আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে নির্বাচন কমিশনের কাছে আওয়ামী লীগের ১৪ প্রস্তাব

বাআ॥  আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তিনশ আসনে ইভিএমে ভোট করার দাবি জানিয়েছে আওয়ামী লীগ; পাশাপাশি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে ইসিকে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে ক্ষমতাসীন দলটি।

একই সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ‘হাওয়া ভবনের মাধ্যমে’ পুলিশসহ সিভিল প্রশাসনে নিয়োগ পাওয়া দলীয় কর্মকর্তাদের তালিকা প্রস্তুত করে তাদের সব নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে বাইরে রাখাসহ একগুচ্ছ প্রস্তাব দিয়েছে দলটি।

গত রোববার নির্বাচন ভবনে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ইসির সংলাপে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলের পক্ষে এসব প্রস্তাব তুলে ধরেন।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপের শেষ দিনে তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল অংশ নেন।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালসহ চার নির্বাচন কমিশনার সংলাপে সুষ্ঠু নির্বাচনে কমিশনের পদক্ষেপের পাশাপাশি সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন।

কাদের বলেন, “ভোট ডাকাতি ও ভোট কারচুপি বন্ধে ইভিএমের কোনো বিকল্প নেই। আমরা ইভিএম মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, চেতনায় ধারণ করি। বিশেষ কোনো এলাকা নয়, আমরা ৩০০ আসনে ইভিএমে ভোটও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এ দাবি জানাচ্ছি।

“আওয়ামী লীগ মনে করে, ইসির কাজে ইভিএমসহ প্রযুক্তিসহ সব কার্যক্রমের স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পেয়েছে।”

আগের কমিশনের সময়ও কয়েকটি সংসদীয় আসনে, উপ নির্বাচন ও স্থানীয় নির্বাচনে ইভিএমের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে বলে জানান তিনি।

বিএনপি ও কিছু দল ইভিএম নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, “একটা কথা শুনতে পাই, নির্বাচনে ভোটারদের অনুপস্থিতির কথা এখান থেকেও বলা হয়। আমি এর সঙ্গে একদম একমত নই।

“কাগজপত্র এ অফিসে তো আছে; কোনো কোনো এলাকায় মহিলাদের উপস্থিতি, বিশাল লাইন স্থানীয় নির্বাচনে। ভোটারদের অনাগ্রহের যে বিষয়টি নিয়ে বিএনপি নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে আর ইসিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে যাচ্ছে- এটা সবৈব মিথ্যা, এটা অপপ্রচার।”

দলের প্রস্তাবগুলো তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক কাদের বলেন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সাংবিধানিক রেগুলেটরি কমিশন ‘নির্বাচন কমিশনকে’ সর্বাত্মকভাবে সহায়তা করবে।

সংলাপে অংশ নেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, কাজী জাফর উল্লাহ, ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক ও লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান, উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু ও মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপপু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ, দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া এবং শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক বেগম শামসুন নাহার।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ১৪ দফা প্রস্তাবগুলো হলো—

১) নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা ঊর্ধ্বে রেখে সংবিধান ও আইনে প্রদত্ত দায়িত্ব পালনে সক্ষমতা প্রদর্শন।

২) নির্বাচনকালীন সময়ে নির্বাহী বিভাগের সংশিষ্ট মন্ত্রণালয়/সংস্থার দায়িত্বশীলতা।

