ইভিএম ফাঁদ

প্রশান্তি ডেক্স॥ কিছু দিন আগে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন এবারের নির্বাচনে ৩০০ আসনেই ইভিএম ব্যবহার করা হবে। ব্যস, আর যায় কোথায়। গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে নির্বাচন কমিশন পর্যন্ত সর্বত্র একই আলোচনা। নির্বাচন কমিশনের ইভিএম ব্যবহারের সক্ষমতা, ইভিএমের বিশ্বাসযোগ্যতা, বিশ্বের অন্যান্য দেশে ইভিএমে ভোট হওয়া না হওয়া, প্রযুক্তিবিদদের মতামত সব মিলিয়ে নির্বাচনি আলোচনার পুরোটাজুড়েই এখন আছে ইভিএম। ইভিএম নিয়ে এই তর্ক-বিতর্ক আর উত্তেজনার মধ্যে চাপা পড়ে গেলো মূল আলোচনা। নির্বাচনটিকে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করার জন্য কী করবে নির্বাচন কমিশন?

প্রধান বিরোধী দলের এক দফা, এক দাবি– দলীয় সরকারের অধীনে আর কোনও নির্বাচন নয়। সরকার যথারীতি তা মানতে নারাজ। তাহলে কি প্রধান বিরোধী দল ছাড়াই হতে যাচ্ছে আগামী নির্বাচন?

সংবিধানে সুবিধা মতো সংশোধনীর ফলে সেটি এখন সরকারের কাছে পবিত্র ধর্মগ্রন্থের মতো যার পরিবর্তন কিছুতেই সম্ভব নয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগের সময়ের মতো সরকার সংবিধানকে ধর্মগ্রন্থের মতো করে বারবার সামনে এনে বলছে, এর ব্যত্যয় হওয়া চলবে না। আর তাই নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে কোনোরকম কোনও আলাপে আগ্রহী নন তারা। নির্বাচন কমিশনও এগিয়ে যাচ্ছে সরকারের দেখানো সেই পথেই। নানা রকম বিষয় মাঠে ছেড়ে দিয়ে তারা আলোচনায় থাকছে। এখন যেমন আলোচনা চলছে ইভিএমে ভোট করা নিয়ে। 

বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে ইভিএমের প্রতি আগ্রহী করার জন্য বলা হচ্ছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো চাইলে ইভিএম মেশিন পরীক্ষা করতে পারে। তাতে সন্তুষ্ট হলে ইসি ইভিএমে নির্বাচন করবে। বর্তমানে ইসির হাতে থাকা দেড় লক্ষ ইভিএম দিয়ে ১০০টি আসনে নির্বাচন করা যাবে। অর্থাৎ পুরো নির্বাচন ইভিএমে করতে প্রয়োজন হবে আরও ৩ লক্ষ মেশিন। অর্থাৎ মোট মেশিন সাড়ে চার লক্ষ। বিএনপি বা অন্য কোনও দলের পক্ষে এর মধ্য থেকে কয়টি মেশিন পরীক্ষা করা সম্ভব? এক শতাংশ করতে হলেও মেশিনের সংখ্যা হয় সাড়ে চার হাজার। তাহলে কিছু সংখ্যক মেশিন পরীক্ষা করে বাকি মেশিনগুলোর ব্যাপারে আস্থা আনা কি সম্ভব?

তাত্ত্বিকভাবে ধরে নেওয়া যাক কোনও দ্বৈব ক্ষমতাবলে সাড়ে চার লক্ষ ইভিএম বিরোধীরা পরীক্ষা করে ফেলতে পারলো এবং দেখা গেলো পরীক্ষার সময় সেগুলো সঠিক ফলাফল দিচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, তাতেও কি এই মেশিনে ভোটের ব্যাপারে বিরোধীরা আস্থাশীল হতে পারবে?

