ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ‘স্বর্ণালী অধ্যায়’

বাআ॥ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বহু প্রতীক্ষিত ভারত সফর দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায় উন্মোচন করতে যাচ্ছে বলে আশা করা হচ্ছে। ৫ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনা ভারত সফর করবেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে এ সফর হচ্ছে। এর বিশেষ দিক হলো, দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্থাপনের সুবর্ণ জয়ন্তীর বছর এটি। আবার কোভিড-১৯ মহামারির প্রাদুর্ভাবের পর এটি শেখ হাসিনার প্রথম ভারত সফর।

শেখ হাসিনার এ সফরের আগে দ্বিপাক্ষিক নানা বিষয় নিয়ে দুই দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক হয়েছে। দুই প্রধানমন্ত্রী ৬ সেপ্টেম্বরের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে এসব বিষয় আলোচিত হবে। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য, সড়ক অবকাঠামো, পানি বণ্টন এবং জ্বালানী সহযোগিতার মতো বিষয়গুলো দুই প্রধানমন্ত্রীর আলোচনায় প্রাধান্য পাবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।

ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ধারায় দেখা গেছে, কীভাবে ভারতে নরেন্দ্র মোদির সরকার এবং বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের সরকারের সময় এসে দুটি দেশ নিবিড় সম্পর্কের কারণে সমভাবে লাভবান হয়েছে। তাই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। শেখ হাসিনার বিরোধীরা এ বিষয়টির দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখে। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল বিএনপি এমন অভিযোগ প্রায়শই করে যে, আওয়ামী লীগ ভারতের সঙ্গে দর কষাকষির সময় ‘খুব দুর্বল’। শেখ হাসিনার এই সফর তাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির ওপর বড় প্রভাব রাখবে। এই প্রেক্ষাপটে এই নিবন্ধে শেখ হাসিনার এ সফরের সম্ভাব্য ফলাফলের ওপর আলোকপাত করা হবে।

পারস্পারিক যোগাযোগ বৃদ্ধি: সড়ক অবকাঠামো বাণিজ্য

এ সফরের সময় নরেন্দ্র মোদি ও শেখ হাসিনা ‘স্বাধীনতা সড়ক’ (২৫ কিলোমিটারের সংযোগ সড়ক) উদ্বোধন করবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। এ নামের ঐতিহাসিক সড়কটি বাংলাদেশের মুজিব নগরের সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়ার মধ্যে যোগাযোগ সৃষ্টি করবে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এ সড়কের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। সেই স্মৃতির স্মারক হবে নতুন এ সড়ক। একই ঐতিহ্যের ধারক দুই বন্ধু প্রতিবেশী এই সংযোগের মাধ্যমে তাদের বর্ণিল অতীতকে যেমন স্মরণ করবে তেমনি গাঢ়তর হবে বন্ধন। পাঁচটি নতুন রেল সড়ক পথ পুনঃস্থাপনের সঙ্গে এই স্বাধীনতা সড়কের উদ্বোধন ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান ভার্তৃত্বপূর্ণ সম্পর্ককে আরও জোরদার করবে, কৌশলগত স্বার্থের বাইরে যার আলাদা রকমের গুরুত্ব আছে।

বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার এই সফরের সময় সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারাত্ব চুক্তি (সেপা) চূড়ান্ত হওয়ার একটি সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশ এ চুক্তিতে সম্মতি দিয়েছে, ভারতের সম্মতির বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। সেপার খসড়া নিয়ে দুই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা হবে বলে আশা করা যায়। সেপায় স্বাক্ষর করে ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ই লাভবান হতে চায়। এই চুক্তির মাধ্যমে দুটি দেশ তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সব ধরনের লাভ নিতে চায়। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উত্তরণের পরেও এ সুযোগ অব্যাহত থাকবে। দুই দেশের কূটনৈতিক বন্ধনের ক্ষেত্রে এই চুক্তিকে তাই যুগান্তকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।

পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে পারস্পারিক বোঝাপড়া

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের আগে গত ২৫ আগস্ট দুই দেশের যৌথ নদী কমিশনের ৩৮তম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় নয়াদিল্লিতে। দীর্ঘ ১২ বকছর পর এ বৈঠক হলো। বৈঠকে দুই দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত মুহুরী, গোমতী, দুধকুমার, মনু, ধরলা এবং ফেনী নদীর পানি ভাগাভাগির বিষয় আলোচিত হয়। দ্বিপাক্ষিক যেসব বিষয় নিয়ে মূল আলোচনা হয়েছে সেগুলো হলো বন্যার উপাত্ত ভাগাভাগি এবং নদী দূষণ। যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকের পর এটা ধরে নেওয়া যায় যে দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে পানি ভাগাভাগির বিষয়গুলো চূড়ান্ত হবে।