৩) নির্বাচন কমিশন সচিবালয় এবং এর মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা/কর্মচারীদের দায়িত্বশীল ও নিরপেক্ষ আচরণ। এটি সর্বজন স্বীকৃত, আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্যান্য সব সরকারের সময় নির্বাচন কমিশনকে দলীয়করণ করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনে একদিকে যেমন সাংবিধানিক পদে দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, অন্যদিকে বিএনপি-জামাত অশুভ জোট সরকারের সময় কর্মকর্তা পর্যায়ে হাওয়া ভবনের মাধ্যমে এক বিপুল সংখ্যক দলীয় ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এছাড়া, দলীয়করণের অংশ হিসেবে পুলিশসহ সিভিল প্রশাসনে ব্যাপকভাবে দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়োগ করেছিল। এদের অনেকেই এখন জেলা পর্যায়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত অথবা দায়িত্ব পাওয়ার জন্য অপেক্ষমান। এই সকল দলীয় কর্মকর্তাদের তালিকা প্রস্তুতপূর্বক তাদের সকল ধরনের নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে বাইরে রাখতে হবে।

৪) ছবিযুক্ত একটি নির্ভুল ভোটার তালিকা এবং ভোট গ্রহণের দিন নির্বাচন কেন্দ্রের সার্বিক নিরাপত্তা।

৫) ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মাধ্যমে ভোটগ্রহণ বৃদ্ধি করা। বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ ভারতের মতো প্রযুক্তির মাধ্যমে ভোট ডাকাতি ও ভোট কারচুপি বন্ধ করতে ইভিএমের কোন বিকল্প নেই। আগামী নির্বাচনে ইভিএম মেশিনের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করতে হবে।

৬) বেসরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা/কর্মচারীদের পরিবর্তে প্রজাতন্ত্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা/কর্মচারীদের প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার পদে নিয়োগ করা।

৭) আইনশৃংখলা রক্ষায় নিয়োজিত সদস্যদের নিরপেক্ষ ও দায়িত্বশীল আচরণ।

৮) আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন দেশি ও বিদেশি পর্যবেক্ষক নিয়োগে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। প্রচলিত আইন ও বিধি-বিধান অনুযায়ী কোনোভাবেই কোনো দল বা প্রার্থীর প্রতি অনুগত বা কোনোভাবে সম্পর্কযুক্ত হিসেবে পরিচিত বা চিহ্নিত ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সংস্থাকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব প্রদান করা যাবে না।

৯) নির্বাচনে পেশিশক্তি ও অর্থের প্রয়োগ বন্ধ এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ সকল পর্যায়ের ভোটারের অবাধ ভোটদানের সুযোগ নিশ্চিত করা।

১০) নির্বাচনের পূর্বে ও পরে সর্বসাধারণের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

১১) নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময়ে প্রশাসন ও আইনশৃংখলা বাহিনীসহ নির্বাচন পরিচালনার জন্য আবশ্যকীয় সকল সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে ন্যস্ত করা।

১২) নির্বাচনকালীন সরকারের কর্মপরিধি কেবলমাত্র আবশ্যকীয় দৈনন্দিন (রুটিন) কার্যাবলীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা।

১৩) এডহক (অন্তবর্তীকালীন) ব্যবস্থার পরিবর্তে টেকসই সাংবিধানিক, আইনি ও রেগুলেটরি ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করা; এবং

১৪) তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা একটি অতীত এবং মিমাংসিত বিষয়। দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এই ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক এবং অবৈধ ঘোষণা করেছে। আইন সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১১-এর বিধান অনুযায়ী এই বিষয়ে অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের ভিন্ন কোন সিদ্ধান্ত দেওয়ার এখতিয়ার নেই। এই বিষয়ে সাংঘর্ষিক কোন মন্তব্য করা সংবিধান লঙ্ঘন করার শামিল।
এই প্রস্তাবগুলো ছাড়া ওবায়দুল কাদের বলেন, আওয়ামী লীগ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘ সংগ্রাম করেছে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সাংবিধানিক রেগুলেটরি কমিশন ‘নির্বাচন কমিশন’-কে সর্বাত্মকভাবে সহায়তা করবে। সংলাপে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে ১৩ সদস্যের প্রতিনিধিদল অংশ নেয়। প্রতিনিধিদলের মধ্যে ছিলেন উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য আমির হোসেন আমু, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, কর্নেল ফারুক খান, ড. আব্দুর রাজ্জাক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published.