উন্নয়ন নিয়ে বিশ্বকে বাংলাদেশ যা শেখাতে পারে

প্রশান্তি ডেক্স॥ ১৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ছাপা হচ্ছে ব্রিটিশ পত্রিকা ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস। এতে পত্রিকাটির সাবেক এশিয়া বিষয়ক ও বর্তমান আফ্রিকা বিষয়ক সম্পাদক ডেভিড পাইলিং-এর একটি নিবন্ধ প্রকাশ হয়েছে গত বৃহস্পতিবার (২৮ জুলাই)। ওই প্রতিবেদনই বলে দেয়, বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ও কৌশল এখন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষণের দাবি রাখে। দুই জাঁদরেল অর্থনীতিবিদের বরাত দিয়ে ডেভিড পাইলিং তুলে ধরেছেন সোজা-সাপ্টা কিছু পরিসংখ্যান ও তুলনামূলক চিত্র।

ডেভিড তার প্রতিবেদন শুরু করেছেন একটি প্রশ্ন দিয়ে- মাথাপিছু আয় ৫০০ ডলারের কম, একেকটি পরিবারে গড়ে সাড়ে ৪টি করে সন্তান এবং ৪৪ শতাংশ জনগণ দারুণ দারিদ্র্যে বাস করছে; বলুন তো দেশটার নাম কী? উত্তর- বাংলাদেশ। তবে সেটা ১৯৯০ সালের বাংলাদেশ।

আর এখন? মাথাপিছু আয় বেড়েছে আট গুণ। পরিবারে গড়ে সন্তান আছে দুটো করে (মানে সন্তানদের শিক্ষা-স্বাস্থ্যে আগের চেয়েও বেশি খরচ করা যাচ্ছে)। এখন দেশটির ব্যাংকগুলোর কাছেও বেশি টাকা আছে। যে টাকা শিল্প-কারখানায় বার বার বিনিয়োগ করা যাচ্ছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা মানুষও নেমেছে অর্ধেকে।

বিশেষ করে বাংলাদেশের নারীদের অবস্থার উন্নয়ন হয়েছে দারুণ। এখন মাধ্যমিক পর্যায়ে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা পড়ছে বেশি।

১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়, তখন পাঁচ বছরের নিচে শিশুমৃত্যুর হার ছিল পাঁচ জনে একজন। এখন তা কমে ৩০ জনে একজনে দাঁড়িয়েছে।

তবে অতিরঞ্জিত না করে বলা যায় যে বাংলাদেশ এখনও দরিদ্র দেশ। এখনও এ দেশে আছে রাজনৈতিক অস্থিরতা, পরিবেশ দূষণ ও দুর্নীতি। আবার গত সপ্তাহেই দেশটি আইএমএফ-এর কাছে মাল্টিবিলিয়ন ডলারের ঋণ চেয়েছে। তবে দূর-দৃষ্টিতে দেখুন- একসময় ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে উপেক্ষা করা দেশটি এখন উন্নয়নে সফল।

উন্নয়নের উদাহরণ কিংবা ছাঁচ হিসেবে বাংলাদেশের নাম সেভাবে নেওয়া না হলেও আফ্রিকার অনেক দেশের জন্য দেশটি রীতিমতো শিক্ষণীয়। উন্নয়নের কথা বললে, লোকে এখনও সিঙ্গাপুর আর সাউথ আফ্রিকার নাম নেয় বেশি। তবে আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশ কিন্তু সেই বিচারে বাংলাদেশের ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারেনি।

মুডিসের আস্থা : বিশ্বের শীর্ষ ক্রেডিট রেটি সংস্থা মুডি’স বলেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চাপ বাড়ছে। তবু খেলাপি হওয়ার ঝুঁকি কম। বৃহস্পতিবার (২৭ জুলাই) মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে এ খবর জানা গেছে।

মুডিসের হিসাবে বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং এখন ‘বিএ-৩’। যার আরেকটি অর্থ হলো ‘ইনভেস্টমেন্ট গ্রেড’। অর্থাৎ, বাংলাদেশ বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত এবং ঋণ পরিশোধে সক্ষম দেশ।

মুডি’স এর বিশ্লেষক ক্যামিল চৌটার্ড বলেন, ‘যদিও বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সম্প্রতি কমেছে তারপরও দেশটির বাহ্যিক দুর্বলতার সূচকে ঝুঁকি কম।’

ব্লুমবার্গের ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বর্তমান রিজার্ভকে তুলনামূলক শক্তিশালী দেখানো হয়েছে। তারা বলছে, বাংলাদেশের ৩৯ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানের আছে মাত্র ৮ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার।

এছাড়া, বাংলাদেশ নিয়ে এস অ্যান্ড পি’র ক্রেডিট রেটিং এখনও ‘বিবি’ যার মানে হলো ‘স্থিতিশীল’ (পাকিস্তানের বি মাইনাস)।