পরীক্ষার পরে এই মেশিনগুলো থাকবে নির্বাচন কমিশনের জিম্মায়। আর নির্বাচনের আগ মুহূর্তে প্রশাসনের হাতে। যাদের হাতে মেশিনগুলো থাকবে তারা পরীক্ষার পর মেশিনগুলোর প্রোগ্রামিং পাল্টে ফেলবে না, কিংবা কোনও যন্ত্রাংশ পাল্টে ফেলবে না, সেটার গ্যারান্টি আছে কি? এই আস্থা তো মানুষ নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের প্রতি রাখে না।

পরের ধাপে যাই। তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যাক, মেশিনগুলোতে কোনও রকম কারসাজি করা হলো না। তাতেই কি বিরোধীদের আহ্লাদে আটখানা হয়ে নির্বাচনে যেতে হবে?

২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি’র শত শত কর্মী শারীরিক আক্রমণের শিকার হয়েছেন, আহত হয়েছেন। সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করছেন এমন অন্তত ৫০ জন্য বিএনপি নেতা আওয়ামী লীগের হামলায় রক্তাক্ত হয়েছেন। বিএনপি কর্মীদের ধরপাকড়ের মাধ্যমে জেলে নেওয়া হয়েছে। এরপর ভোটটি কীভাবে হয়েছে সেটা জানেন এই দেশের সব মানুষ, জানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, জানে গণমাধ্যম, জানে এ দেশের নাগরিক সমাজ। তাই সেই আলোচনা থাকুক।  

এই সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের পরে যেসব নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেছিল সেগুলোতে নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রে এজেন্ট যেতে দেওয়া হয়নি, যারা গিয়েছিল তাদের বের করে দেওয়া হয়েছে। মানুষকে ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়া হয়েছে। ভোটকেন্দ্রের বাইরে ‘খুশিতে ঠেলায় ঘোরতে’ আসা মানুষদের দিয়ে কৃত্রিম লাইন তৈরি করে ভোটকেন্দ্রে প্রকৃত ভোটারদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি।

ভোটকেন্দ্রের ভেতরে ভোট দেওয়ার স্থানে সরকারি দলের লোকজন দাঁড়িয়ে থেকে নৌকায় ভোট দিতে বাধ্য করা, ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে মেশিন আনলক করার পর ভোটারকে চলে যেতে বলে নিজেরা ভোট দিয়ে দেওয়ার মতো নানা ঘটনার অভিযোগ এমনকি স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ছিল। একটা পর্যায়ে বিএনপি এই সরকারের অধীনে আর কোনও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। সরকারের বন্ধু জাতীয় পার্টি তখন নির্বাচন করেছে, কিন্তু ছাড় পায়নি তারাও। সরকারের বিরুদ্ধে তারা প্রকাশ্যে এই অভিযোগগুলো করে হতাশা প্রকাশ করেছিল।

মোদ্দা কথা হলো, একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য একটি ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ অত্যাবশ্যক। প্রশ্ন হচ্ছে আগামীর নির্বাচনটি কীভাবে হচ্ছে, নির্বাচনকালীন সরকার কী হবে, বিরোধী দলের আস্থা অর্জন করা যাবে কী করে ইত্যাদি নিষ্পত্তি হওয়া ছাড়া ইভিএম নিয়ে আলাপ তোলা মানে মানুষের মনোযোগ ভিন্ন দিকে পরিচালিত করা। সরকারি দলের পক্ষ থেকে সুকৌশলে এই আলোচনা মাঠে ছাড়া হয়েছে এবং ‘স্বাধীন’ নির্বাচন কমিশন তার যাবতীয় আলোচনা এখন এই ইভিএমে এনে ঠেকিয়েছে। তাই এখন পত্রিকার সংবাদে, কলামে, টিভি টকশোতে এই ইভিএমই অতি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বলা বাহুল্য, এই আলোচনা অর্থহীন।    

