যে তালিকায় বাদ নেই শিশুদের পছন্দের চিপস, চানাচুর কিংবা বিস্কুটও। গবেষণায় বলা হয়েছে, ইউকে স্বাস্থ্য বিভাগের রেটিং ট্রাফিক লাইট অনুসারে চিপসে চিনি রয়েছে সাত দশমিক দুই শতাংশ, লবণ দুই দশমিক এক শতাংশ, স্যাচুরেটেড ফ্যাট ১১ দশমিক ছয় শতাংশ ও ফ্যাট ২৪ দশমিক চার শতাংশ। চানাচুরে চিনি ১১ দশমিক আট শতাংশ, লবণ এক দশমিক সাত শতাংশ, স্যাচুরেটেড ফ্যাট ১৫ দশমিক আট শতাংশ ও ফ্যাট ৩৭ দশমিক চার শতাংশ। বিস্কুটে যথারীতি চিনি ১৯ দশমিক চার শতাংশ, লবণ এক দশমিক ছয় শতাংশ, ও ফ্যাট রয়েছে ১৮ দশমিক সাত শতাংশ। আবার অস্ট্রেলিয়ার ফুড সেফটি অথরিটির গাইডলাইন অনুসারে চিপস পেয়েছে শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ থেকে দুই শতাংশ, চানাচুর শূন্য দশমিক পাঁচ থেকে এক দশমিক পাঁচ আর বিস্কুট শূন্য দশমিক পাঁচ থেকে দুই শতাংশ রেটিং। যেখানে হেলথ স্টার রেটিং চারের বেশি হলে সেটা স্বাস্থ্যকর, আর এর কম হলে অস্বাস্থ্যকর।

‘সল্ট, সুগার অ্যান্ড ফ্যাট কন্টেন্ট ইন কমনলি কনজিউমড প্রসেডড প্যাকেজড ফুড অ্যান্ড দেওয়ার কনফরমিটি উইথ লেবেল ইনফরমেশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই গবেষণায় প্রধান গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে ও হাসপাতালের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী। তিনি জানান, ‘প্রক্রিয়াজাত খাবারের প্যাকেজিংয়ে খাবারের উপাদানের যেসব তথ্য থাকে, সেটার সঙ্গে গবেষণায় পাওয়া তথ্যও মেলেনি। যেমন প্যাকেটের গায়ে লবণের পরিমাণ যা লেখা তার মধ্যে ‘আন্ডার রিপোর্টেড’ ছিল ৬৬ দশমিক সাত শতাংশ। অর্থাৎ, হয়তো আমরা পেয়েছি ১২ গ্রাম, কিন্তু প্যাকেটে লেখা ছিল আট গ্রাম। এভাবে বেশিরভাগই ছিল অ্যান্ডার রিপোর্টেড। সঠিক লেভেল কোনোটাতেই পাইনি।’
বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, চিনি, লবন, স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং ফ্যাট-সবগুলোই কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ অর্থ্যাৎ হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। চিনি বেশি খেলে ওজন বাড়বে, লবণে উচ্চ রক্তচাপ, চর্বি কোলেস্টেরলের উপর প্রভাব ফেলবে, হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াবে। সবগুলোই হচ্ছে আমাদের হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ানোর উপাদান। এসব খাবার যদি মানুষ বেশি খায়, রেগুলার কনজিউম করি, তাহলে আমাদের যে রিকোমেন্ডেড ভ্যালু, তার থেকে অনেক বেশি কনজিউম করবো। এক প্যাকেট চিপসের ওজন ১০০ গ্রাম, সেখানে লবণের পরিমাণ দুই দশমিক এক গ্রাম। কিন্তু কেউ যদি দুই প্যাকেট চিপস খায় তাহলে সে দৈনিক লবণ খাবার যে রিকোমেন্ডেশন পয়েন্ট পাঁচ গ্রাম রয়েছে, সেটা পার হয়ে যাবে। আর প্রতিদিন যদি শিশুদের চিপস দেওয়া হয় তাহলে তার পরিণাম হবে আরও ভয়াবহ।

