ব্যস্ততায় কাটানো বঙ্গবন্ধুর শেষ দিনগুলো

প্রশান্তি ডেক্স॥ পাকিস্তানের বন্দিশিবির থেকে ফিরে এসে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তারপর থেকে দেশ ‍পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিদিনের পরিকল্পনা আর তা বাস্তবায়নের যে লড়াই, সেখানে কোনও অবসর ছিল না। ঘাতকের গুলিতে নিহত হওয়ার আগে পুরো আগস্ট মাসের শুরুটাও ছিল তেমনই ব্যবস্থায় ভরা। কোনদিন কী করেছেন, তার কিছু উল্লেখ তৎকালীন সংবাদপত্রগুলোর প্রকাশিত সংবাদে পাওয়া যায়। একইসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সহকারী একান্ত সচিব শাহরিয়ার ইকবাল বিভিন্ন সময়ে তার ব্যস্ততার কথা জানিয়েছেন।

১৯৭২ সাল থেকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন করতে গিয়ে নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে যেতে হতো। বারবার প্রয়োজনে নানাভাবে ভেঙেছেন-গড়েছেন। তারই অংশ হিসেবে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রী থেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। প্রথমে প্রধানমন্ত্রী ও পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের শাসনযন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনে যখন তিনি ব্যস্ত, ঠিক সে সময় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল ঘাতক তাঁকে সপরিবার হত্যা করে।

জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর হস্তক্ষেপ ছিল অনিবার্য। বাংলাদেশের জনজীবনে তিনি ছিলেন অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ কারণেই প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির সরকারি অবস্থানকেন্দ্র গণভবনে প্রতিদিন ভিড় জমাতো বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত শত শত মানুষ। সবার আবদার যেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কাছেই। মন্ত্রীরা উপস্থিত হতেন পরামর্শের জন্য, আমলারা নির্দেশ গ্রহণের জন্য।

সাত দিন আগে থেকে কী ছিল ব্যস্ততার ধরন। বৃহস্পতিবার ৭ আগস্ট (১৯৭৫) অফিসের কাজ শুরু করেন সাড়ে ৯টা থেকে। ৯টা ৩০ মিনিটে সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত এটিনি সতার রাষ্ট্রপতির কাছে তার পরিচয়পত্র পেশ করেন। এরপর দুপুর পর্যন্ত প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। দুপুরের বিরতির পর সাড়ে ৫টার দিকে ভারতের হাইকমিশনার শ্রী সমর সেন এবং সন্ধ্যার পর আবারও দলীয় লোকজনের নানা সমস্যা নিয়ে বসেন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধু থাকতেন ৩২ নম্বরের বাড়িতে। কিন্তু গণভবন কমপ্লেক্সে অফিসে যেতেন এবং সেখানে বাসা থেকে খাবার যেতো। সেখানে স্নানের পর দুপুরের আহার করতেন। তাঁর দুপুরের খাবার ছিল খুবই সাধারণ। আহারের পর তিনি কিছুটা সময় বিশ্রাম নিতেন। এ সময় ব্যক্তিগত কর্মচারীদের সঙ্গে আলাপ করতেন। বিকাল ৪টায় তিনি হাঁটতেন গণভবন প্রাঙ্গণে। এরপর লেকের ধারে যে ঘাট ছিল, সেখানে বড় কালো চেয়ারগুলোর একটিতে তিনি বসতেন।

পরদিন ৮ আগস্ট সকাল ১০টায় প্রথম ও দ্বিতীয় কর্ম কমিশনের দুই চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তিনি। দুপুরের আগে মন্ত্রীরা একের পর এক সাক্ষাতের জন্য আসেন। বিকাল ৫টা ৩০ মিনিটে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী শপথ নেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর শেষ মন্ত্রিসভার বন্দর, নৌ ও জাহাজ চলাচলমন্ত্রী ছিলেন।

শনিবার ৯ আগস্ট সকাল ১০টায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্থানীয় প্রতিনিধি ড. স্যামস্ট্রিট আসেন। বেলা ১১টায় সাক্ষাতে আসেন প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী ও সেনাবাহিনী প্রধান। সন্ধ্যা ৬টায় বাকশালের সম্পাদক ও কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য জিল্লুর রহমান ও সন্ধ্যা ৬টা ১৫ মিনিটে আসেন অ্যাটর্নি জেনারেল। পরেরদিন রবিবারের আনুষ্ঠানিক কোনও কর্মসূচির কথা জানা যায় না। সোমবার ১১ আগস্ট বেলা ১১টা ৩০ মিনিটে গিয়াসউদ্দিন সাক্ষাৎ করেছিলেন। ১২ আগস্ট ছিল মঙ্গলবার। রাষ্ট্রপতির একান্ত সচিবের বয়ানে জানা যায়, সেদিন সাক্ষাৎপ্রার্থী খুব কম ছিল। সকাল ১০টায় অর্থমন্ত্রী, সন্ধ্যা ৬টায় অধ্যাপক এ এফ এ হোসেন (কমনওয়েলথ সেক্রেটারিয়েট) দেখা করেন।

১৩ আগস্ট মঙ্গলবার কাজের শুরু হয় সকাল ১১টার দিকে যুক্তরাষ্ট্রে নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত এম আর সিদ্দিকীর সঙ্গে সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে এবং সেদিন সন্ধ্যায় তার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আসেন মওদুদ আহমদ।

বঙ্গবন্ধুর ১৪ আগস্টের কর্মসূচিতে ছিল ১০টায় প্রজাতন্ত্রী কোরিয়ার (দক্ষিণ কোরিয়া) রাষ্ট্রপতি পার্ক চুং হির বিশেষ দূতের সঙ্গে সাক্ষাৎ। এরপর একে একে দেখা করেন নৌবাহিনী প্রধান, তথ্য ও বেতারমন্ত্রী, প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী ও বিমান বাহিনীর প্রধান। তারা সবাই আধঘণ্টা করে ছিলেন। বেলা ১১টা ৩০ মিনিটে আতাউর রহমান খানের দুই কন্যা আসেন। যেহেতু বঙ্গবন্ধুর ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা, সেই কর্মসূচিকে সামনে রেখে ১৪ আগস্ট বিকাল ৫টা ৪৫ মিনিটে ঢাবির উপাচার্য আসেন। এর পরপরই সন্ধ্যা ৬টায় শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব সাক্ষাতের জন্য আসেন। শেষ দিনে একটি অনির্ধারিত সাক্ষাতের কথাও জানা যায়। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে বঙ্গবন্ধু যখন গণভবনের লেকে মাছের খাবার ছড়ানো দেখছিলেন, সে সময় অনির্ধারিতভাবে এসে উপস্থিত হন তথ্য ও বেতার প্রতিমন্ত্রী তাহেরউদ্দিন ঠাকুর। তাকে একটা চেয়ারে বসতে বলে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published.