রাশিয়া লজ্জিত নয়: বিবিসিকে ল্যাভরভ

প্রশান্তি ডেক্স॥ গতরাশিয়া ধোয়া তুলসি পাতা নয়। রাশিয়া যা সেটাই। আর নিজের চেহারা দেখাতে আমরা লজ্জাবোধ করি না। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম বিবিসির সঙ্গে আলাপকালে এমন মন্তব্য করেছেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ।

প্রায় চার মাস আগে ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত প্রাণ গেছে হাজার হাজার বেসামরিক মানুষের। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে বহু এলাকা। নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে লাখ লাখ ইউক্রেনীয়। এমন বাস্তবতায় গত বৃহস্পতিবার বিবিসির মুখোমুখি হন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ। বললেন, যেমনটা মনে হচ্ছে বাস্তবতা আসলে তেমন নয়।

রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ইউক্রেন আক্রমণ করিনি। আমরা একটি বিশেষ সামরিক অভিযান ঘোষণা করেছি। কেননা, ইউক্রেনকে ন্যাটোতে টেনে নেওয়া একটি অপরাধমূলক কাজ; আমাদের কাছে পশ্চিমাদের এটা বোঝানোর কোনও উপায় ছিল না।’

ইউক্রেনে নব্য নাৎসিবাদের উপস্থিতির রুশ দাবিরও পুনরাবৃত্তি করেন সের্গেই ল্যাভরভ। রাশিয়ান কর্মকর্তারা প্রায়ই দাবি করেন যে, তাদের সামরিক বাহিনী ইউক্রেনকে নাৎসিমুক্ত করার কাজ করছে।

গত মে মাসে ইতালির একটি টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ল্যাভরভকে প্রশ্ন করা হয়, ইউক্রেনকে কেন রাশিয়া ‘নাৎসি’ হিসেবে চিত্রিত করছে- যেখানে দেশটির প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি হচ্ছেন একজন ইহুদি। জবাবে ল্যাভরভ বলেন, এতে কিছু আসে যায় না। প্রেসিডেন্ট ইহুদি হলেই যে ইউক্রেনে নাৎসিরা নেই এটা প্রমাণ হয় না। তিনি বলেন, ‘আমার ভুল হতে পারে, কিন্তু হিটলারেরও দেহেও ইহুদি রক্ত ছিল। জ্ঞানী ইহুদিরা বলেন যে, সবচেয়ে কড়া অ্যান্টি-সেমিটরাও সাধারণত ইহুদি হয়ে থাকে।’ পরে অবশ্য সমালোচনার মুখে নিজ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন মন্তব্যের জন্য ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেটের কাছে ক্ষমা চান রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।

গত বৃহস্পতিবার চেরনিহিভ অঞ্চলের ইউক্রেনীয় গ্রাম ইয়াহিদনে সম্পর্কে জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু সম্পর্কে ল্যাভরভের মন্তব্য জানতে চান বিবিসির স্টিভ রোজেনবার্গ। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, রুশ বাহিনী ৩৬০ জন মানুষকে ইয়াহিদনের একটি স্কুলের বেসমেন্টে থাকতে বাধ্য করেছিল। যাদের মধ্যে ৭৪টি শিশু এবং পাঁচ জন প্রতিবন্ধী ছিলেন। এমনকি সেখানে কোনও টয়লেট সুবিধা পর্যন্ত ছিল না। পানির ব্যবস্থা ছিল না। সেখানে ১০ জন বয়স্ক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।’

জাতিসংঘের এই প্রতিবেদন তুলে ধরে বিবিসির স্টিভ রোজেনবার্গ জানতে চান, এটিই কী তাহলে নাৎসিবাদের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ? জবাবে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। কিন্তু জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার, জাতিসংঘ মহাসচিব এবং সংস্থাটির অন্যান্য প্রতিনিধিসহ আন্তর্জাতিক কূটনীতিকরা পশ্চিমাদের চাপের মধ্যে রয়েছে। প্রায়ই তারা পশ্চিমাদের ছড়ানো ভুয়া খবরকে আরও ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।’

গত ১৮ বছর ধরে আন্তর্জাতিক মঞ্চে রাশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেছেন ৭২ বছরের সের্গেই ল্যাভরভ। তবে তিনি নিজে এবং তার কন্যা উভয়েই এখন পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছেন।

রাশিয়ার অবন্ধুসুলভ দেশগুলোর সরকারি তালিকায় নাম রয়েছে যুক্তরাজ্যের। রুশ-ব্রিটিশ সম্পর্কের দিকে ইঙ্গিত করে বিবিসির স্টিভ রোজেনবার্গ বলেন, সম্পর্ক খারাপ বলাটা আসলে এক ধরনের অবমূল্যায়ন।