এ গবেষণায় যুক্ত ছিলেন ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ বিভাগের সহযোগী বিজ্ঞানী আবু আহমেদ শামীম। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্ব জুড়েই আন্ডার নিউট্রেশনের (অপুষ্টি) চাইতে ওবেসিটি (স্থূলতা), ওভার ওয়েট (ওজন বেশি) এগুলো বাড়ছে এবং সেটা শুরু হয় ছোটবেলা থেকেই। একইসঙ্গে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক হেলথ সার্ভে অনুসারে নারীরাও অপুষ্টির তুলনায় স্থুলতা এবং ওজনের আধিক্যে বেশি আক্রান্ত। প্রক্রিয়াজাত খাবারকে জাংক ফুড বলা হয়। এগুলোতে চিনি, লবন, স্যাচুরেটেড ফ্যাট অথবা ফ্যাট বেশি থাকবেই। কোনও কোনও খাবারে একাধিক উপাদানই বেশি থাকে নির্ধারিত মাত্রার তুলনায়। এগুলো কোনওটাই স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়।’
সেইসঙ্গে প্যাকেটের গায়ে অর্থ্যাৎ, লেবেলে যা লেখা তার চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশি বা কম থাকে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অর্থ্যাৎ সঠিক পুষ্টিটা কখনোই থাকছে না। আবু আহমেদ শামীম বলেন, যে কোনও অসংক্রামক রোগের জন্য ওবেসিটি বা স্থুলতা অনেক কারনের মধ্যে এসব খাবার অন্যতম একটা কারণ। বিশেষ করে শিশু-কিশোররা এর প্রধান ক্রেতা। চানাচুর সল্টি, মানুষ জেনেবুঝেই খায়। কিন্তু যতটুকু লবণের পরিমাণ প্যাকেটের গায়ে লেখা রয়েছে, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি থাকে। সেটা রীতিমতো মানুষের সঙ্গে প্রতারণা এবং অন্যায়। এ বিষয়ে ‘মনিটরিংয়ে জোরদার’ করা দরকার দাবি জানিয়েছেন, কোনও কোম্পানির কিছু অনুমোদন পেল, লেবেল লিখলো। কিন্তু প্যাকেটের গায়ে যেটা লেখা রয়েছে, সেটা রয়েছে কিনা এই বিষয়টাই দেখার কেউ নাই। কেউ যে এসব মনিটর করছে, তার প্রমাণ আমরা গবেষণায় পাইনি। হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার গত কয়েক বছরে অনেক বেড়েছে। আর সেটা শুরু হয় তরুন বয়স থেকেই। কখনও কখনও তারও অনেক কম বয়স-বলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. হারিসুল হক।

তিনি বলেন, ‘হৃদরোগীর ক্ষেত্রে চিকিৎসায় যতোটা ফলাফল আসে, তারচেয়ে প্রতিরোধমূলক কাজে অনেক বেশি ভালো ফলাফল পাওয়ায যায়। হৃদরোগ হয়ে গেলে তাকে চিকিৎসা দেওয়ার সময়ে যে পরিমাণ ওষুধ, শ্রম, যন্ত্রপাতি, যে চিকিৎসা দেওয়া হয়, এর চেয়ে অনেক সহজ উপায় হলো, যদি সেটা প্রিভেনশনের দিকে নজর দেওয়া হয়।আর এ কারনে বিশ্বজুড়েই প্রিভেন্টিভ কার্ডিওলজির দিকে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে।’
অধ্যাপক ডা. হারিসুল হক বলেন, জীবনযাত্রাকে যদি মোডিফাই করা যায়, তাহলে হৃদরোগ প্রতিরোধযোগ্য। কারণ হঠাৎ করেই হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া রোগীর হার এক শতাংশ, বাকি ৯৯ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে সেটা ধীরে ধীরে তৈরি হয়। আর তার অন্যতম কারণ, শারীরিক পরিশ্রম না করা, ধূমপান এবং আজকের দিনের এসব অস্বাস্থ্যকর খাবার অর্থাৎ, জাংক ফুড।
লবণ না খাওয়াসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি যদি মেনে চলা যায়, তাহলে হৃদরোগীর পরিমাণ ভয়ংকরভাবে কমে যাবে। অথচ বাজার ভর্তি যেসব খাবার রয়েছে, তাতে লবন, চিনি, ফ্যাটের পরিমান নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। অথচ এসব মনিটর করার নেই, কেবলমাত্র সঠিক মনিটরিং করে ব্যবস্থা নেওয়ার মতো পরিবেশ আমাদের যদি থাকতো তাহলে হৃদরোগীর সংখ্যা অনেক কমে যেতো আমাদের, অথচ আমরা খাবার খেয়ে অসুখ কিনছি, বলেন অধ্যাপক হারিসুল হক।

Leave a Reply

Your email address will not be published.