যৌথ নদী কমিশনের আলোচনায় দুই দেশ কুশিয়ারা নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে একটি সমঝোতা স্মারাকে (এমওইউ) স্বাক্ষর করে। এর ফলে এটা ধরে নেওয়া যায় যে, দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টনের চুক্তি চূড়ান্ত হবে। কুশিয়ারা নদী ভারত–বাংলাদেশ সীমান্তের একটি অংশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। উত্তর–পূর্ব ভারতের রাজ্য নাগাল্যান্ডে এর উৎপত্তি। এর উপনদীগুলো উত্কর পূর্ব ভারতের মনিপুর, মিজোরাম এবং আসামের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এই নদীটি ভারতের জাতীয় নদীপথ ১৬ (ন্যাশনাল ওয়াটারওয়ে১৬) এর একটি অংশ। এই নদীপথ স্থলবেষ্টিত উত্তর–পূর্ব ভারতের সঙ্গে উপকূলীয় শহর কলকাতা হয়ে ভারত–বাংলাদেশ নদী প্রটোকল রুটের সঙ্গে সংযোগে ভূমিকা রাখে। নাগাল্যান্ড থেকে শুরু করে প্রতিবশী রাজ্য মনিপুর এবং আসামের ভেতরে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এই নদীপথ দুটি নদীতে বিভক্ত হয়েছে। একটি কুশিয়ারা অন্যটি সুরমা। একটি গ্রহণযোগ্য দূরত্ব রেখে আঁকাবাঁকা পথে বেয়ে এই দুই নদী মিলিতভাবে তাদের সঙ্গমস্থলে মেঘলা নদীর সৃষ্টি করেছে। এটা বলে রাখা দরকার, জাতীয় নদীপথ ২ ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রধান পথ। এই পথ হলো কলকাতা–সুন্দরবন–চালনা–খুলনা–মোংলা, কাউখালী–বরিশাল–নারায়ণগঞ্জ–আরিচা–ধুবরি, পান্ডুয়া–শিলঘাট।

দুই দেশের একাধিক অভিন্ন নদীর ভাগাভাগি নিয়ে এই সফরে চূড়ান্ত হতে পারে। আর এর মাধ্যমে অভিন্ন সমস্যার সমাধানের একটি আরম্ভ হতে পারে। দুই দেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত ৫৪টি আন্ত-সীমান্ত নদীর পানি বণ্টনের বিষয়টিতে অবশ্যই দুই দেশকে একটি মতৈক্যে পৌঁছাতে হবে। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অকারণ উত্তেজনা রোধে এর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, তিস্তা চুক্তির বিষয়টি এখনো সুরাহা হয়নি। ভারতের কেন্দ্রের মোদি সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারের মধ্যে মতের ভিন্নতাই বহু প্রতীক্ষিত তিস্তা চুক্তি না হওয়ার ক্ষেত্রে কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

আন্তসীমান্ত জ্বালানী সহযোগিতার নতুন দিক উন্মোচন

এ সফরের সময় মৈত্রী থারমাল বিদ্যুৎ প্রকল্প দুই প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করতে পারেন। এই প্রকল্প ভারত–বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মধ্যে জ্বালানী নিরাপত্তার ক্ষেত্রে জোরদার করবে। দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য, সংযোগ এবং পানি বণ্টনের মতো বিষয় আছে। এসব ক্ষেত্র বছরের পর বছর ধরে ভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে একটি রূপ দিয়েছে।

এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বাংলাদেশের বৃহত্তম বিদ্যুৎ কেন্দ্র। মোংলা বন্দর এবং সুসৎন্দরবনের কাছাকাছি এর অবস্থান। দুই দেশের জ্বালানী সহযোগিতার ক্ষেত্র বাড়াতে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ভূমিকা আছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে সুন্দরবনের কাছাকাছি অবস্থানের কারণে এর পরিবেশগত ঝুঁকির বিষয়টিও আলোচিত হয়েছে। সুন্দরবনের পানি ও জৈব প্রকৃতির ওপর এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি নেতিবাচক প্রভাব আছে বলে সমালোচনা আছে। বিশেষ করে পশুর নদীয় ভঙ্গুর প্রতিবেশব্যবস্থায় এটি প্রভাব ফেলতে পারে বলে সমালোচকদের দাবি। নদীটির জীববৈচিত্র বিশেষ করে মাছের ওপর ওর নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হওয়ার শংকা আছে। পরিবেশগত ক্ষতির প্রশ্ন তুলে নানা আপত্তির বিষয়টিকে মাথায় নিতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করে বায়ু ও পানির ওপর নেতিবাচক পরিবেশগত প্রভাবকে প্রশমিত করার উদ্যোগ নিতে হবে।

এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হয়েছে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) এবং ভারত সরকার পরিচালিত ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার প্ল্যান্ট করপোরেশনের (এনটিপিসি) যৌথ উদ্যোগে। দুটো প্রতিষ্ঠানের আধাআধি শেয়ার আছে এখানে। বাংলাদেশের সমর্থন নিয়েই এ প্রকল্পে এই যৌথ প্রকল্পে শরিক হতে পেরেছে ভারত। এ বৃহৎ প্রকল্পে বাংলাদেশেরও নানা লাভ আছে। মোংলা বন্দরের কাছাকাছি হওয়ায় কৌশলগত দিক দিয়ে এর গুরুত্ব অনেক। কারণ এই বন্দর থেকে ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং অস্ট্রেলিয়ায় রপ্তানি করতে চায় বাংলাদেশ। এর ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় আকারের রাজস্ব পাবে।

ঐতিহাসিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নানা দিক থেকে ভারত ও বাংলাদেশের মিল রয়েছে। অভিন্ন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক সবসময় উদার, পারস্পারিক বিশ্বাস, সহযোগিতা এবং শ্রদ্ধার ওপর প্রতিষ্ঠিত। প্রতিবেশী দুই বন্ধু রাষ্ট্র এখন নতুন করে বাণিজ্য, সংযোগ, জ্বালানী ও পানি বণ্টনের মতো বিষয়ে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। দুই নেতা দুই দেশের সম্পর্ককে ‘সোনালী অধ্যাায়’ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। প্রকৃতপক্ষে কোভিড–১৯ এর জন্য তিন বছর পর শেখ হাসিনার বহু প্রতীক্ষিত এ সফর এই সোনালী অধ্যায়ের এক তাৎপর্যপূর্ণ দিক। যে প্রশ্নটি এখন রয়ে গেছে তাহলো , শেখ হাসিনার এই সফর ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগকে আগামী ২০২৩ সালের নির্বাচনে কতটুকু সুবিধা দেবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.