কমছে অর্ডার, কী হবে তৈরি পোশাক খাতে?

প্রশান্তি ডেক্স॥ সদ্য বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ ৫ হাজার ২০৮ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হলেও আগামী অর্থবছরে রফতানি আয় কমে যেতে পারে। ইতোমধ্যে রফতানি অর্ডার কমতে শুরু করেছে। গার্মেন্টস খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় পোশাক না কেনার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। এছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অব্যাহত থাকার পাশাপাশি করোনার নতুন ঢেউয়ের কারণেও শঙ্কা বাড়ছে দেশের উদ্যোক্তাদের মধ্যে। এর সঙ্গে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা তো রয়েছেই।

অনেকেই বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় সার্বিকভাবে একটি অনিশ্চিত পরিস্থিতির দিকে যেতে হচ্ছে গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের। ইতোমধ্যে পশ্চিমা ভোক্তারা তাদের ব্যক্তিগত খরচেও বেশি হিসেবি হয়ে উঠেছেন। যে কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে ওয়ার্ক অর্ডারের সংখ্যা ২০ শতাংশের মতো কমেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক উৎপাদক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, আন্তর্জাতিক খুচরা পোশাক বিক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলো মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত যে পরিমাণ অর্ডার দিয়েছিল, সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত তারচেয়ে ২০ শতাংশ কম অর্ডার দিয়েছে। সেখানকার ক্রেতাদের কাছে আগের মতো পণ্য বিক্রি করতে পারছে না খুচরা বিক্রেতারা।

তিনি আরও উল্লেখ করেন, ভোক্তারা আগের চেয়ে বেশি দামে জ্বালানি ও খাবার কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে তারা পোশাকের বাজেট কমিয়েছেন।

তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে গ্যাসের দাম প্রায় তিনগুণ বেড়েছে। জ্বালানি ও খাদ্যে খরচ বাড়ায় বাংলাদেশের মতো তৈরি পোশাক সরবরাহকারী দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ফারুক হাসান উল্লেখ করেন, আসন্ন বসন্ত ও গ্রীষ্মে মৌসুমে ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন (ইউডি) কমেছে ২০ শতাংশের মতো।

এদিকে বড় ক্ষতির আশঙ্কা করছেন ওইসব কারখানার মালিক, যারা সম্প্রতি অতিরিক্ত সক্ষমতা নিয়ে কাজ করছিলেন। অনেক কারখানাই আকার বাড়িয়েছিল। ডাবল-শিফটও চালু করেছিল অনেকে। সেসব কারখানা পড়তে পারে বেশি বিপাকে।

বিকেএমইএ সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, আমার কারখানা এখন আগের চেয়ে ১৬ শতাংশ কম অর্ডার পাচ্ছে।

কার্যাদেশ কমে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, আসন্ন বসন্ত ও গ্রীষ্মে ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন (ইউডি) ৩০ শতাংশ। চার মাস আগের তুলনায় এনকোয়ারি ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। একমাস পরও একই পরিস্থিতি দেখা যেতে পারে।

এদিকে পরিসংখ্যান বলছে, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে শুরু করে এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি রফতানি করে। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গত মে মাসে এই ধারা অব্যাহত থাকেনি। এপ্রিলের ৩ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার থেকে মে মাসে তৈরি পোশাকের চালানের পরিমাণ কমে ৩ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার হয়।

এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের রফতানি কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স, বাংলাদেশ (আইসিসিবি)। সংগঠনটির প্রকাশিত ত্রৈমাসিক বুলেটিনের সম্পাদকীয়তে এই উদ্বেগের কথা জানানো হয়েছে।

সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করা হয়েছে, করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত হওয়ার ফলে বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এতে পণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব এখন দারুণ মানবিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশের গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের বেশ ভাবাচ্ছে। এরইমধ্যে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। জাহাজ ভাড়া বেড়েছে। কাঁচামালের দামও বেড়েছে।

তিনি আরও উল্লেখ করেন, ইউরোপে এবার ২৫ বছরের সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। আমেরিকায় ৪০ বছরের সর্বোচ্চ। এছাড়া জ্বালানি তেল থেকে শুরু করে সবকিছুর দামই ঊর্ধ্বমুখী। প্রতিদিনই প্রডাকশন কস্ট বাড়ছে। দুদিক দিয়ে বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টরে বিপদ লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রথমত, গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের পোশাক তৈরিতে খরচ বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, চাহিদা কমেছে।

তিনি বলেন, মানুষ এখন জীবিকা নিয়েই হিমশিম খাচ্ছে। বায়াররা তাদের কাস্টমারদের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে না, সব চাপাচ্ছে আমাদের ওপর। এতে আমাদের খরচ বাড়লেও দাম বেশি পাচ্ছি না।

মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ইতোমধ্যে অর্ডার কমতে শুরু করেছে। সামনে আরও কমার আশঙ্কা আছে। বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির কারণে করোনা পরবর্তী যে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল সেটা ধরে রাখা কঠিন হবে। কারণ, মানুষের মধ্যে না কেনার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। মার্কেটে না যাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, আমাদের কাছে বড় আতঙ্কের বিষয় হলো ইউরোপের দেশগুলোর অর্ডার কমে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী মন্দা যেভাবে বাড়ছে তাতে অর্ডার আরও কমলে কিছুই করার থাকবে না।

এদিকে ইউরোরও ক্রমাগত দরপতন হচ্ছে। এতেও দুশ্চিন্তায় পড়েছেন দেশের ব্যবসায়ীরা। অনেকেই বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ইউরোর অব্যাহত দরপতনও বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের। কারণ, বাংলাদেশের রফতানির বড় বাজার ইউরোপ। ইউরো দুর্বল হতে থাকলে ইউরোপের দেশগুলো আমদানি কমিয়ে দিতে পারে কিংবা পণ্যের দাম কমিয়ে দিতে পারে।

এ প্রসঙ্গে তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, ইউরোর ক্রমাগত দরপতন হতে থাকলে ইউরোপের আমদানি ব্যয় বাড়বে। বাধ্য হয়ে তারা পণ্যের দাম কম দিতে চাইবে, অথবা আমদানি কমিয়ে দেবে।

উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছরে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৬৭ বিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করেছে সরকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published.