কসবা হারিয়ে যাচ্ছে বাবুই পাখি ও তার বাসা

ভজন শংকর আচার্য্য কসবা (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি ।। দেশের এক সময়ের নজরকাড়া বাবুই পাখিকে নিয়ে কবির ‘স্বাধীনতার সুখ’ কবিতাটি আজও মানুষ উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করলেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় হারিয়ে যাচ্ছে বাবুই পাখি ও তার বাসা। বাবুই পাখির বাসা আজ অনেকটা স্মৃতির অন্তরালে বিলীন হতে চলেছে। অথচ আজ থেকে প্রায় ১৫-১৬ বছর আগেও গ্রাম-গঞ্জে মাঠে-ঘাটের তালগাছে দেখা যেত বাবুই পাখির নিপুণ কারু খচিত বাসা।

কবিতার মতোই এক সময় গ্রামের তালগাছ, খেজুরগাছ কিংবা নারিকেলগাছে বাবুই পাখির স্বাধীন বিচরণের জন্য নান্দনিক বাসা দেখা যেত।  ঝাকে ঝাকে বাবুই পাখি উড়ে যেত। আবার বাসায় বসে বাবুই পাখি কিচির মিচির শব্দ করতো। কিন্তু এমন দৃশ্য বর্তমানে বিরল। স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার পরিবেশ দিন দিন সঙ্কুচিত হচ্ছে বাবুই পাখির জন্য। ফলে প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে শিল্পী বাবুই পাখি

অনেকে বলছেন,কসবায়  কয়েকটি গ্রামে দু-একটি তালগাছে এদের বাসা ও বিচরণ থাকলেও আগের মতো আর নেই। তারা বলছেন, কয়েক বছর আগেও গ্রাম কিংবা শহরেও সড়কে পাশে তালগাছে এদের শৈল্পিক বাসা ও বিচরণ দেখা যেত। তালগাছ কমে যাওয়ায় এদের বিচরণও কমে গেছে।

শিল্পী, স্থপতি ও সামাজিক বন্ধনের কারিগর বাবুই পাখি খড়, তালপাতা, ঝাউ ও কাঁশবনের লতাপাতা দিয়ে সাধারণত উঁচু তালগাছে বাসা বাঁধে। শৈল্পিক এসব বাসা দেখতে যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি মজবুত। প্রবল ঝড়েও এদের বাসা ছিঁড়ে পড়ে না। বাবুই পাখির শক্ত বুননের এ বাসাটি শিল্পের এক অনন্য সৃষ্টি, যা টেনেও ছেড়া অসম্ভব প্রায়।

বাবুই পাখি সাধারণত বিভিন্ন ফসলের বীজ, ধান, বিভিন্ন প্রজাতির পোকা, ঘাস, ছোট উদ্ভিদের পাতা, ফুলের মধু ও রেনু প্রভৃতি খেয়ে জীবনধারণ করে।

পুরুষ বাবুই পাখি বাসা তৈরি করে। পর সঙ্গী খুঁজতে যায় অন্য বাসায়। সঙ্গী পছন্দ হলে স্ত্রী বাবুইকে বিভিন্নভাবে ভালোবাসা নিবেদন করে করে পুরুষ পাখিটি। বাসা তৈরির কাজ অর্ধেক হলে কাঙ্ক্ষিত স্ত্রী বাবুইকে ওই বাসা দেখায়। বাসা পছন্দ হলে কেবল সম্পর্ক গড়ে ওঠে। স্ত্রী বাবুই পাখির বাসা পছন্দ হলে বাকি কাজ শেষ করতে পুরুষ বাবুই পাখির সময় লাগে চার দিন। স্ত্রী বাবুই পাখির প্রেরণা পেয়ে পুরুষ বাবুই মনের আনন্দে শিল্পসম্মত ও নিপুণভাবে বিরামহীনভাবে বাসা তৈরির কাজ শেষ করে। প্রেমিক বাবুই যত প্রেমই দেখাক না কেন, প্রেমিকা ডিম দেয়ার সাথে সাথেই প্রেমিক বাবুই আবার খুঁজতে থাকে অন্য সঙ্গী। পুরুষ বাবুই এক মৌসুমে ছয়টি বাসা তৈরি করতে পারে।

আউশ ও আমন ক্ষেতের ধান পাকার সময় হলো বাবুই পাখির প্রজনন মৌসুম। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়ার পরপরই বাচ্চাদের খাওয়ানোর জন্য স্ত্রী বাবুই ক্ষেত থেকে দুধ ধান সংগ্রহ করে। এভাবেই বাবুই পাখির জীবনচক্র আবর্তিত হয়।

বর্তমানে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে গ্রামাঞ্চল থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে প্রকৃতির এক অপরূপে সৃষ্টি বাবুই পাখি। অথচ এক যুগ আগেও সর্বত্র চোখে পড়ত বাবুই পাখি। এখন আর সারিবদ্ধ তালগাছের পাতায় ঝুলতে দেখা যায় না তাদের শৈল্পিক বাসা। শোনা যায় না কিচির মিচির শব্দ। নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন, কীটনাশকের ব্যবহার, শিকারিদের দৌরাত্ম্য, অপরিকল্পিত বাড়িঘর নির্মাণে মানব বসতি বাড়ায় ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে এ পাখি বিলুপ্ত হতে বসেছ কসবা উপজেলার  বিনাউটি ইউনিয়নের সৈয়দাবাদ গ্রামের পাখি প্রেমিক মো এনামুল  হক খান বলেন, ‘বাবুই পাখির বিচরণ ধরে রাখার জন্য সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার।যেহেতু এ পাখি মানুষের খুব নাগালে বাসা বোনে, তাই মানুষের সচেতনতাই পারে এ পাখির বংশ টিকিয়ে রাখতে। দিন দিন বাবুই পাখির সংখ্যা এতটাই কমে যাচ্ছে হয়তো অদূর ভবিষ্যৎতে বাবুই পাখি চোখেই পড়বে না। তাই প্রকৃতির সৌন্দর্য ধরে রাখতে আমাদের সচেতন হতে হবে। গড়ে তুলতে হবে সামাজিক ঐক্য। পাখি শিকার এবং অকারণে গাছ কেটে ফেলা থেকে বিরত থাকতে হবে। আমরা সচেতন হলে প্রকৃতির কোনো কিছুই আর হারিয়ে যাবে না। তালগাছ রোপন করলে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকবে। এতে অতীতের মতো বাবুই পাখিও বাসা বাঁধবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.