ঈদযাত্রায় সড়কে ঝরলো ৪৪৩ প্রাণ

প্রশান্তি ডেক্স ॥ এবারের ঈদযাত্রায় দুর্ঘটনায় ৪৪৩ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী। গত বৃহস্পতিবার (১২ মে) সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর রুনি মিলনায়তনে ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ তথ্য তুলে ধরেন। লিখিত বক্তব্যে মোজাম্মেল হক বলেন, পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে পরে যাতায়াতে দেশের সড়ক-মহাসড়কে ৩৭২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪১৬ জন নিহত ৮৪৪ জন আহত হয়েছেন। সড়ক, রেল ও নৌ-পথে সম্মিলিতভাবে ৪০২টি দুর্ঘটনায় ৪৪৩ জন নিহত ও ৮৬৮ জন আহত হয়েছেন। তিনি জানান, সংগঠনটির সড়ক দুর্ঘটনা মনিটরিং সেল প্রতি বছরের ন্যায় এবারো প্রতিবেদনটি তৈরি করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিবছর ঈদ কেন্দ্রিক সড়ক দুর্ঘটনা আশংকাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় সংগঠনটি ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা, অতিরিক্ত ভায়া আদায় ও যাত্রী হয়রানীর বিষয়টি দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে পর্যবেক্ষণ করে আসছে।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব বলেন, এবারের ঈদে করোনা মুক্তির কারণে বেশি মানুষের যাতায়াত হয়। বিগত ২ বছর করোনা সংকটের কারণে গণপরিবহন বন্ধ চালুর ফাঁকে প্রায় ১০ লাখ মোটরসাইকেল ও ২০ লাখ ইজিবাইক রাস্তায় নামে। ফলে এবারের ঈদযাত্রায় ২৫ লাখ মোটরসাইকেল, ৪০ লাখ ইজিবাইক বহরে থাকার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারের বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থার উল্লেখযোগ্য তৎপরতার কারণে ঈদযাত্রা ক্ষাণিকটা স্বস্তিদায়ক হলেও সড়ক দুর্ঘটনা বরাবরের মতো বেড়েছে। ঈদযাত্রা শুরুর দিন ২৬ এপ্রিল থেকে ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফেরা ১০ মে পযন্ত বিগত ১৫ দিনে ৩৭২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪১৬ জন নিহত ৮৪৪ জন আহত হয়েছে। বিগত ২০২১ সালের ঈদুল ফিতরে যাতায়াতের সাথে তুলনা করলে এবারের ঈদে সড়ক দুর্ঘটনা ১৪.৫১ শতাংশ, নিহত ২২ দশমিক ৩৫ শতাংশ এবং আহত ২৬ দশমিক ৩০ শতাংশ বেড়েছে। উল্লেখিত সময়ে রেলপথে ২৭টি ঘটনায় ২৫ জন নিহত ও ৪ জন আহত হয়েছে। নৌ-পথে ৩টি দুর্ঘটনায় ২ জন নিহত ও ২০ জন আহত হয়েছে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, বরাবরের মতো এবারও দুর্ঘটনার শীর্ষে রয়েছে মোটরসাইকেল। এবারের ঈদে ১৬৪টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৪৫ জন নিহত, ১১০ জন আহত হয়েছে। যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৪৪ দশমিক ০৮ শতাংশ, নিহতের ৩৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ এবং আহতের ১৩ দশমিক ০৩ শতাংশ প্রায়। এই সময় সড়কে দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ২০৯ জন চালক, ২৪ জন পরিবহন শ্রমিক, ৮৮ জন পথচারী, ৬২ জন নারী, ৩৫ জন শিশু, ৩৩ জন শিক্ষার্থী, ২ জন সাংবাদিক, ৮ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ২ জন শিক্ষক, ৬ জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, ২ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ১ জন চিকিৎসকের পরিচয় মিলেছে।
এর মধ্যে নিহত হয়েছেন ২ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা, ১ জন পুলিশ সদস্য, ২ জন ডিজিএফআই সদস্য, ১ জন সেনাবাহিনীর সদস্য, ২ জন নৌবাহিনীর সদস্য, ৩৫ জন নারী, ১ জন চিকিৎসক, ২৫ জন শিশু ২৫ জন শিক্ষার্থী, ২ জন শিক্ষক, ১২৫ জন চালক, ১২ জন পরিবহন শ্রমিক, ৬০ জন পথচারী, ৫ জন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সড়ক দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের সদস্যরা বহুল প্রচারিত ও বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় দৈনিক, আঞ্চলিক দৈনিক ও অনলাইন দৈনিক এ প্রকাশিত সংবাদ মনিটরিং করে এ প্রতিবেদন তৈরি করে। লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, সংগঠিত