জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে প্রস্তুতি নিচ্ছে ছাত্র সংগঠনগুলো

প্রশান্তি ডেক্স॥ সর্বশেষ ২০০৮ সালের নির্বাচন হয়েছিল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে। তারপর ২০১৪ ও ২০১৮ সালের দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে। যদিও আগামী বছরের শেষ সপ্তাহ বা পরের বছরের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে হওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো। আর এসব রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতায় রয়েছে ছাত্র সংগঠন। বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীরা দাবি-দাওয়ার বিষয়ে কথা বললেও জাতীয় রাজনীতিতে তারা ভূমিকা পালন করে। তাই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রস্তুতি নিচ্ছে ছাত্র সংগঠনগুলোও।

প্রায় সব ছাত্র সংগঠনের অস্তিত্ব রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে সক্রিয় আছে হাতে গোনা কয়েকটি। এর মধ্যে রয়েছে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (মার্ক্সবাদী), সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট (বাসদ)।

তবে কার্যক্রমে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। আর বাম সংগঠনগুলো ছাড়া অন্যরা প্রায় কোণঠাসা। মাঝেমধ্যে সরকারি আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশ ও সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের রোষানলে পড়তে হয় বাম ছাত্র সংগঠনগুলোকেও, হতে হয় হামলা-মামলার শিকার। তবে এবার বাম ছাত্র সংগঠনগুলো এক প্ল্যাটফর্মে এসে আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্ততি নিচ্ছে।

এর আগে প্রগতিশীল ছাত্রজোট নামে একটি প্ল্যাটফর্ম থাকলেও এখন আর কার্যকর নেই জোটটি। কালেভদ্রে কখনও তাদের একসঙ্গে দাঁড়াতে দেখা যায়, তবে সাতটি সংগঠন নিয়ে গঠিত হলেও বর্তমানে জোটে আছে তিনটি সংগঠন। নতুন প্ল্যাটফর্মে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন নিশ্চিতসহ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল এবং শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দাবি আদায়ের লড়াইয়ে আন্দোলন করা হবে বলে জানান প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের এক নেতা।

কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটি হয়েছে ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই। সেই হিসাবে কমিটির মেয়াদ শেষ হয় ২০২০ সালের জুলাইয়ে। আগস্ট থেকে এখন মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়েই চলছে ছাত্রলীগ। তবে তখন করোনা মহামারির কারণে কমিটি দিতে পারেনি বলে জানান কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কমিটি দেওয়া হবে বলে তিনি সে সময় গণমাধ্যমকে জানালেও দৃশ্যত কোনও কার্যক্রম দেখা যায়নি।

তবে ছাত্রলীগের একটি অংশ বলছে, নিজেদের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে নানা টালবাহানা করছেন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে ছাত্রলীগের সম্মেলন হবে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির এক নেতা জানান।

সম্মেলনের বিষয়ে জানতে কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মোবাইল নম্বরে বেশ কয়েকবার কল করে তাদের পাওয়া যায়নি।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘আমাদের বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অভিভাবক দেশনেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনার আলোকে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ সিদ্ধান্ত নেবে।’

আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের জন্য ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে একটি গণজোয়ার তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বিশেষ করে করোনাকালীন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের মুখেও যেসব লক্ষ্যমাত্রা সম্পন্ন হতে যাচ্ছে এবং ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে, সেটি আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করবে।’

তিনি বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের কাছে যাওয়া এবং তাদের সংগঠিত করা, সেটি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ করার চেষ্টা করবে। বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আছে, সেটি যেন বজায় থাকে। একই সঙ্গে কেউ যেন জ্বালাও-পোড়াওয়ের রাজনীতি সৃষ্টি করতে না পারে, সেটিও ছাত্রলীগ দেখবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ যেন বজায় থাকে, আমরা সেটি করার চেষ্টা করবো।’

এদিকে নির্বাচনে আন্দোলনকে বেগবান করতে ইতিমধ্যে পূর্ণাঙ্গ করা হয়েছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া হয়েছে ছাত্রদলের আংশিক কমিটি। তবে দুই কমিটি নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে দলের ভেতরেই। বয়স বিতর্কের জেরে কেন্দ্রীয় কমিটির ৩২ পদ স্থগিত করা হয়।

ছাত্রদল ঢাবি শাখার সভাপতি খোরশেদ আলম বলেন, ‘আমরা অনেক দিন ধরে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। অধিকাংশই ১০ বছরের ওপরে রাজনীতি করছে সক্রিয়ভাবে। ফলে অনেক নেতা-কর্মী যোগ্য। কিন্তু নেতৃত্বে এসেছে দুজন, আর তাই অনেকেরই মন খারাপ। আমাদের দলের পৃষ্ঠপোষক তারেক রহমান যাদের যোগ্য মনে করেছেন, তাদের নেতৃত্বের দায়িত্ব দিয়েছেন। আমরা দলের সবাইকে নিয়ে একত্রে কাজ করতে চাই। এ জন্য আমরা সবার সঙ্গে বসছি, বসার চেষ্টা করছি।’

