কাগজপত্র ছাড়া এত গাড়ি রাস্তায়?

প্রশান্তি ডেক্স প্রতিবারই সড়ক দুর্ঘটনার পর বেরিয়ে আসে ফিটনেসবিহীন গাড়ি কিংবা চালকের লাইসেন্স না থাকার বিষয়টি। সড়কে নজরদারির দায়িত্ব যাদের, তাদের গাফিলতি ও অপতৎপরতার কারণেই মূলত দুর্ঘটনা ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। এমনটা বলেছেন যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দূরপাল্লার বিভিন্ন বাসের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা কাজ করে। যেখানে সেখানে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠানোর কারণে অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটে। আবার ফিটনেস না থাকলে কিংবা চালক অদক্ষ হলেও দেখা যায় তারা বেপরোয়া হয়ে যায়। এতে যত্রতত্র ওভারটেকের প্রবণতা বাড়ে ও দুর্ঘটনা ঘটে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআরটিএ বলছে, যানবাহনের ফিটনেস লাইসেন্স কিংবা চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার পাশাপাশি সড়কে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়। এ নজরদারিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করে। তারাই বলতে পারবেন কীভাবে রাস্তায় চলে ফিটনেসবিহীন গাড়ি কিংবা লাইসেন্সবিহীন চালক।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়কে মৃত্যুর মিছিল কমাতে সচেতন হতে হবে। শুধু জরিমানা কিংবা মামলা করে সড়ক নিরাপদ করা সম্ভব নয়।

গত ১৬ জুলাই ত্রিশালে স্বামী-স্ত্রী নিহতের ঘটনায় গ্রেফতারকৃত ট্রাক চালককে জিজ্ঞাসাবাদে র‌্যাব জানতে পারে গাড়িটির ফিটনেস ছিল না। এর আগে ২ জুলাই রাজধানীর গুলিস্তানে মঞ্জিল এক্সপ্রেস পরিবহনের দুই বাসের প্রতিযোগিতায় প্রাণ হারান মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর মোল্লা। চালক আলমগীরকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে র‌্যাব জানতে পারে ড্রাইভিং লাইসেন্সই ছিল না তার।

এর আগে ২ জুন রাজধানীর বাংলামোটর মোড়ে ওয়েলকাম ট্রান্সপোর্ট প্রাইভেট লিমিটেডের একটি বাস মোটরসাইকেল আরোহী কনস্টেবল কোরবান আলীকে চাপা দিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় বাস মালিক ও চালককে গ্রেফতারের পর জানা যায় রাজধানীতে চলাচলের পারমিট ছিল না বাসটির।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য বলছে, ৩ জুলাই থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত ১৫ দিনে ৩১৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৯৮ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৭৭৪ জন। গত সাত বছরের তুলনায় কোনও ঈদুল আজহায় এত প্রাণহানি ঘটেনি।

যদিও এ বছর সড়কে মোটরসাইকেল চালানোয় ছিল বিধি-নিষেধ ছিল, তবু সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেলই ছিল এগিয়ে। ১১৩টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১৩১ জন। আহত ৬৮ জন। যা সড়ক দুর্ঘটনার ৩৫.৪২ শতাংশ। নিহতের প্রায় ৩২.৯১ শতাংশ।

পরিসংখ্যানে আরও দেখা যায় যানবাহনের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২৩.১৯ শতাংশ, পথচারীকে চাপা দেওয়ার ঘটনা ৫০.৭৮ শতাংশ, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ার ঘটনা ছিল ১৮.৪৯ শতাংশ। মোট দুর্ঘটনার ৩২.৯১ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে এবং ৪৬.৭০ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে হয়েছে।

যাত্রী কল্যাণ সমিতি মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, উল্টোপথে যানবাহন চলাচল এবং সড়কে চাঁদাবাজির কারণেও পণ্যবাহী যানে দুর্ঘটনা ঘটে।‌ এছাড়া, বেপরোয়া গতি, জাতীয় মহাসড়কে রোড সাইনে সড়ক বাতি না থাকাতেও ঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন। এসব বন্ধ করতে রাজনৈতিক সদিচ্ছার দরকারও আছে বলে মনে করেন মোজাম্মেল হক।

মহাখালী বাস টার্মিনালের সাধারণ সম্পাদক ও পরিবহন মালিক আবুল কালাম বলেন, দুর্ঘটনার পর জানা যায় রোড পারমিট বা ফিটনেস ছিল না। প্রশ্ন হলো এত কিছু ছাড়া গাড়িগুলো চলে কীভাবে? কারা এর সুবিধাভোগী?

মহাখালী টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লার যেসব গাড়ি ছেড়ে যায় সেগুলোর কাগজপত্র ঠিক রয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, কাগজপত্র ছাড়া গাড়ি চলার কারণে আমাদের ব্যবসায়িক ক্ষতিও হচ্ছে।

বুয়েটের দুর্ঘটনা রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক সাইফুন নেওয়াজ বলেন, রাস্তায় বিভিন্ন ধরনের ‘খরচ’ মিটিয়ে একজন চালক নিজের পাওনা ও মালিকের পাওনা ওঠাতে প্রায়েই বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এটাও দুর্ঘটনার বড় কারণ।

হাইওয়ে পুলিশ গাজীপুর রিজিয়ন পুলিশ সুপার আলী আহমদ খান বলেন, ‘আমরা প্রতিনিয়ত ফিটনেস ও লাইসেন্স চেক করছি। প্রতিটি গাড়ি চেক করা সম্ভব নয়। তবে অভিযান চলছে। প্রতিমাসে গাজীপুর রিজিওনে প্রায় ৫০ লাখ টাকার বেশি জরিমানা আদায় ও মামলা করা হচ্ছে।’

বিআরটিএ পরিচালক রোড সেফটি শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী বলেন, আমরা যাচাই বাছাই করে যানবাহনের রুট পারমিট, ফিটনেস সার্টিফিকেট এবং চালকের লাইসেন্স দিয়ে থাকি। আমাদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা বিভিন্ন জায়গায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন। তবে গাড়ির পারমিট, ফিটনেস সার্টিফিকেট ও চালকের লাইসেন্স রয়েছে কিনা তা দেখভালের দায়িত্ব পুলিশের।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশন-এর নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, গণপরিবহন খাতে যতদিন না আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত না, ততদিন সড়কে প্রাণ ঝরতেই থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.