ইভিএমের বিষয়ে সরকারি এবং বিরোধী দলের বয়ান সরিয়ে রেখে দেখি এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা কী বলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে যখন ইভিএমে ভোট নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে তখন বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশে ইভিএমের উদ্ভাবক হিসেবে পরিচিত জনাব লুৎফুল কবীর বলেছিলেন, ইভিএম মেশিনে দুটি প্রধান ঝুঁকি আছে। এক, মেশিনটি চাইলে এমনভাবে প্রোগ্রাম করা সম্ভব যে নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যক ভোটের পর বাকি সব ভোট এক প্রতীকেই জমা হবে। হয়তো ভোটার দেখবে সে তার পছন্দের প্রতীকে ভোট দিয়েছে, কিন্তু আসলে তা হবে না। দুই, ইভিএম মেশিনে ভোটার ভ্যারিয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল বা ভিভিপিএটি নেই। একজন ভোটার ভোট দেওয়ার পর তার কাছে একটা প্রিন্টেড স্লিপ আসতো, যাতে কোনও কারণে ভোট পুনঃগণনার প্রয়োজন হলে এটি কাজে লাগতো।

এছাড়াও বিশ্বের বহু উন্নত দেশ ইভিএমে ভোটের প্রচলন করে কারচুপি, হ্যাকিং, অনিয়ম ইত্যাদি নানান অভিযোগে সেখান থেকে সরে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের কিছু রাজ্যে ইভিএম মেশিন ব্যবহার করলেও বড় রাজ্য ক্যালিফোর্নিয়াসহ অধিকাংশ রাজ্যে এর ব্যবহার অবৈধ ও নিষিদ্ধ। আয়ারল্যান্ডে ইভিএম ব্যবহারের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে ৫১ মিলিয়ন ইউরো খরচ করে অবশেষে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়েছে। জার্মানির সুপ্রিম কোর্ট একে অসাংবিধানিক ও জনস্বার্থবিরোধী বলে ঘোষণা করেছে। ইতালি ও প্যারাগুয়েতে ইভিএম নিষিদ্ধ। কারণ, এর দ্বারা ফল পরিবর্তন সম্ভব। হল্যান্ডে স্বচ্ছতার অভাবের কারণে ইভিএম নিষিদ্ধ করেছে ডাচ কাউন্সিল। যুক্তরাজ্য ব্যাপক পরীক্ষা করে এটি নিষিদ্ধ করে। সুইজারল্যান্ড, রুমানিয়া, স্পেন, নরওয়েতে সিকিউরিটি সমস্যা ও গোপনীয়তা নষ্টের কারণে ইভিএম নিষিদ্ধ। ভারতব্যাপী বিরোধী দলগুলো ইভিএম বাতিলে সোচ্চার। ভারতের সংসদে ওপেন প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে কী করে ইভিএম দিয়ে ফল পরিবর্তন সম্ভব।

সত্যি বলতে নির্বাচন কমিশন যদি ইভিএম বাদ দিয়ে ব্যালটে ভোট নেওয়ার কথা ঘোষণা করে, তবু বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। একই ধরনের মতামত আছে অপরাপর বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোরও। বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দল যদি নির্বাচন বর্জন করে তাহলে আবারও ২০১৪ সালের মতোই একতরফা একটা নির্বাচন সম্ভবত হতে যাচ্ছে। সেটি কি আমাদের ভবিষ্যৎ রাজনীতি এবং দেশের সার্বিক পরিস্থিতির জন্য সুখকর কিছু হবে? সেটি যদি না হয় তাহলে বিরোধী দলকে নির্বাচনে আনার জন্য কী ভাবছে সরকার? আদৌ কিছু ভাবছে কি? নাকি ‘উইনার এফেক্টে’ ভোগা সরকার মনে করছে পরিস্থিতি যাই হোক না কেন ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতোই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা, মধ্যরাতের ভোটের কৌশলের মতো নতুন কোনও কৌশল আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় থেকে যেতে পারবে তারা?

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ও বিএনপি দলীয় হুইপরুমিন ফারহানা *** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

Leave a Reply

Your email address will not be published.