তিনি আরও জানান, ছাত্রদল উপাচার্য, প্রক্টর, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে ক্যাম্পাসে নিয়মিত ‘মুভ’ করবে। নিয়মিত মধুর ক্যানটিনে বসবে। আর জাতীয় নির্বাচন উপলক্ষে দলীয় অর্পিত দায়িত্ব পালন করবে ছাত্রদল।

সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট (বাসদ) ঢাবি শাখার সভাপতি সাদেকুল ইসলাম সাদিক বলেন, ‘আমরা বাম গণতান্ত্রিক জোটের সিদ্ধান্তের আলোকে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন বিষয়ে বলছি এবং সেই আলোকেই আমাদের আন্দোলন হবে। আর প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো নিয়ে আমাদের জোট হওয়ার কথা চলছে। সেই প্ল্যাটফর্মে শুধু জাতীয় নির্বাচনই নয়, জাতীয় ইস্যুতে যেসব বিষয় আসবে, আমরা সেগুলো নিয়ে কথা বলবো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক আমাদের কিছু পরিকল্পনা আছে, সেগুলো জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক না। আবার যখন জাতীয় নির্বাচন আসবে, আমরা অ্যাডজাস্ট করবো।

বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে সফল ছাত্র ইউনিয়ন। ডাকসুতে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি নির্বাচিত ভিপি ছাত্র ইউনিয়নের প্যানেল থেকে। কিন্তু সম্প্রতি দলীয় অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে কেন্দ্রীয় কমিটি ও বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি দুই ভাগে বিভক্ত।

গত বৃহস্পতিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) ঢাবি শাখা ছাত্র ইউনিয়নের ১৯ সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। কমিটিতে কাজী রাকিব হোসাইনকে আহ্বায়ক ও সালাউদ্দিন আম্মারকে যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়েছে। রাকিব-সালাউদ্দিনকে নিয়ে আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেছে ফয়েজ উল্লাহ ও দীপক শীলের নেতৃত্বাধীন ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় অংশ। সংগঠনের কেন্দ্রে ফয়েজ-দীপকের বিপরীতে ‘বিদ্রোহী’ কমিটিতে আছে নজির আমিন চৌধুরী ও রাগীব নাঈমের নেতৃত্বাধীন অংশ।

‘বিদ্রোহীরা’ গত ১৩ মার্চ শিমুল কুম্ভকারকে সভাপতি ও আদনান আজিজ চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক করে ২৭ সদস্যের ঢাবি শাখা ছাত্র ইউনিয়নের কমিটি গঠন করে।

ঢাবি শাখার বিদ্রোহী অংশের সভাপতি শিমুল কুম্ভকার বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে থেকেই ছাত্র ইউনিয়নের একটি কমিটি আছে। ইদানীং আরেকটি কমিটি দিয়েছে কেন্দ্রের একাংশ। কিন্তু এ বিষয়ে আমাদের কিছু বলার নেই।

বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি মশিউর রহমান খান রিচার্ড বলেন, ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে আমরা লড়ছি। দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্রসমাজ নেতৃত্বমূলক ভূমিকা পালন করেছে। তাই চলমান ফ্যাসিবাদের অন্যতম টার্গেটে পরিণত হয়েছে শিক্ষাঙ্গনগুলো। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ফ্যাসিবাদের দলদাসে পরিণত হয়েছে আর তাদের প্রত্যক্ষ মদদে শিক্ষাঙ্গনগুলোতে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য কায়েম করেছে। সন্ত্রাস-দখলদারিত্বে সিদ্ধহস্ত ছাত্রলীগ প্রতিটা শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র স্বার্থবিরোধী ও ফ্যাসিবাদের রক্ষাকারী লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত হয়েছে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগকে এখন ছায়া প্রশাসনের ভূমিকায় দেখা যায় অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘তারা শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে হল দখল, সিট বাণিজ্য, গণরুম-গেস্টরুমে নির্যাতনের মাধ্যমে ত্রাস সৃষ্টি করেছে। শিক্ষাঙ্গনের বাইরেও রাজনৈতিক ক্ষমতার ছত্রচ্ছায়ায় বেড়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং।’

মশিউর রহমান খান আরও বলেন, ‘আমরা মনে করি, বর্তমান দমবন্ধ পরিবেশ জ্ঞানচর্চা ও জীবনের স্বাস্থ্যকর বিকাশের অন্তরায়। আমরা শিক্ষাঙ্গনে পড়াশোনার পরিবেশ চাই, নিরাপদ ক্যাম্পাস চাই, মত প্রকাশের স্বাধীনতা চাই। বর্তমান কতৃত্ববাদী শাসন ও শাসকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াই এখন তাই সময়ের দাবি। শিক্ষাঙ্গনসহ দেশের সর্বত্র গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় ছাত্রসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন লড়াই গড়ে তুলবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.