কীভাবে ঠেকানো যায় গ্রিড বিপর্যয়?

প্রশান্তি ডেক্স॥ স্থিতিশীল গ্রিডের জন্য অটোমেশনের কোনও বিকল্প নেই। নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে মানুষের বদলে যত বেশি যান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে, গ্রিড ততই স্থিতিশীল হবে। তবে এর জন্য বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন। খুব অল্প সময়ে সম্ভব না হলেও সরকার এরমধ্যেই এ সংক্রান্ত উদ্যোগ নিয়েছে। ক্রমান্বয়ে স্মার্ট গ্রিডের সম্প্রসারণ করলে এ ধরনের গ্রিড বিপর্যয়ের ঘটনা এড়ানো সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিদ্যুতের উৎপাদন থেকে সঞ্চালন ও বিতরণ এই তিন জায়গাতেই সমান গুরুত্ব দেওয়ার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। দেশে এখন বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র আসছে। পায়রা, রামপাল, মাতারবাড়ি, রূপপুরের সব ইউনিট ২০২৪ এবং ২০২৫-এর মধ্যে উৎপাদনে চলে আসবে। এরমধ্যেই গ্রিড স্থিতিশীল না করতে পারলে বিপর্যয় আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। কোনও কারণে একটি এক হাজার মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র আকস্মিক বন্ধ হয়ে গেলে গ্রিড সংকটে পড়তে পারে দেশ।

পিডিবির একজন কর্মকর্তা বলেন, গ্রিড বিপর্যয় রোজকার কোনও ঘটনা নয়। কিন্তু এই বিপর্যয় রোধ করতে হলে যে পরিমাণ আধুনিকায়ন প্রয়োজন তা আমরা করে উঠতে পারছি না। এজন্য বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন। যার সংস্থান আবার একদিনে করা সম্ভব না।

যেভাবে বিপর্যয় ঘটতে পারে

বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদনের পর বিদ্যুৎ গ্রিড সাবস্টেশনের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়। এই জাতীয় গ্রিড দেশের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গার গ্রিড সাবস্টেশনে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়। এই গ্রিড সাবস্টেশন এবং জাতীয় গ্রিড দুটোরই নিয়ন্ত্রণ রয়েছে রাষ্ট্রীয় কোম্পানি পাওয়ার গ্রিডের হাতে। গ্রিড সাবস্টেশন থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় বিতরণ কোম্পানির সাবস্টেশনে। বিতরণ কোম্পানির সাবস্টেশন থেকে মানুষের বাড়ি বাড়ি বিদ্যুৎ পৌঁছায়। বিতরণ জটিলতার কারণে সাধারণত গ্রিড বিপর্যয় ঘটে না। বিপর্যয় ঘটে সঞ্চালন জটিলতার কারণে।

অর্থাৎ বিদ্যুতের উৎপাদন থেকে গ্রিড সাবস্টেশনের পৌঁছানো এবং সঞ্চালনের মাধ্যমে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার সময় এই সমস্যা সৃষ্টি হয়।

উৎপাদন এবং সঞ্চালন ব্যবস্থার গ্রিডের এই অংশটুকু নিয়ন্ত্রণ করে ন্যাশনাল লোড ডেসপাস সেন্টার বা এনএলডিসি। ন্যাশনাল লোড ডেসপাস সেন্টার বিদ্যুতের চাহিদা দেখে কেন্দ্র চালানোর নির্দেশ দেয়। এমনকি কোন কেন্দ্র কত বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে তাও ঠিক করে দেয় এনএলডিসি। এই কাজটি স্বয়ংক্রিয় পন্থায় হওয়ার কথা। অভিযোগ রয়েছে, আমাদের এখানে সেটি অনেক ক্ষেত্রে হয় না। অর্থাৎ এনএলডিসি তাদের কার্যালয়ে বসেই সব বিদ্যুৎকেন্দ্র স্কাডার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তারা টেলিফোনে কেন্দ্রগুলোকে কত লোডে চালাতে হবে তা জানায়। আবার কোন কেন্দ্র বন্ধ করতে হলেও তারা এনএলডিসি থেকে বন্ধ করতে পারে না। কেন্দ্রগুলো বন্ধ করতে হলেও আবার সেই টেলিফোনের ওপারের মানুষের ওপর ভরসা করতে হয়।

গ্রিড বিপর্যয়ের প্রধান কারণ হচ্ছে চাহিদার সঙ্গে উৎপাদনের ভারসাম্য না থাকা। অর্থাৎ কখনও চাহিদা রয়েছে ১০ হাজার মেগাওয়াটের, কিন্তু উৎপাদন হঠাৎ আট হাজার মেগাওয়াটে নেমে গেলো, অথবা ১২ হাজারে উঠে গেলো। এরকম হলে বিদ্যুৎ প্রবাহের তরঙ্গে বিঘ্ন ঘটে, সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়।

কখনও যদি এ ধরনের ঘটনা ঘটে সেই সমাধান কয়েক মিলি সেকেন্ডের মধ্যে করতে হয়। অর্থাৎ চাহিদার চাইতে যদি হুট করে অনেক বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যায় তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাৎক্ষণিক সরবরাহ বন্ধ করলে আর গ্রিড বিপর্যয় ঘটে না।

এ ধরনের সংকট সমাধানে সঞ্চালন এবং বিতরণ ব্যবস্থায় ক্যাপাসিটর ব্যাংক বসানো থাকে। তবে মাঝে মাঝে সেগুলোও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারে না।

সমাধান যেভাবে

জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, গ্রিড সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে গ্রিডের কোনও একটা লাইন যদি আকস্মিক বন্ধ হয়ে যায় তাহলে সেই পরিমাণ সরবরাহ যেন সঙ্গে সঙ্গে আমরা বৃদ্ধি করতে পারি সেই নিশ্চয়তা থাকতে হবে। অন্যদিকে আমাদের যেখানে যেখানে সাবস্টেশন দরকার সেখানে সেগুলো নির্মাণ করা। গ্রিডের প্রয়োজনীয় সবখানে ক্যাপাসিটর ব্যাংক বসানো। তিনি বলেন, আমরা যত দ্রুত স্মার্ট গ্রিডের দিকে যাবো ততই এই সমস্যার সমাধান হবে। এজন্য আমরা একটি মার্কিন কোম্পানিকে পরামর্শক নিয়োগ করে কিছু কাজও এগিয়ে রেখেছি। স্মার্ট কাজের অংশ হিসেবে বিতরণ লাইন আগের চেয়ে অনেক বেশি স্মার্ট হয়েছে। কিন্তু সঞ্চালনের কাজে আরও সময় লাগবে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ হোসেন বলেন, আমাদের গ্রিড সম্পূর্ণ অটোমেটেড না। অটোমেটেড হলে মানুষের ওপর পুরো নির্ভরশীল হতে হতো না। মেশিনই বলে দিতো ত্রুটি কোথায়। এজন্য আর তদন্ত কমিটি করে ত্রুটি খোঁজার প্রয়োজন হতো না। অন্যদিকে এখন অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করে লোড কমানো-বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তখন মেশিনেই সেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতো।

তিনি বলেন, হাইলোডে আমরা অপারেট করছি। আর লো লোডে সাপ্লাই করছি। এটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।  যেকোনও সময় গ্রিড ফেলের আশঙ্কা থেকে যায়। সামনে আরও বেশ কিছু বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হচ্ছে। তাদের এসব বড় বিদ্যুতের লোড যখন সঞ্চালন লাইন দিয়ে প্রবাহিত হবে, হুট করে এত লোড অফ হয়ে গেলে গ্রিডে বিপর্যয় ঘটতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.