আবার ফিচ নামের আরেকটি আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং সংস্থাও বাংলাদেশকে ‘স্ট্যাবল’ তথা স্থিতিশীল রেটিং দিয়েছে।

উন্নয়নের তিন মন্ত্র  : ডেভিড পাইলিংয়ের প্রতিবেদনে জানা গেলো, অক্সফোর্ডের উন্নয়ন বিষয়ক অর্থনীতিবিদ স্টেফার ডারকন বাংলাদেশের এমন উন্নয়নের পেছনে তিনটি ফ্যাক্টরের কথা বলেছেন। প্রথমে আছে তৈরি পোশাক। ১৯৮৪ সালে যে খানে রফতানি আয় ছিল ৩ কোটি ২০ লাখ ডলার, ২০২০ সালে তা হয়েছে ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। ব্যাপারটা তুলনা করতে গিয়ে ডারকন বলেছেন, আফ্রিকার ৫৪টি দেশে যে পরিমাণ তৈরি পোশাক রফতানি করছে, বাংলাদেশ একাই তারচেয়ে দ্বিগুণ আয় করছে।

দ্বিতীয়ত হলো প্রবাসীদের আয়। গত বছর যা ছিল ২২ বিলিয়ন ডলার। আর তিন নম্বরে বাংলাদেশের কিছু বড় বড় এনজিওর অবদানের কথা বলেছেন ডারকন।

লন্ডন ভিত্তিক বৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠান রেনেসাঁ ক্যাপিটালের প্রধান অর্থনীতিবিদ চার্লি রবার্টসনের নজরেও এড়ায়নি বাংলাদেশের উন্নয়ন। তিনি বের করেছেন ভিন্ন তিনটি কারণ। তিনি তার বই ‘দ্য টাইম ট্রাভেলিং ইকনোমিস্ট’ এ বাংলাদেশের উন্নয়নের নেপথে তিনটি ফ্যাক্টরের কথা বলেছেন- শিক্ষা, বিদ্যুৎ ও জন্মনিয়ন্ত্রণ। তার মতে, শিল্পে উন্নত হতে হলে প্রথমেই স্বাক্ষরতার হার হতে হবে ৭০ ভাগের বেশি, মাথাপিছু বিদ্যুৎ সরবরাহ চাই ৩০০ কিলোওয়াট-ঘণ্টা এবং পরিবারপ্রতি সন্তান থাকতে হবে ৩ জনের কম। বাংলাদেশ এ তিন পরীক্ষাতেই পাস করেছে।

অনেক আফ্রিকান দেশে স্বাক্ষরতার হার ৭০ ভাগের বেশি। এর মানে হলো তাদের কারখানার জন্য রেডিমেড শ্রমিক আছে। কিন্তু সেখানকার বেশিরভাগ দেশই প্রতিযোগিতামূলক দরে বিদ্যুৎ দিতে পারছে না। গিনি বিসাউতে মাথাপিছু বিদ্যুৎ সরবরাহ ২১ কিলোওয়াট, ইথিওপিয়ায় ৮২ কিলোওয়াট ও নাইজেরিয়ায় ১৫০।

আবার পরিবারের আকারের সঙ্গে একটি দেশের জিডিপিও প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। সেই সূত্রে ফার্টিলিটি রেটের সঙ্গে ব্যাংক ঋণ পাওয়ারও একটা সম্পর্ক আছে। বাংলাদেশে জিডিপির সঙ্গে ব্যাংক ঋণ পাওয়ার সম্ভাব্যতার হার ৩৯ শতাংশ, নাইজেরিয়ায় যা মাত্র ১২ শতাংশ। এর কারণ- বাংলাদেশে ফার্টিলিটি রেট ২ আর নাইজেরিয়ার ৫ দশমিক ২।

আফ্রিকার বতসোয়ানা, মরিশাস, মরক্কো ও সাউথ আফ্রিকা সম্পদশালী দেশ। এই দেশগুলোর ফার্টিলিট রেট তথা পরিবার-প্রতি সন্তানের সংখ্যা কিন্তু ৩-এর কম।    

তথাপি, ১৯৭৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়া যে অবস্থানে ছিল, বাংলাদেশ এখন সেই অবস্থানে আছে। বলা যায় একটা মিরাকল ঘটার চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে দেশটি।

পরিশেষে, আফ্রিকার অনেক দেশই রবার্টসনের তিন শর্ত পূরণ করেছে। তাদের উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক সততাও নিঃসন্দেহে বড় ভূমিকা রেখেছে। তবে, বাংলাদেশ দেখিয়ে দিল, বিশেষ কোনও পরিকল্পনা কিংবা সম্পদ ছাড়াও উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব।

Leave a Reply

Your email address will not be published.