দুর্ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, মোট যানবাহনের ৩৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ মোটরসাইকেল, ১৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ ট্রাক, পিকআপ, কাভার্ডভ্যান, লরি, ৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ কার, মাইক্রো, জিপ, ৫ দশমিক ২৩ শতাংশ নছিমন, করিমন, ট্রাক্টর, লেগুনা-মাহিন্দ্রা, ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ অটোরিক্সা, ৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ ব্যাটারি চালিত রিকশা, ইজিবাইক, ভ্যান, সাইকেল ও ১৭ দশমিক ৯০ শতাংশ বাসের কারণে এসব দুর্ঘটনা হয়।
সংগঠিত দুর্ঘটনার ২০ দশমিক ৯৬ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ৪২ দশমিক ৪৭ শতাংশ পথচারীকে গাড়ি চাপা দেওয়ার ঘটনা, ১৫ দশমিক ৩২ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ার ঘটনায়, ১৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ অন্যান্য অজ্ঞাত কারণে, ১ দশমিক ০৭ শতাংশ ট্রেন-যানবাহন সংঘর্ষ ও শূণ্য দশমিক ২৬ শতাংশ চাকায় ওড়না পেঁছিয়ে দুর্ঘটনা সংগঠিত হয়েছে। দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মোট সংঘটিত দুর্ঘটনার ৩৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ৪৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে, ১৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ ফিডার রোডে সংঘটিত হড়। এছাড়াও সারাদেশে সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার ৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ ঢাকা মহানগরীতে, ২ দশমিক ৪১ শতাংশ চট্টগ্রাম মহানগরীতে সংঘটিত হয়েছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার এই চিত্রকে একটি প্রতীকি চিত্র বলা চলে। প্রকৃতপক্ষে দেশে বর্তমানে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইক ক্যান্সারের মতো বেড়ে যাওয়ার কারনে পঙ্গু হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ১৫০ পঙ্গু রোগী ভর্তি হলেও ঈদের এইসময়ে ২০০ থেকে ২৫০ জন হারে প্রতিদিন রোগী ভর্তি হয়েছে। যার ৬০ শতাংশ মোটরসাইকেল, ২৫ শতাংশ ইজিবাইক দুর্ঘটনায় শিকার হয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়াও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ২ শতাধিক সড়ক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত রোগী ভর্তি হচ্ছে। দেশের বিভাগীয় হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৮০ থেকে ১০০ সড়ক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত রোগী ভর্তি হচ্ছে। জেলা সদর হাসপাতালেও আক্রান্ত রোগীর যেধরনের ভয়াবহ চিত্র দেখা যায়প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের চিত্র সংবাদপত্রে উঠে আসে না বলেই আমরাও এই ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরতে পারি না।
তিনি আরও বলেন, সড়ক, রেল ও নৌ পথের উন্নয়নে সরকার কয়েক লাখ কোটি টাকার প্রকল্প প্রায়একযুগ ধরে বাস্তবায়ন করে আসছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের দীর্ঘসূত্রিতা, মেগা প্রকল্পের কারণে এসব প্রকল্প এখনো চালু না হওয়ায় অন্যদিকে গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন না হওয়ায় ভোগান্তি ও যানজট থেকে বাঁচতে মানুষ বিকল্প হিসেবে এসব ছোট পরিবহনের ব্যবহার অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে যানজট ও সড়ক দুর্ঘটনা কল্পনার চেয়েও বেশি গতিতে বাড়েছে। তিনি মোটরসাইকেল ও ইজিবাইকের আমদানি বন্ধের পাশাপাশি গণপরিবহনকে বিকশিত করার দাবি জানান। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন— বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ড. হাদিউজ্জামান, যাত্রী কল্যাণ সমিতির সহ-সভাপতি তাওহীদুল হক লিটন, যুগ্ম মহাসচিব মনিরুল হক, প্রচার সম্পাদক মাহমুদুল হাসান রাসেল প্রমুখ।

Leave a Reply

Your email address will not be published.