উত্তরে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “আমি মনে করি না যে, এখানে আর কোনও কৌশল অবলম্বনের সুযোগ আছে। কারণ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাস উভয়েই প্রকাশ্যে বলেছেন যে, ‘আমাদের রাশিয়াকে হারাতে হবে, আমাদের রাশিয়াকে তার হাঁটু গেঁড়ে বসতে বাধ্য করা উচিত।’ ঠিক আছে, তাহলে সেটাই করুন।”

গত মাসে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ভ্লাদিমির পুতিন বিশ্বমঞ্চে নিজেকে অপমান করছেন এবং ‘আমাদের অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে তিনি ইউক্রেনে পরাজয়ের মুখোমুখি হয়েছেন।’ এখন যুক্তরাজ্যকে কীভাবে দেখেন? বিবিসির এমন প্রশ্নের উত্তরে ল্যাভরভ বলেন, যুক্তরাজ্য তার ‘রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের জন্য আরও একবার নিজের জনগণের স্বার্থকে বিসর্জন দিচ্ছে।’

সম্প্রতি অধিকৃত পূর্ব ইউক্রেনে রুশ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই ব্রিটিশ নাগরিক সম্পর্কেও জানতে চান স্টিভ রোজেনবার্গ। তিনি বলেন, পশ্চিমাদের দৃষ্টিতে এই দণ্ডপ্রাপ্তদের পরিণতির জন্য রাশিয়াই দায়ী। জবাবে সের্গেই ল্যাভরভ বলেন, পশ্চিমারা কোন চোখে দেখছে সেটা নিয়ে তিনি মোটেই আগ্রহী নন। তার ভাষায়, ‘আমি শুধু আন্তর্জাতিক আইনের বিষয়ে আগ্রহী। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, ভাড়াটে সেনারা যোদ্ধা হিসাবে স্বীকৃত নয়।’

তাহলে যারা ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত ছিল এবং কোনও ভাড়াটে সেনা ছিল না, তাদের কী হবে? জবাবে ল্যাভরভ বলেন, এই ব্যাপারে আদালতের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।

পূর্ব ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বেসামরিক নাগরিকদের সঙ্গে কী ঘটছে তার সত্যতা উন্মোচন না করার জন্য বিবিসিকে অভিযুক্ত করেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তার অভিযোগ, আট বছর ধরে অঞ্চলটির বেসামরিক নাগরিকদের ওপর বোমাবর্ষণ করে আসছিল ইউক্রেনীয় সেনারা।

এমন অভিযোগের জবাবে স্টিভ রোজেনবার্গ বলেন, গত ছয় বছরে বিবিসি বহু বার বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ন্ত্রিত এলাকার নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। সেখানে কী ঘটছে সেটা সরেজমিনে গিয়ে দেখার অনুমতি চেয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তরফে বিবিসিকে না করে দেওয়া হয়েছে।

ইউক্রেনের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনেছে রাশিয়া। ২০২১ সালে স্বঘোষিত রুশপন্থী ‘কর্মকর্তারা’ দাবি করেন, বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় আট জন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। তার আগের বছরও সাত জন নিহত হয়েছেন। স্টিভ রোজেনবার্গ বলেন, যদিও প্রতিটি মৃত্যুই একটি ট্র্যাজেডি, তবে এটি কোনও গণহত্যা নয়। আর যদি সত্যিই সেখানে গণহত্যা সংঘটিত হতো, তবে লুহানস্ক এবং ডোনেস্কের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বিবিসিকে সেখানে প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী হতো। কিন্তু কেন বিবিসিকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি? উত্তরে ল্যাভরভ বলেন, ‘আমি জানি না।’

উল্লেখ্য, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নির্দেশে ইউক্রেনে কথিত বিশেষ সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া। এই অভিযানকে অবৈধ অ্যাখা দিয়ে পুতিন ও তার ঘনিষ্ঠজনদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। গত ১৪ জুন প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে রুশ প্রেসিডেন্টের দফতর ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ স্বীকার করেছেন, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ধকল কাটানো সহজ নয়। তিনি বলেন, পশ্চিমাদের যেসব পদক্ষেপ রাশিয়ার অর্থনীতিকে বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে সেগুলো ছিল কঠিন। তবে তাদের এসব পদক্ষেপ মস্কোকে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ দেশগুলোর দিকে আরও ঠেলে দিচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.