জরুরি সেবাদানকারী সংস্থার কর্মচারীদের কর্মবিরতি কতটা যৌক্তিক?

প্রশান্তি ডেক্স॥ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মাঠ পর্যায়ে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসার (পিআইও), জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিসার (ডিআরআরও) এবং কর্মচারীরা যেকোনও দুর্যোগ মোকাবিলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। দীর্ঘদিন ধরে একই পদে কাজ করছেন বিধায় তারা পদোন্নতি চান। এজন্য কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী, দাবি আদায়ে দৈনিক চার ঘণ্টার জন্য তিন দিনের কর্মবিরতির ডাক দেয় তাদের সংগঠন বাংলাদেশ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিসার সমিতি। এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সেবাদানকারী জরুরি সংস্থায় কর্মরত কর্মচারীদের কর্মবিরতিকে ভালোভাবে নেয়নি কেউই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি গ্রহণযোগ্য নয়। এটা সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মপরিকল্পনার পরিপন্থীও বটে।

জানা গেছে, গত ১২ সেপ্টেম্বর থেকে তিন দিনে চার ঘণ্টার জন্য কর্মবিরতি পালন করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মাঠপর্যায়ে কর্মচারীরা। তারা পাঁচ দফা দাবিতে এই কর্মবিরতি পালন করেন। দাবিগুলো হলো- ১. দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন ২০১২-এর আলোকে প্রস্তাবিত জনবল কাঠামো ও নিয়োগবিধি বাস্তবায়ন। ২. জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন (ডিআরআরও) পদ আপগ্রেডেশন। ৩. উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসার (পিআইও) পদ আপগ্রেডেশন। ৪. সচিবালয়ের মতো দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের কর্মচারীদের পদনাম পরিবর্তন।  ৫. দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের সব শূন্য পদ পদোন্নতি বা চলতি দায়িত্ব বা নিয়োগের মাধ্যমে পূরণ।

তাদের বক্তব্য হচ্ছে- দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিদফতর। যেকোনও দুর্যোগ মোকাবিলায় এই অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজেদের জীবন বাজি রেখে জনগণের পাশে দাঁড়ান। অথচ এই অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজেরাই দুর্যোগের শিকার। কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার দাবি বাস্তবায়নের অনুরোধ করা হলেও  কর্তৃপক্ষ পদক্ষেপ নিচ্ছে না। 

তারা অতিসত্বর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসার পদ আপগ্রেডেশন, জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিসার পদ আপগ্রেডেশন এবং প্রস্তাবিত জনবল কাঠামো ও নিয়োগবিধি বাস্তবায়নসহ ৫ দাবি বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ নাঈম গওহর ওয়ারা জানিয়েছেন, অত্যাবশ্যকীয় সেবাদানকারী সরকারি সংস্থাগুলো জরুরি সেবা দিতে সর্বদা সতর্ক থাকবে এটাই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে নিজেদের দাবি আদায়ে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরকে না জানিয়ে যে কোনও কর্মবিরতি শোভনীয় নয়। যা সরকারের কর্মচারী শৃঙ্খলারও পরিপন্থী। জরুরি সেবাদানকারী সংস্থাগুলো সরকারে অন্য ১০টি সংস্থা থেকে ব্যতিক্রম।

অপরদিকে গত কয়েকদিন ধরে সাগরে নিম্নচাপের প্রভাবে সারাদেশে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনার বিষয়টিসহ সাগর তীরবর্তী এলাকায় জোয়ারের পানি ৪ থেকে ৫ ফুট পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিল আবহাওয়া দফতর। ভাদ্র মাসের পূর্ণিমায় এমনটা প্রতিবছরই হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। পূর্ণিমার প্রভাবে গত কয়েকদিন ধরে চলমান অতিবৃষ্টির ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল পানিতে প্লাবিত হয়ে জনদুর্ভোগের সৃষ্টি করেছে। এ বিষয়ে আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাসও ছিল। সেই সময়ে এমন একটি সেবাদানকারী সরকারি সংস্থার কর্মবিরতি কোনওভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা  আগেই তাদের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতির সামাল দিতে পারতেন। এমন সময় তাদের কর্মবিরতি কিছুদিন পিছিয়েও দেওয়া যেতো আলাপ আলোচনা করে।     

তবে ক্যাডারভিত্তিক আমলাতন্ত্রের মধ্যে প্রশাসনের নিম্ন পর্যায়ের কর্মচারীদের ইগনর বা অবহেলা অবজ্ঞা করার প্রবণতা রয়েছে বলেও অভিযোগ করেছেন এই বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, নিম্নপর্যায়ের কর্মচারীদের কথা শোনার মনোভাব থাকতে হবে। তাদের মর্যাদা দেওয়া উচিৎ। যখন অন্য বিভাগের কর্মচারীদের আন্দোলন করে দাবি আদায় করতে এরা দেখে তখন তারাও দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলনকে বেছে নেয়। অসন্তুষ্টি দিয়ে কর্মচারীদের কাজ করানো যাবে না এটি মাথায় রাখতে হবে। তাদের দাবি দাওয়া নিয়ে বসা উচিৎ। তাদের দাবি দাওয়া সুবিধা অসুবিধা নিয়ে কথা বলা উচিৎ।

তিনি আরও জানান, যথেষ্ট অভিজ্ঞতা থাকার পরেও অধিদফতরের অধীনস্থ এসব কর্মচারীরা কোনওদিন এই সংস্থার পরিচালক হতে পারবেন না। পরিচালক হবেন বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তারা। তবে কোনও একটা পদ্ধতি থাকা উচিৎ এসব অভিজ্ঞ কর্মচারীদের সম্মানজনক ও মর্যাদাপূর্ণ পদে পদায়ন করার।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের কর্মচারীদের ৫ দফা দাবির বিষয়টি জানেন না বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ড. এনামুর রহমান। কেউ তাকে বিষয়টি অবহিত করেনি। কর্মচারীরা তাদের দাবির বিষয়টি কাকে জানিয়েছেন তাও তার বোধগম্য নয়। তিনি হঠাৎ করে শুনেছেন, কর্মচারীরা কর্মবিরতি করছেন। হঠাৎ করে এভাবে কর্মবিরতি করার সিদ্ধান্তটি নিয়ে তারা ঠিক কাজটি করেনি বলেও জানিয়েছেন তিনি। প্রতিমন্ত্রী বলেন, তারা এটা অন্যায় করেছে। মন্ত্রণালয়ের সর্বস্তরের কর্মচারীদের প্রতি আমি এবং আমার মন্ত্রণালয় অত্যন্ত আন্তরিক। তারপরও অধিদফতরের মহাপরিচালককে বলেছি তাদের দাবি দাওয়ার বিষয়ে কী করা যায়?

প্রতিমন্ত্রী আরও জানিয়েছেন, তাদের দাবি দাওয়ার বিষয়গুলো নিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আমি নিজে কথা বলেছি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে এসব দাবি বাস্তবায়ন আপাতত সম্ভব নয়। তারপরও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। দেখি কী করা যায়। 

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক আতিকুল হক জানিয়েছেন, তাদের দাবি দাওয়ার বিষয়টি নিয়ে বসেছি। দাবিগুলো বিবেচনা করা হচ্ছে। আমরা তাদের দাবি দাওয়ার বিষয়টি নিয়ে খুবই আন্তরিক।

তিনি জানান, গত কয়েকদিনে কর্মবিরতিতে তেমন কোনও সমস্যা হয়নি। তবে পরিস্থিতি জটিল হলে নিশ্চয়ই সমাধান বের করা যেতো। এ ছাড়া কোনও কাজের জন্য কে রেসপনসিবল তা বলে দেওয়া আছে। আমরা সেভাবেই এগিয়ে যেতাম।  

বাংলাদেশ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিসার সমিতির সভাপতি ইসমাইল হোসেন জানান,  যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় এই অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজেদের জীবন বাজি রেখে জনগণের পাশে দাঁড়ান। এই অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজেরাই আজ ‘দুর্যোগের’ শিকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published.